টাওয়ার হ্যামলেটসে ২ মিলিয়ন পাউন্ডের ঘুষ কেলেঙ্কারি : নাটের গুরু কারা
প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ ডিসেম্বর ২০১৭
০ সেক্রেটারি অব স্টেটের হস্তক্ষেপ চাইলো পিপলস অ্যালায়েন্স
০ জন বিগসের পদত্যাগ দাবী করলো ইন্ডিপেন্ডেন্টস গ্রুপ
০ ১৮ মাসেও পুলিশি তদন্ত সম্পন্ন না হওয়ায় হতাশ জন বিগস
দেশ ডেস্ক: ঘুষ কেলেঙ্কারির অভিযোগে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু এখন টাওয়ার হ্যামলেটস। বৃটেনের শীর্ষ স্থানীয় সংবাদপত্র সানডে টাইমসে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশের পর সর্বত্র তোলপাড় শুরু হয়েছে। একজন লেবার সমর্থক বৃটিশ-বাংলাদেশী ব্যবসায়ী একটি ডেভেলাপার কোম্পানীকে বহুতল ভবনের প্লানিং পারমিশন পাইয়ে দিতে দুই মিলিয়ন পাউন্ড ঘুষ দাবী করেছেন। তিনি বলেছেন, এই দুই মিলিয়ন পাউন্ড ৪ লেবার কাউন্সিলারকে ৫ হাজার করে দিতে হবে, যারা টাওয়ার হ্যামলেটস প্লানিং কমিটির সদস্য। ঘুষ কেলেঙ্কারির মধ্যস্থতাকারী ওই ব্যবসায়ীর টেলিফোন কথোপকথনের রেকর্ড ফাঁস হওয়ার পর কমিউনিটির মানুষের মধ্যে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কমিউনিটির মানুষ জানতে চায়, নাটের গুরু ওই চার কাউন্সিলার কারা, যারা ২ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে বহুলতল ভবনের প্লানিং পারমিশন দিতে মধ্যস্থতাকারী নিয়োগ করেছিলেন। সানডে টাইমসে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঘুষ কেলেঙ্কারির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন নির্বাহী মেয়র জন বিগসের ডেপুটি হিসেবে কাজ করা কাউন্সিলার সিরিয়া খাতুন এবং কমার্শিয়াল রোডে অবস্থিত আমানা বিজনেস সেন্টারের মালিক আবদুস শুকুর খালিসাদার। ২০১৫ সালের মেয়র নির্বাচনে আবদুস শুকুর মেয়র জন বিগসের পক্ষে ভোট টানতে জোরালো ভূমিকা রাখেন। টাওয়ার হ্যামলেটস লেবারের খুবই ঘনিষ্টজন বলেও পরিচিত এই ব্যবসায়ী।
ডেভেলপার কোম্পানির সাথে ঘুষ লেনদেনের কাজটির দায়িত্ব নিয়েছিলেন আবদুস শুকুর। এর আগে কাউন্সিলার সিরিয়া খাতুন আবদুস শুকুরকে ডেভেলপার কোম্পানির এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। গত ১০ ডিসেম্বর রোববার টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলকে জড়িয়ে দুর্নীতির এই মহাপরিকল্পনার চিত্র সবিস্তারে তুলে ধরে প্রতিবেদন প্রকাশ করে সানডে টাইমস। গুরুতর এই দুর্নীতির পরিকল্পনা ফাঁস হওয়ার ঘটনায় লেবার পার্টিতে রীতিমত তোলপাড় তৈরি হয়েছে। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, নির্বাহী মেয়র জন বিগসের ভূমিকা নিয়ে। ঘুষ দাবির বিষয়টি ডেভেলপার কোম্পানির পক্ষ থেকে মেয়র জন বিগসকে জানানো হলেও মেয়র এ বিষয়টি পুলিশকে জানাতে সময় নিয়েছেন কয়েকমাস। পরে অবশ্য সংশ্লিষ্ট ডেভেলপার কোম্পানির প্ল্যানিং আবেদনকে প্রত্যাখ্যান করে দেয়া হয়। যে কারণে লন্ডন মেয়র অফিস এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হয়।
