মানবতার সেবায় একদিন
প্রকাশিত হয়েছে : ১৫ ডিসেম্বর ২০১৭
মোঃ রহমত আলী:
গত ১০ ডিসেম্বর ছিল বিশ¡ মানবাধিকার দিবস। ১৯৪৮ সালের এ দিনে আর্ন্তাতিক মানবাধিকার সনদ ঘোষণা করা হয়েছিল। ভাবছিলাম এদিনটি মানবাধিকার সংক্রান্ত বিশেষ কোন একটা কাজ করা যায় কি-না। কারণ আমি মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস এন্ড পীস ফর বাংলাদেশের ইউকে শাখার প্রেসিডেন্ট। সংগঠনের পক্ষ থেকে কোন সভা সমাবেশের চিন্তা করিনি এ জন্য যে, যেহেতু গত ৩ ডিসেম্বর সবেমাত্র গঠিত নতুন কার্যকরী কমিটির অভিষেক সম্পন্ন হয়েছে, তাই এতো অল্প সময়ে আরো একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা বাস্তবতার নিরিখে সম্ভব নয়। সে কারণেই ব্যক্তিগত চিন্তার এ কারণ।
বার্মিংহাম থেকে আমার পূর্ব পরিচিত অনর উদ্দিন ভাই কয়েকদিন পূর্বে ফোন করে বলেছিলেন যে, যুক্তরাজ্য প্রবাসী হবিগঞ্জের একজন লোক কয়েকমাস পূর্বে তার মায়ের চেহলাম (চল্লিশা) করার জন্য দেশে গিয়েছিলেন। তারপর সেখানে সন্ত্রাসীদের হাতে আক্রান্ত হয়ে কোন রকমে প্রাণে বেঁচে ফিরে এসেছেন এবং বর্তমানে বার্মিংহামের একটি নার্সিং সেন্টারে চিকিৎসারত আছেন। এ উপলক্ষে সেখানকার বাঙালি কমিউনিটির লোকজন সমবেত হবেন। তাই আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে কেউ যোগদান করলে ভলো হবে। আমি তখন তাকে বলেছিলাম, চেষ্টা করবো। এ চেষ্টার ফলশ্রুতি হিসাবেই ঠিক করলাম যে, আমি সেখানে যাবো। তখন ‘রথও দেখা হবে কলাও বিক্রি করা যাবে’। অর্থাৎ ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকার দিবসও পালন করা হলো আর সে সভায়ও যোগদান করা হলো।
যেই ভাবা সেই কাজ। যোগাযোগ শুরু করি আমার সহকর্মীদের সাথে। তার সাথে সাথে আমার যোগাযোগ হয়েছিল এখানকার সময় টিভির প্রতিনিধি সুয়েব কবিরের সাথে। সেও এতে নিজ গাড়িযোগে যোগদানের আগ্রহ প্রকাশ করায় আমার সহকর্মীদের এটা জানালাম। কিন্তু অনেকে আগ্রহ প্রকাশ করলেও দূরবর্তী হওয়ার কারণে যেতে সম্মত হচ্ছিলেন না। অবশেষে মৌলানা রফিক ভাই ও মাস্টার মিসবাহ কামাল রাজী হলেন। তখন সিদ্ধান্ত হলো আমরা ৩জন ও সুয়েব কবির তার গাড়িসহ বার্মিংহামে পরদিন বেলা ১২টা থেকে ১টার মধ্যে সেখানে পৌছবো।
আমাদের যেহেতু সকাল ১০টার মধ্যেই রওয়ানা দিতে হবে তাই সকালে ঘুম থেকে উঠে যখন প্রস্তুতি নিতে যাচ্ছি তখন দরজার কাছে আসতেই সব পরিকল্পনা যেন ভন্ডুল হওয়ার উপক্রম। চেয়ে দেখি ঘন তুষারপাতে সবকিছু সাদা হয়ে গেছে এবং তখনও অব্যাহতভাবে তা পড়ছে। মনের মধ্যে ভীষণ হতাশা সৃষ্টি হলো। কারণ যদি এ সময় না যেতে পারি তবে নানা ব্যস্ততার কারণে শিঘ্রই আর যাওয়া হয়তো সম্ভব হবে না। এমতাবস্থায় কিছুক্ষণের মধ্যে আমার সাথে গমনেচ্ছু রফিক ভাই ও মিসবাহকে ফোন করলাম। তারাও এ হেন পরিস্থিতিতে হতাশা প্রকাশ করলেন। সুয়েব কবিরকে ফোন দিলাম কিন্তু তার মধ্যেও একই ধরণের হতাশা। আমি নিজে হাল না ছেড়ে তখন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষনের কথা বলে আপাতত তাদেরকে আশ¡স্ত করে রাখলাম।
