হাকালুকি হাওর : প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অদ্ভুত চিত্রকল্প
প্রকাশিত হয়েছে : ৩০ নভেম্বর ২০১৭
দেলোয়ার হোসাইন, সিলেট থেকে:
‘হাকালুকি হাওর’ প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের এক জলাভূমি। শীতকালে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা অতিথি পাখির তুমুল কলকাকলি, রাখালের বাঁশিতে মেঠো সুর, সূর্যমুখী ফুলের উপর প্রজাপতির অবাধ ওড়োউড়ি, সবুজ বিছানা এবং বর্ষায় ভরা যৌবনে ঢেউয়ের সাথে জলের থই থই খেলা, মাঝিদের হাকডাক আর জেলেদের জালে মাছের লাফালাফি এ যেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অদ্ভূত চিত্রকল্প!
পূর্বে পাথারিয়া ও মাধব আর পশ্চিমে ভাটেরা পাহাড়বেষ্টিত এশিয়ার সবচেয়ে বড় মিঠা পানির হাওর হাকালুকি মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলার ৬টি উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন নিয়ে বিস্তৃত। হাওরের ৭০ ভাগ বড়লেখা, জুড়ি ও কুলাউড়া, ১৫ ভাগ ফেঞ্চুগঞ্জ, ১০ ভাগ গোলাপগঞ্জ এবং ৫ ভাগ বিয়ানীবাজার উপজেলায় বিস্তৃত। ছোট-বড় প্রায় ২৩৮টি বিল ও ১০টি নদী নিয়ে গঠিত হাকালুকি হাওরের আয়তন ১৮,১১৫ হেক্টর, এর মধ্যে শুধুমাত্র বিলের আয়তন ৪,৪০০ হেক্টর। হাকালুকি হাওরের বিশাল জলরাশির মূল প্রবাহ হলো জুড়ী এবং পানাই নদী। এই জলরাশি হাওরের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত কুশিয়ারা নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়।
পর্যটকদের কাছে মিনি কক্সবাজার নামে পরিচিতি হাকালুকি হাওরের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য বড়লেখা ও ফেঞ্চুগঞ্জের একাংশে নির্মাণ করা হয়েছে ওয়াচ টাওয়ার। ৪০ ফুট উচু ওয়াচ টাওয়ারে পর্যটকদের ভিড় লেগেইে থাকে। টাওয়ার থেকে দেখা যায় পুরো হাওরের চিত্র। সূর্যাস্তের সময় হাওরের বুকজুড়ে মনোমুগ্ধকর দৃশ্য পর্যটকেরা মনভরে অবলোকন করেন। দাঁড়বাহী বা ইঞ্জিন চালিত নৌকা ভাড়া করেও ঘুরে ঘুরে উপভোগ করা যায় হাওরের সৌন্দর্য। ক্যালেন্ডারের পাতা বদলানোর সাথে সাথে হাকালুকি হাওরেরও রূপ বদলে যায়। তবে বর্ষা মৌসুমে হাওরের চেহারা পুরোপুরি বদলে যায়। হাওর তখন ভয়ঙ্কর সুন্দর হয়ে উঠে। বিশাল বিশাল ঢেউ পর্যটকের মনে আনন্দ দেওয়ার পাশাপাশি আতঙ্ক ছড়ায়। একই সাথে পানিবন্দি হাওরবাসীর উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার কোনো শেষ থাকে না।
মাছের জন্য প্রসিদ্ধ হাকালুকি হাওরে ১০৭ প্রজাতির মাছ আছে- তার মধ্যে বোয়াল, পাবদা, রুই, চিতল, কালবাউশ, মৃগেল, আইড়, ঘুলশা, সরপুঁটি, টেংরা, বাইম ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। যদিও এর মধ্যে ৩২ প্রজাতির মাছ প্রায় বিপন্ন। এছাড়া হাওরে প্রতিবছর ছোট ছোট ২-৪টি ইলিশ ধরা পড়লেও এবার তুলনামূলক বড় এবং ব্যাপক ইলিশ ধরা পড়েছে। শেষ বিকেলে আঞ্চলিক গানের তালে তালে হাওরে জাল ফেলে জেলেরা মেতে ওঠে মাছ ধরার উৎসবে। এ সময় উৎসব ঘিরে অনুষ্ঠিত হয় বিভিন্ন সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান। হাকালুকি হাওরের বড়লেখা অঞ্চলে গড়ে ৬৫৫ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদিত হয় বলে সাপ্তাহিক দেশ’কে জানিয়েছেন উপজেলা সহকারী মৎস কর্মকর্তা আবু ইউসুফ। শীতকালে হাওর সাজে অন্যরূপে। সবুজ ঘাসের বিছান পাতা হাওরের প্রাকৃতিক দৃশ্য ও বিলের কান্দিগুলো তখন দৃষ্টিনন্দন হয়ে উঠে। এ সময় ১১২ প্রজাতির অতিথি পাখি ও ৩০৫ প্রজাতির দেশীয় পাখির বিচরণে পুরো হাওর এলাকা মুখরিত হয়ে ওঠে। অতিথি পাখিদের আগমনে হাওর পরিণত হয় স্বর্গ উদ্যানে। এসব অতিথি পাখির মধ্যে ভূতি হাঁস, গিরিয়া হাঁস, ল্যাঞ্জা হাঁস, বালি হাঁস, গুটি ঈগল, কুড়া ঈগল, রাজ সরালি, পান ভুলানি, কাস্তেচড়া, পান কৌড়ি, বেগুনী কালিম, মেটেমাথা টিটি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