এসব ঘটনার কয়েক মাস পর মেয়র জন বিগস বিষয়টি তদন্তে একটি অ্যাকাউন্টিং ফার্মকে (ইওয়াই) নিয়োগ দেন। দুর্নীতির বিষয়ে পুলিশে না গিয়ে মেয়র অ্যাকাউন্টিং ফার্মের কাছে কেন গেলেন সেটিও একটি বিরাট রহস্য। ঘুষ নিয়ে আলাপের সময় মোট চারজন রাজনীতিক এ অর্থ পাবেন বলে উল্লেখ করা হয়। এ চারজন কারা, তা নিয়েও আছে বড় প্রশ্ন। এ কেলেঙ্কারির ঘটনায় কোনো অর্থের লেনদেন হয়নি। কারণ ডেভেলপার কোম্পানি গোপনে সব কথা রেকর্ড করে এবং বিষয়টি মেয়র জন বিগসকে জানায়। পরবর্তীতে ওই গোপন রেকর্ডিং সানডে টাইমের কাছে ফাঁস করে দেয়া হয় যার ভিত্তিতে ঘটনার প্রায় দুই বছর পর গত ১০ ডিসেম্বর রোববার বিরাট প্রতিবেদন প্রকাশ করে পত্রিকাটি। সানডে টাইমের রিপোর্টের পর ডেইলি মেইলসহ অন্যান্য মিডিয়াও ফলাও করে নিউজটি প্রকাশ করে। টাওয়ার হ্যামলেটসের সাবেক ইন্ডিপেনডেন্ট মেয়র লুতফুর রহমানের বিরুদ্ধে লেবার পার্টি দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছিল। ভোট জালিয়াতিসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলে আদালতের মাধ্যমে তাঁকে অপসারণে বাধ্য করা হয়। কিন্তু লুতফুর রহমানের বিরুদ্ধে ঘুষ লেনদেনের কোনো অভিযোগ কখনো পাওয়া যায়নি।
লুতফুর রহমানকে অপসারণের সুযোগ নিয়ে লেবার দলের প্রার্থী জন বিগস ২০১৫ সালের জুনে মেয়র নির্বাচিত হন। নির্বাচনী প্রচারে তিনি টাওয়ার হ্যামলেটসকে দুর্নীতিমুক্ত করার প্রতিশ্রুতি বারবার উচ্চারণ করেন। অথচ নির্বাচিত হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই জন বিগসের প্রশাসন এই ঘুষ লেনদেনের দফারফা শুরু করে বলে উঠে এসেছে টাইমসের প্রতিবেদনে যাতে ভূমিকা ছিলো জন বিগসের ডেপুটি কাউন্সিলার সিরিয়া খাতুনের। টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, হংকং ভিত্তিক প্রপার্টি ডেভেলপার কোম্পানি ফার ইস্ট কনসোরটিয়াম কেনারি ওয়ার্ফের লাগোয়া এলাকায় আলফা স্কয়ার নামে একটি বহুতল ভবন নির্মাণের প্রস্তাব করে। ৫শ মিলিয়ন পাউন্ডের ওই প্রজেক্টে ৬শ ফ্ল্যাট, স্কুল, হোটেল এবং মেডিকেল সার্জারি নির্মাণের কথা। ভবনটি মোট ৬৫ তলা হওয়ার কথা।
২০১৫ সালে জুন মাসে ডেভেলপার কোম্পানি তাদের প্রথম আবেদনটি প্রত্যাহার করে নেয়। কারণ ওই আবেদনে স্থানীয় এলাকার উন্নয়ন সংক্রান্ত লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ঠিকমত মানা হয়নি। এরপর বিষয়গুলো সংশোধন করে দ্বিতীয় আবেদনটি করা হয়। ততদিনে লুতফুর রহমান মেয়র পদ থেকে অপসারিত হয়ে জন বিগস ক্ষমতায়। আর কাউন্সিলার সিরিয়া খাতুন হয়েছেন ডেপুটি মেয়র। ২০১৫ সালের ৩ আগস্ট ডেভেলপার কোম্পানি ফার ইস্ট কনসোর্টিয়ামের ইউকে প্রধান জন কোনোলি ডেপুটি মেয়র সিরিয়া খাতুনের সাথে ব্যক্তিগতভাবে বৈঠক করেন। সেখানে কাউন্সিলর হেনরি জোন্সও উপস্থিত ছিলেন। হেনরি জোন্সের সুপারিশে সিরিয়া খাতুন ফ্রিডম অব দ্য সিটি অব লন্ডন অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলেন। ফাঁস হওয়া দলিল অনুযায়ী কাউন্সিলার সিরিয়া খাতুন এই প্রজেক্টের পক্ষে মত দিচ্ছিলেন না। তাই জন কনোলি মেয়র জন বিগসের সাথে দেখা করে তাঁর সংশোধিত প্রস্তাবটি দাখিল করেন।
এরপর সিরিয়া খাতুন জন কোনোলিকে দ্বিতীয় দফা সাক্ষাতের জন্য খবর পাঠান। ২৬ অক্টোবর তাদের দ্বিতীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে সিরিয়া খাতুন বেশ খুশি মনে আমানা সেন্টারের মালিক আবদুস শুকুরের সাথে কোনোলিকে পরিচয় করিয়ে দেন। বলেন, প্ল্যানিংয়ে যেসব সমস্যা রয়েছে সেগুলোর সমাধানে আবদুস শুকুর সাহায্য করতে পারবেন। আবদুস শুকুর প্ল্যানিং পারমিশন নিয়ে দিতে পারবেন বলেও ইঙ্গিত করেন তৎকালীন ডেপুটি মেয়র সিরিয়া খাতুন। এই বৈঠকেও কাউন্সিলর হেনরি জোন্স উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকের এক ফাঁকে আবদুস শুকুর জন কোলোনিকে এক পাশে ডেকে নিয়ে যান। কফি খেতে খেতে তিনি খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই প্রস্তাব করেন যে, দুই মিলিয়ন পাউন্ড প্রিমিয়াম দিলে এই প্রজেক্ট পাশ হয়ে যাবে। চারজন রাজনীতিক সমান ভাগে এই অর্থ পাবেন। জন কোনোলি বলেন, তাঁর একজন কনসালটেন্ট বিষয়টি দেখভাল করবে।
এর ১০ দিন পর ৪ নভেম্বর ওই কনসালটেন্ট আবদুস শুকুরকে ফোন করেন। রেকর্ডার চালু করে দিয়ে আবদুস শুকুরের সাথে কথা বলেন তিনি। এ সময় শুকুর আবারও বলেন যে, দুই মিলিয়ন পাউন্ড দিলে প্রজেক্ট পাশ হয়ে যাবে। চারজন রাজনীতিক ওই অর্থ পাবেন। আর ভিএটিসহ মাসে ১৫ হাজার পাউন্ড করে তাঁকে কনসালটেন্সি ফি দিতে হবে। তিনি দাবি করেন আরও প্রজেক্টের ক্ষেত্রে এমন লেনদেন হয়েছে। আর এসব কাজে তাঁকে দুতিয়ালির জন্য ব্যবহার করা হয়। শুকুর দাবি করেন, লেবার দলের এনইসি এবং শীর্ষ রাজনীতিকদের সাথেও তাঁর ভাল উঠাবসা আছে। সানডে টাইম প্রমাণ হিসেবে কয়েকটি ছবি প্রকাশ করে। (এসব ছবিতে লেবার পার্টির সাবেক ডেপুটি লিডার হারিয়েট হারম্যান ও রুশানারা আলী এমপির সাথে আব্দুস শুকুর খালিসাদারকে দেখা যায়। ২০১৫ সালে নারী দিবস উপলক্ষে আব্দুশ শুকুর খালিসাদারের মালিকানাধীন পূর্ব লন্ডনের কমার্শিয়াল রোডস্থ আমানা সেন্টারে অনুষ্ঠিত এক সমাবেশে হারিয়েট হারম্যান ও রুশনারা আলীর সাথে এসব ছবি তোলা হয়।) ওই কনসালটেন্ট শুকুরকে তাঁর প্রস্তাব লিখিত আকারে পাঠানোর অনুরোধ করেন। প্রায় ৫৮ মিনিটের ওই কথোপকথনের পুরোটাই রেকর্ড করে নেন ডেভেলাপার কোম্পানির কনসালটেন্ট।