তখন অতিথি পাখির কলকাকলিতে হাওরের পাশেই হাল্লা গ্রামের হাল্লা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন ‘পাখিবাড়ি’ নামে পরিচিত মনোহর আলী মাস্টারের পতিত বাড়িও মুখর হয়ে ওঠে। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে হাকালুকি হাওরের থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে এসে পাখিরা এ বাড়ির হিজল, করস ও জারুল গাছে আশ্রয় নেয়। তবে শুধু শীত মৌসুমে নয়, সারা বছরই ‘পাখিবাড়ি’ অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুখরিত থাকে। এ সময় অতিথি পাখি দেখার জন্য পাখি প্রেমীরাও হাওরে ভিড় জমান, আসেন বিদেশী পর্যটকেরাও। আর দেশীয় নানা প্রজাতির পাখির আনাগোনা হাকালুকিতে সারা বছরই দেখা যায়। তবে বিষটুপ ও ফাঁদ পেতে অতিথি পাখি নিধনে এক শ্রেণীর অসাধু সংঘবদ্ধ পাখি শিকারিচক্র সক্রিয় রয়েছে।
তেল আহরণের জন্য হাকালুকির বড়লেখা অঞ্চলের ওয়াচ টাওয়ারের আশেপাশে সূর্যমুখী ফুলের চাষ করা হয়। সূর্যমুখী ফুলের উপর প্রজাপতির অবাধ ওড়োউড়ি, সূর্য আর সূর্যমুখী ফুলের মিলনমেলায় পর্যটকেরা মিশে যেতে পারেন রঙের খেলায়! এছাড়া হাকালুকি হাওরে ৫২৬ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেলে সম্ভাবনাময় পর্যটন এলাকা হিসেবে হাকালুকি হাওর আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হতে পারে। দেশের পর্যটন শিল্প বিকাশে ইতিবাচক ভূমিকার পাশাপাশি হাওরবাসীর জন্য বিকল্প আয় সৃষ্টি ও হাওরের পরিবেশ উন্নয়ন ও জীববৈচিত্র সংরক্ষণে অনন্য ভূমিকা রাখতে পারে।
হাকালুকি হাওরে চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করেন এ অঞ্চলের কয়েক হাজার কৃষক। হাকালুকি হাওরের মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া, বড়লেখা ও জুড়ী উপজেলা এবং সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার ও ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা অঞ্চলে প্রায় ২২ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো চাষ করা হয় বলে সাপ্তাহিক দেশ’কে জানিয়েছেন কুলাউড়া উপজেলা কৃষি অফিসার জগলুল হায়দার। এর মধ্যে কুলাউড়া উপজেলার হাকালুকি হাওর অঞ্চলে প্রায় ৪ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ করা হয় বলে জগলুল হায়দার জানান। জুড়ী উপজেলার হাকালুকি হাওর অঞ্চলে গত মৌসুমে ৪৯১৫ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছিলো বলে জানিয়েছেন উপজেলার উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা চমক আচার্য্য। বড়লেখা উপজেলার হাকালুকি হাওর অঞ্চলের তিন ইউনিয়নে ২২৫০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয় বলে জানিয়েছেন বড়লেখা উপজেলা কৃষি অফিসার মোঃ কতুব উদ্দিন। এদিকে সিলেট জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার হাকালুকি হাওর অঞ্চলে প্রায় ২৭৫০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ করা হয় বলে উপজেলা কৃষি অফিসার হাসান ইমাম জানিয়েছেন। গোলাপগঞ্জ অঞ্চলে প্রায় ৭০০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয় বলে জানিয়েছেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা খায়রুল আমিন।