শুকুর পরবর্তীতে ক্রিসেন্ট ইউকে ডেভেলাপমেন্ট নামের একটি কোম্পানির পক্ষে প্রস্তাব পাঠান। যাতে বলা হয়, প্ল্যানিং পারমিশনের বিনিময়ে ২ মিলিয়ন পাউন্ড ক্রিসেন্ট ইউকে ডেভেলাপমেন্ট কোম্পানিকে দিতে হবে। সানডে টাইমের রিপোর্ট মতে, শেষ পর্যন্ত কোনো ঘুষের লেনদেন অবশ্য হয়নি। জন কোনোলি ২৬ নভেম্বর টাওয়ার হ্যামলেটসের নির্বাহী মেয়র জন বিগসের সাথে লিভারপুল স্টেশনের কাছে সাক্ষাত করেন এবং তাঁকে বিষয়টি অবহিত করেন।
ওই বছরের ডিসেম্বরে টাওয়ার হ্যামলেটসের প্ল্যানিং কর্মকর্তারা ফার ইস্ট কনসোর্টিয়ামের আলফা স্কয়ার নির্মাণের আবেদন প্রত্যাখান করার পরামর্শ দেন। প্ল্যানিং কর্মকর্তাদের এমন পরামর্শ লন্ডন মেয়র অফিসকে অবাক করে। গ্রেটার লন্ডন অথোরিটির এসিসটেন্ট ডাইরেক্টর স্টুয়ার্ট মারি জন কোলোনির কাছে লেখা এক চিঠিতে আলফা স্কয়ারের পক্ষে সমর্থন তুলে ধরেন এবং টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল এর চাইতেও বিতর্কিত প্রজেক্টে সমর্থন দিচ্ছে বলেও তিনি সমালোচনা করেন। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ফার ইস্ট কনসোরটিয়ামের আবেদন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাখ্যান করে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল। প্রত্যাখ্যানের পক্ষে যুক্তি দেখায় মূল ভবনটি মাত্রাতিরিক্ত উচ্চতাসম্পন্ন এবং এটি এলাকায় কনজেশনের সৃষ্টি করবে।
এরপর তৎকালীন মেয়র বরিস জনসন বিশেষ ক্ষমতাবলে ওই প্রজেক্ট নির্মাণের অনুমতি দেন। প্রজেক্টটির কাজ আগামী বছর থেকে শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। ফার ইস্ট কনসোর্টিয়াম এই ঘুষ দাবির বিষয়ে মেয়র জন বিগসের কাছে অভিযোগ করার প্রায় দুই বছর হয়ে গেছে। কিন্তু প্ল্যানিং পারমিশন প্রত্যাখ্যান করার পর ২০১৬ সালের এপ্রিলে বিষয়টি তদন্তের জন্য অ্যাকাউন্টিং ফার্ম ইওয়াইকে দায়িত্ব দেয় টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল। তদন্তকারীরা তাদের রিপোর্টে বিষয়টি গুরুতর আখ্যায়িত করে ঘটনাটি পুলিশকে জানানোর পরামর্শ দেয়। প্রাথমিকভাবে কাউন্সিল একটি ফাইল সিরিয়াস ফ্রড অফিসে পাঠায়। ওই অফিস ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে সেটিকে ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সির কাছে হস্তান্তর করে। এখনো পর্যন্ত এ ঘটনায় কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি কিংবা যাদের নাম এসেছে তাদের জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়নি।
সানডে টাইমসের প্রশ্নের জবাবে আবদুস শুকুর দুই মিলিয়ন পাউন্ড দাবি করার কথা স্বীকার করেন। কিন্তু তিনি দাবি করেন, এটা কোনো অন্যায় প্রস্তাব ছিল না। তাঁর আইনজীবী বলছেন, শুকুর কোনো অন্যায় করেননি। কারণ কোনো চুক্তি ছাড়াই আলোচনা সমাপ্ত হয়েছে। শুকুর স্বীকার করেন কাউন্সিলার সিরিয়া খাতুন তাঁকে জন কোনোলির সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর দাবি, এ ঘটনার সাথে কাউন্সিলার সিরিয়ার কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
এক বিবৃতিতে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল বলেছে, ইওয়াই (অ্যাকাউন্ডিং ফার্ম) এর তদন্তের ফলাফল একজন কিউসি মূল্যায়ন করেছেন এবং ফাইলটি সিরিয়াস ফ্রড অফিসে প্রেরণের পরামর্শ দিয়েছেন। সিরিয়াস ফ্রড অফিস সেটিকে তদন্তের জন্য ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সির কাছে হস্তান্তর করেছে। কাউন্সিল তদন্তের ফলাফল জানার অপেক্ষায় আছে।
এদিকে ঘুষ কেলেঙ্কারির এই ঘটনা লেবার দলের সাম্প্রতিক অস্থিরতাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। সিরিয়া খাতুন হঠাৎ করেই কয়েক মাস আগে জন বিগসের কেবিনেট থেকে পদত্যাগ করেন। এর কিছুদিন পর র্যাচেল সন্ডার্সও ডেপুটি মেয়রের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। সর্বশেষ সিরিয়া, সন্ডার্স এবং জশোয়া প্যাকসহ কয়েকজন কাউন্সিল নির্বাচনে প্রার্থী না হওয়ার ঘোষণা দেন। টাওয়ার হ্যামলেটস লেবারের এই প্রভাবশালী নেতাদের এমন সিদ্ধান্তের পেছনে আসল কারণ কী, তা নিয়ে পরিষ্কার কোনো ধারণা পাওয়া যায়নি। এখন ঘুষ কেলেঙ্কারির ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর প্রশ্ন উঠেছে- এ ঘটনার জন্যই কি টাওয়ার হ্যামলেটস লেবারে এত অস্থিরতা?
১৮ মাসেও পুলিশি তদন্ত সম্পন্ন না হওয়ায় হতাশ জন বিগস
এ ব্যাপারে টাওয়ার হ্যামলেটসের মেয়র জন বিগস তার বিবৃতিতে বলেছেন, অভিযোগ জানার পর আমি কাউন্সিলের সংশ্লিষ্ট কর্মতাদেরকে বিষয়টি অবহিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য অনুরোধ করি এবং তারা আমার নির্দেশনা মোতাবেক পযাঁয়ক্রমে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। কিন্তু দীর্ঘ ১৮ মাসেও পুলিশ তদন্ত সম্পন্ন করতে না পারায় আমি হতাশ। বিবৃতিতে জন বিগস আরো জানান, লিডার অব দ্যা লেবার গ্রুপ হিসাবে প্ল্যানিং কমিটিতে বিভিন্ন পরিবর্তন আনা হয়েছে এবং প্ল্যানিং প্রসেসে অতিরিক্ত মনোযোগ দিয়েছি। মেয়র বলেন, ঘটনাটি আমাদের আরেকবার মনে করিয়ে দিলো এখনো অনেক কাজ বাকি। তাই আগামী নির্বাচনটি হবে অতীতের বিশৃংখলায় ফিরে যাবার বিপরীতে লেবার পার্টির ভ্যালু এবং ডিসিপ্লিনের লড়াই।
টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের বক্তব্য
টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল থেকে প্রেরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, আলফা স্কয়ার এর প্ল্যানিং এপ্ল্যিকেশন বিবেচনার সময় কাউন্সিল বিন্দু পরিমান ছাড় দেয় নাই। ২০১৬ সালে ফেব্রুয়ারী মাসে তাদের আবেদন স্ট্যাট্রেজিক ডেভেলাপমেন্ট কমিটিতে প্রত্যাখাত হয়। ভোটাভুটিকালে কমিটির সদস্য মোট ৮ জন কাউন্সিলারের মধ্যে ৬ জন কাউন্সিলারই তাদের আবেদনের বিপক্ষে ভোট দেন এবং ২ জন অনুপস্থিত ছিলেন। এর আগে কাউন্সিল অফিসাররাও তাদের আবেদন প্রত্যাখানের জন্য সুপারিশ করেছিলেন।