হাকালুকিতে ধানের ব্যাপক উৎপাদন হলেও ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢল ও অতিবৃষ্টিতে কোনো কোনো বছর হাকালুকি হাওরের ফসল পানির নিচে তলিয়ে যায়। প্রকৃতির দয়ার উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হাওর পারের মানুষের তখন দুঃখ-কষ্ট, অভাব-অনটনের কোন শেষ থাকে না। চলতি বছরের বন্যায় হাওরে ধান পঁচে পানিতে অ্যামোনিয়া ও হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাসের সৃষ্টি হয়ে মাছের মড়ক দেখা দেয়। হাজার হাজার কৃষক ও জেলে পরিবারে চরম দুর্ভোগ নেমে আসে। পরিবেশ বিপর্যের পাশিপাশি প্রাণীবৈচিত্রের ব্যাপক ক্ষতি হয়।
হাকালুকি নামের উৎপত্তি সম্পর্কে নানা লোককাহিনী রয়েছে। কথিত আছে, বহু বছর আগে ত্রিপুরার মহারাজা ওমর মানিক্যের সেনাবাহিনীর ভয়ে বড়লেখার কুকি দলপতি হাঙ্গর সিং জঙ্গলপূর্ণ ও কর্দমাক্ত এক বিস্তীর্ণ এলাকায় এমনভাবে ‘লুকি দেয়’ বা লুকিয়ে যায় যে, কালক্রমে ঐ এলাকার নাম হয় ‘হাঙ্গর লুকি’, পরবর্তীতে তা ‘হাকালুকি’ নামে পরিচিতি লাভ করে।
আরেকটি জনশ্রুতি অনুযায়ী প্রায় দুই হাজার বছর আগে প্রচন্ড এক ভূমিকম্পে ‘আকা’ নামে এক রাজা ও তাঁর রাজত্ব মাটির নিচে সম্পূর্ণ তলিয়ে যায়। কালক্রমে এই তলিয়ে যাওয়া নিম্নভূমির নাম হয় ‘আকালুকি’ বা হাকালুকি। আরো প্রচলিত যে, এক সময় বড়লেখা থানার পশ্চিমাংশে ‘হেংকেল’ নামে একটি উপজাতি বাস করতো। পরবর্তীতে এই ‘হেংকেলুকি’ হাকালুকি নাম ধারণ করে। এও প্রচলিত যে, হাকালুকি হাওরের কাছাকাছি এক সময় বাস করতো কুকি, নাগা উপজাতিরা। তাঁদের নিজস্ব উপজাতীয় ভাষায় এই হাওরের নামকরণ করা হয় ‘হাকালুকি’, যার অর্থ ‘লুকানো সম্পদ’।
যেভাবে যাবেন: ঢাকা থেকে ট্রেনে-বাসে দুই মাধ্যমেই হাকালুকি যাওয়া যায়। বাসে যেতে হলে ফকিরাপুল-সায়েদাবাদ থেকে রূপসী বাংলা, শ্যামলী পরিবহন এবং মহাখালী থেকে এনা পরিবহনেও যাওয়া যেতে পারে। আর ট্রেনে যেতে চাইলে কমলাপুর বা বিমানবন্দর রেলস্টেশন থেকে সিলেটগামী আন্তঃনগর ট্রেনে কুলাউড়ায় নেমে ভুকশিমইল হয়ে সরাসরি হাকালুকি যাওয়া যায়।
অথবা কুলাউড়া থেকে বাস বা অটোরিক্সাতে (সিএনজি) বড়লেখা গিয়ে কানুনগো বাজার হয়েই পৌঁছে যাবেন হাকালুকি। চাইলে কুলাউড়া থেকে জুড়ি উপজেলা শহর পেরিয়ে মূল রাস্তার পশ্চিম পাশে বাসিরপুর-হাকালুকি সড়ক দিয়েও হাকালুকি যেতে পারেন। মূল সড়ক থেকে সাইন বোর্ডে এ্যারো চিহ্ন দিয়ে রাস্তা দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে ‘স্বাগতম হাকালুকি’। সব মিলিয়ে সময় লাগবে ছয় থেকে আট ঘণ্টা। হাকালুকিতে দিনে দিনে ঘুরে আসতে পারেন অথবা থাকতে চাইলে বড়লেখা শহরে আমিরাত, মোশাহিদ ইত্যাদি আবাসিক হোটেলে থাকতে পারবেন, এছাড়া সরকারি রেস্ট হাউসেও উঠতে পারেন। চাইলে বড়লেখায় অবস্থিত বাংলাদেশের একমাত্র জলপ্রপাত মাধবকুণ্ড-ও ঘুরে আসতে পারেন।
এছাড়া সিলেট শহর থেকে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার মাইজগাঁও হয়ে হাকালুকি যাওয়া যায়। ঢাকা-সিলেট রেলপথে সিলেট পৌঁছার ঠিক আগের স্টেশন মাইজগাঁও, অথবা সিলেট থেকে সড়ক পথে মাইজগাঁও নামার পর অটোরিক্সা করে ঘিলাছড়ার জিরো পয়েন্টে গেলেই পৌঁছে যাবেন হাকালুকি হাওরে। জিরো পয়েন্টে নৌকাঘাটে গিয়ে দরদাম করে নৌকায় বা প্রমোদতরী হিসেবে পরিচিত ‘পিকনিক শিপ’-এ চড়ে ঘুরে আসতে পারেন সৌন্দর্যের অপূর্ব লীলাভূমি হাকালুকি হাওর। ছবি: সাপ্তাহিক দেশ তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া ও বাংলাপিডিয়া