সেক্রেটারি অব স্টেটের হস্তক্ষেপ চাইলো পিপলস অ্যালায়েন্স
টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের হাউজিং প্রকল্প সম্পর্কে উত্থাপিত অভিযোগের তদন্ত দাবির সাথে একমত পোষণ করেছেন পিপলস অ্যালায়েন্স অব টাওয়ার হ্যামলেটস গ্রুপ লিডার কাউন্সিলর রাবিনা খান। গত ১৩ ডিসেম্বর বুধবার পূর্ব লন্ডনের স্টিফোর্ড কমিউনিটি সেন্টারে পিপলস এলায়েন্স অব টাওয়ার হ্যামলেটস আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে কাউন্সিলর রাবিনা খান টাওয়ার হ্যামলেটসের হাউজিং প্রকল্প সম্পর্কে সেক্রেটারি অব স্টেটের নির্দেশনা চেয়ে বিভিন্ন দলের আহ্বানের সাথে একমত পোষণ করেন জানিয়ে বলেছেন, এ বিষয়ে আমি সেক্রেটারি অব স্টেটের দৃষ্টি আকর্ষণ করে চিঠি দিয়েছি। সংবাদ সম্মেলনে কাউন্সিলর রাবিনা খান ছাড়াও পিপলস এলায়েন্স অব টাওয়ার হ্যামলেটস চেয়ার কাউন্সিলর আবুল আসাদ বক্তব্য রাখেন।
এসময় কাউন্সিলার আমিনুর খান, কাউন্সিলার শাহ আলমসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। সানডে টাইমস’র প্রতিবেদনে দুর্নীতির স্ক্যান্ডাল সম্পর্কে তদন্তের জন্য বিভিন্ন দলের পক্ষ থেকে সেক্রেটারি অব স্টেটের নির্দেশনার প্রতি আহ্বান জানানো হচ্ছে উল্লেখ করে বিরোধী দল পিপলস অ্যালায়েন্স লিডার কাউন্সিলর রাবিনা খান বলেন, এর মাধ্যমে টাওয়ার হ্যামলেটস থেকে সরকারী কমিশনারদের কাছে পাঠানো আবেদনের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকলের উদ্বেগের বিষয়টি প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বলেন, সেক্রেটারি অব স্টেট বরাবরে পাঠানো চিঠিতে আমি বলেছি, পুলিশী তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ পরিকল্পনা কার্যক্রমের বিষয়ে কাউন্সিল কর্তৃপক্ষকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে রাখা প্রয়োজন। অফস্টেড সেইফগার্ডিং স্ক্যান্ডালের মত এই স্ক্যান্ডালের ক্ষেত্রেও কাউন্সিলের উপর আমাদের আস্থা নেই। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের প্রতি কাউন্সিলের দায়িত্বশীলতার বিষয়েও আমরা আস্থাশীল নই। প্ল্যানিং প্রক্রিয়াতেও দুর্নীতির কোন চেষ্টা হচ্ছেনা বলে সাধারণ মানুষের পক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন হয়ে পড়েছে। কাউন্সিলর রাবিনা খান জানান, যখন ঘুষ দাবি করা হয়েছিল বলে বলা হচ্ছে, সে সময় তার দলের কেউ প্ল্যানিং কমিটিতেই ছিলেন না।
গত বছর অনুষ্ঠিত উপ-নির্বাচনের পর একমাত্র গ্রুপ মেম্বার এই কমিটিতে অর্ন্তভূক্ত হন, যা কথিত ঘুষ দাবির পরের ঘটনা। হাউজিং খাতে অতিরিক্ত অর্থায়নের লক্ষ্যে গৃহিত এই প্রকল্পে ১১৯ মিলিয়ন পাউন্ড ব্যয়ের সিদ্ধান্তটি মেয়র জন বিগস এর একান্ত সিদ্ধান্ত। একটি অস্পষ্ট রিপোর্টের ভিত্তিতে গৃহিত সামর্থের মধ্যে বাড়ি প্রদানের এই প্রকল্পে বিশাল অংকের বিনিয়োগ করে তাতে নির্বাচিত জনপপ্রতিনিধিদের অনুমোদন চাওয়া হয়েছিল। মেয়র একটি বিশাল ব্যয়ে ফুল কাউন্সিলের অনুমোদনও চেয়েছিলেন। প্রতিবেদনে এ ধরনের অনেকগুলো উদ্বেগজনক বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। মেয়র বিগস তার অনেক বড় কাজের বিষয়ে বেস্ট ভ্যালু ইমপ্রুভমেন্ট বোর্ডের কাছে গিয়েছেন। কিন্তু এ রকম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তিনি বোর্ডে পাঠানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি। এ প্রতিবেদনের ৮১ পৃষ্ঠায় সুপারিশ করা হয়েছে যে, সেবা বা কাজের ক্ষেত্রে কাউন্সিলের ক্রয় প্রক্রিয়া অনুসরণ করা প্রয়োজন। বেস্ট ভ্যালু বোর্ড যে বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করে ক্রয় প্রক্রিয়া তার অন্যতম।
ক্যাবিনেটকে অবহিত না করেই নির্বাচনমুখী বছরে মেয়র বিগস তার ‘মেয়রাল ডিসিশান’ বা নির্বাহী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যা ১১৯ মিলিয়ন পাউন্ডের একটি বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত। অথচ, এ ক্ষেত্রে কোনরুপ সুস্পষ্ট ধারণা নেই বা এটি যথাযথভাবে নিরীক্ষণও করা হয়নি। এটি বেস্ট ভ্যালু বোর্ডেও পাঠানো হয়নি এবং এটি নিরীক্ষণ কমিটিতেও পাঠানো প্রয়োজন ছিল। বেক্সিটের বিষয়ে টাওয়ার হ্যামলেটস যেমন অনিশ্চয়তায় ভূগছে, একইভাবে লেবার পার্টি মেয়রও আগামী নির্বাচনের বিষয়ে অনিশ্চয়তায় রয়েছেন। টাওয়ার হ্যামলেটস কনজারভেটিভ পার্টির ডেপুটি লিডার কাউন্সিলার এন্ডু উড সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। তিনি এই এফোরডেবল হাউজিং প্রোগ্রামে ১১৯ মিলিয়ন পাউন্ড দুর্নীতি বিষয়েও সাংবাদিকদের করা বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। এছাড়া লিবারেল ডেমোক্রেটিক দলের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা বলেন কমিউনিটির স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আমাদের অবস্থান ঘোষণার জন্য ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস দরকার তাই এক মঞ্চে।
জন বিগসের পদত্যাগ দাবী করলো ইন্ডিপেন্ডেন্টস গ্রুপ
টাওয়ার হামলেটস লেবার পার্টির বিরুদ্ধে ঘুষ, দুর্নীতি আর ক্ষমতার অপব্যবহারের গুরুতর অভিযোগের প্রেক্ষিতে টাওয়ার হামলেটস ইন্ডিপেন্ডেন্ট গ্রুপ মেয়র জন বিগসকে অবিলম্বে নির্বাহী মেয়র পদ থেকে সড়ে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে টাওয়ার হ্যামলেটস ইন্ডিপেন্ডেস গ্রুপ। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে ইন্ডিপেন্ডেন্ট গ্রুপ মনোনীত ও সাবেক নির্বাহী মেয়র লুতফুর রহমান সমর্থিত সম্ভাব্য মেয়র পদ প্রার্থী কাউন্সিলার অহিদ আহমদ অবিলম্বে জন বিগসকে পদত্যাগের আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘ক্যানারী ওয়ার্ফের নিকটবর্তী দেশের দীর্ঘতম স্কাইক্রাপার টাওয়ার এর প্ল্যানিং পারমিশন পাইয়ে দিতে স্থানীয় লেবার কাউন্সিলারদের ২ মিলিয়ন পাউন্ডের ঘুষ গ্রহণের যে ভিডিও সানডে টাইমস-এ প্রকাশিত হয়েছে তা দেখে আমরা হতবাক হয়েছি। লিখিত বক্তব্য তিনি বলেন, লেবার কাউন্সিলারগণ কীভাবে ঘুষ লেনদেনের মাধ্যমে অবৈধ পন্থায় এই বিরাট অংকের অর্থ তাদের পকেটস্থ করার অপচেষ্টা চালিয়েছিলেন তা অতীতের সকল রেকর্ড হার মানিয়েছে। এতে প্রমাণিত হয়েছে মেয়র বিগস কাউন্সিল এবং তার দলের কাউন্সিলারদেরকে সঠিক নেতৃত্ব দিতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। তাই তাঁর এই গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকার কোন অধিকার নেই। আমরা অবিলম্বে তাঁর পদত্যাগ দাবি করছি। টাওয়ার হামলেটস লেবার পার্টির কাউন্সিলাররা এমনভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত যে স্থানীয় লেবার ব্যবসায়ীদের সাথে যোগসাজস করে ৫শ মিলিয়ন পাউন্ডের কাজ পাইয়ে দিতে জন বিগস এর নাকের ডগায় কীভাবে ঘুষ লেনদেনের চেষ্টা করেছেন তা জন বিগস অস্বীকার করলেও জনগণ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে এখানে তারও গোপন আঁতাত রয়েছে। কারণ সানডে টাইমস এর রিপোর্টে বেরিয়ে এসেছে যে স্থানীয় ঐ লেবার সমর্থক ব্যবসায়ী মেয়র জন বিগস এর পক্ষে গোপনে কিভাবে দোতিয়ালী করেছেন। টাওয়ার হামলেটসের জনগণকে সাথে নিয়ে আমরা এই দাবিই করছি যে, জন বিগস মেয়রসহ, সকল লেবার কাউন্সিলার অবিলম্বে পদত্যাগ করুক এবং ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সিসহ সিরিয়াস ফ্রড অফিস কর্তৃক গৃহিত তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের কাউন্সিলারশিপ বাতিল বহাল রাখা হউক।
একজন কিউসির পরামর্শ অনুয়ায়ী সিরিয়াস ফ্রড অফিস কর্তৃক যে তদন্ত শুরু করেছে এই তদন্তে সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে টাওয়ার হ্যামলেটস ইন্ডিপেন্ডেন্ট গ্রুপ লিডার কাউন্সিলার অলিউর রহমান বলেন, ডংকেষ্টার ও এবং লাংকাশায়ার কাউন্সিলে দুর্নীতির অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় যে, টাওয়ার হামলেটস লেবার পার্টির মিথ্যা সহযোগিতার আশ্বাস জনগণ আর বিশ্বাস করেনা। সেই সাথে নিরপেক্ষ তদন্তের ব্যাপারে মেয়র জন বিগস এর দেয়া আশ্বাসের ওপর টাওয়ার হামলেটস ইন্ডিপেন্ডেন্ট গ্রুপের সামান্যতম কোনো আস্থা নেই যা তাঁর অতীতের অনেক কার্যক্রম থেকে পরিস্কার হয়েছে। আমরা তাই জন বিগসের আশু পদত্যাগ দাবী করছি। সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন টাওয়ার হামলেটস ইন্ডিপেন্ডেন্ট গ্রুপের কাউন্সিলার মুহাম্মাদ আনসার মুস্তাকিম, কাউন্সিলার মাইয়ূম মিয়া, কাউন্সিলার গোলাম রাব্বানী, কাউন্সিলার মাহবুব আলম, কাউন্সিলার মুফতি মিয়া ও কাউন্সিলার সুলুক আহমদ।