শুরু হলো আমার অস্বস্তিকর অবস্থার পায়চারী। একবার জানালার কাছে যাই একবার ঘড়ির দিকে তাকাই। কিন্তু তুষারপাত ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছিল, তাই তাদেরকে ফোন করে পুনরায় নিজেই বিব্রতকর অবস্থায় পড়া থেকে বিরত থাকি। তবে কতক্ষণ এভাবে অপেক্ষা করা যায়। আবারও সুয়েব কবিরকে ফোন করি। সে বলে গাড়িটি বরফে আচ্ছদিত হয়ে গেছে তাই আর যাওয়া হচ্ছে না। আমি তখন তাকে কিছুটা অভয় দিয়ে বললাম যে, যেহেতু সবেমাত্র বরফ পড়েছে এবং তা এখনও জমে যায়নি তাই গাড়ি চালাতে অসুবিধা হবে না। সাথে সাথে বললাম যে, বার্মিংহামে হয়তো এভাবে হবে না। আমি তখন বলেই দিলাম যে, আমার দুই সহকর্মী এসে গেছেন ও আমরা তার জন্য অপেক্ষায় আছি। তাই একটু কষ্ট হলেও যেন চলে আসে। তখন আমাদের কথা বিবেচনা করে সে কিছুটা সম্মতিসূচক জবাব দেয়। আমি তখন সাথে সাথে আমার দুই সহকর্মীকে ফোন করে বললাম যে, গাড়ি যেহেতু এসে গেছে তাই তারা যেন তাড়াতাড়ি চলে আসেন।
আমরা তখন নিজ ঘর থেকে কেউ বাসে করে আবার কেউ নিজ গাড়িতে করে হোয়াইটচ্যাপেল রোডস্থ এলএমসি সেন্টারের আলাদিন রেস্টুরেন্টে চলে আসি এবং অপেক্ষা করতে থাকি সুয়েব কবির এর। তখন তাকে ফোন করে বারবার বিরক্ত না করে টেক্স ম্যাসেজ পাঠাতে লাগলাম। একটার পর একটা আপডেট ও তাড়াতাড়ি চলে আসার ইঙ্গিতপূর্ণ বার্তা পাঠাতে থাকি। একসময় সে ফোন করে জানালো কিছুক্ষণের মধ্যেই রওয়ানা দিবে। তখন আমরা হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। এ সুযোগে একটু হাল্কা নাস্তা করে নিলাম। অবশেষে সে যখন আসলো তখন আমরা সবাই মিলে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলাম যে, যেহেতু ঘর থেকে চলে এসেছি তাই আর থামবো না। যে করেই হোক গন্তব্যে পৌছবো। সুয়েব তখন তার অফিস থেকে ক্যামেরা নিয়ে চলে আসে, আমরা রওয়ানা দিই। কিন্তু রাস্তা যতই অতিক্রম করছি তুষারপাতের মাত্রাও যেন ততই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। একসময় চতুর্দিকে সাদা বরফে আচ্ছাদিত দেখে মনে হলো আমরা যেন বিমানেই যাচ্ছি ।
অর্ধেক রাস্তা অতিক্রম করার পর মটওয়েতে আমাদের জন্য যে বিপদ অপেক্ষা করছিল তা আমরা কোনভাবেই অনুভব করি না। গাড়িকে এক লাইন থেকে অন্য লাইনে নিতে গিয়ে হঠাৎ চাকা পিছলে যায় এবং গাড়িটি মুহূর্তেই চক্কর দিয়ে লাটিমের মত একস্থানে ঘুরতে থাকে। আমরা কিছু বুঝে উঠার আগেই তা যেন শুন্যে উঠে যায়। এ সময় প্রচন্ড ধোঁয়া বের হচ্ছিল গাড়ি থেকে। আমরা সবাই আল্লাহর নাম জপতে থাকি। অবশেষে গাড়ি যখন কিছুটা স্থির হলো তখন দেখতে পাই গাড়ির সামনের বাম্পার ছুটে গিয়ে দূরে পড়েছে, টায়ার স্নো বেষ্টিত হয়ে জমে গেছে। আমরা সবাই তখন ভয়ে একেবারে নিথর হয়ে গেছি। তবে সুয়েব কবির আমাদেরকে নামতে না দিয়ে বিপদ সংকেতের লাইট জ¦ালিয়ে সে নেমে গিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের চেষ্টা করে। কিছুক্ষণ পর সে জানালো যে, টায়ারে বরফ সরাতে পারলেই গাড়ি চালানো যাবে। আমরা তখন নীরব দর্শক হয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। সুয়েব তার কাজ শেষ করে গাড়িতে উঠলো এবং একটা বিকল্প রাস্তা ধরে নিরাপদে অগ্রসর হতে থাকে। এভাবে প্রায় আধাঘন্টা পরে আমরা পুণরায় মটরওয়েতে চলে যাই। এ সময় আমাদের সংগঠনের ভাইস প্রেসিডেন্ট মর্তুজা সাহেবকে ফোন করে আমাদের খবর নিতে চাইলে তাৎক্ষণিকভাবে তেমন কিছু তাকে বলিনি। শুধু দোয়া করার কথা বলি।
অবশেষে এক সময় আমরা বার্মিংহামে পৌছি। সেখানে গিয়ে দেখি তারা যে সমাবেশের আয়োজন করেছিলেন তা স্থগিত করা হয়ে গেছে। রাস্তাঘাটেও লোকজনের তেমন চলাচল নেই। সবখানেই কেবল সাদা বরফ। অনর উদ্দিন ভাই আমাদেরকে কিছুক্ষণ পর পর ফোন করে খবর নিচ্ছিলেন। একসময় আমি আমাদের বার্মিংহাম কমিটির সভাপতি আশরাফ উদ্দিনকে ফোন করি। সাথে সাথে জমি সংক্রান্ত একজন ভুক্তভোগী জুবায়ের ভাইকেও ফোন করি। আমরা পৌছে গেছি খবর শুনে তারাও চলে আসেন নার্সিং সেন্টারের সামনে। অনর উদ্দিন ভাই আসার পর আমরা সবাই একসাথে চলে যাই ভিকটিম শাহ আমিন নজরুলের রুমে। আমাদের যেহেতু তার সাথে পূর্ব থেকেই যোগাযোগ ছিল তাই তিনি বিছানা থেকে উঠে হুইল চেয়ারে বসেই অপেক্ষায় ছিলেন। আমাদের সাথে দেখা হওয়ার পর তিনি যে ভাষায় তার উপর নির্যাতনের কথা জানালেন তা ছিল এতই হৃদয় বিদারক, যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। শুধু ভাবলাম মানুষ কি এতই নিষ্ঠুুর হতে পারে। দেখতে পেলাম তার শরীরে ৫০টির মত আঘাতের চি? রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে মাথাসহ অন্যান্য স্থানে কয়েকটি আঘাত অত্যন্ত গুরুতর।
তিনি জানালেন এ সকল সন্ত্রাসী দা, ধারালো লম্বা অস্ত্র ও রড দিয়ে পিটিয়ে তাকে মাটিতে ফেলে দিয়ে যখন মনে করে যে, তিনি মরে গেছেন তখনই তারা চলে যায়। তিনি কান্না বিজড়িত কণ্ঠে বলেছিলেন যে, দেশে গিয়েছিলেন মায়ের মৃত্যুপরবর্তী চেহলাম (চল্লিশার মেজবান) অনুষ্ঠান করতে। কিন্তু তিনি নিজেই অবলীলায় সে পরিণতি বরণ করতে যাচ্ছিলেন। সে সময় তারা তার কাছ থেকে ৫লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে কিন্তু তিনি তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করার পর তার উপর নেমে আসে এ ধরণের বর্বরতা। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, এতবড় ঘটনার পর মামলা দায়ের করা হয় এবং আসামীদের গ্রেপ্তারও করা হয়। কিন্তু তারা জামিনে মুক্ত হয়ে এখন আবার তার পরিবার ও মামলার স্বাক্ষীদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। তার একটাই প্রশ্ন যে, তা হলেই কি প্রবাসীদের এভাবেই দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে ফিরে আসতে হবে। তার বক্তব্য শুনে আমরা তার কাছ থেকে এ সংক্রান্ত বিভিন্ন কাগজপত্র সংগ্রহের মাধ্যমে আমাদের সংগঠন হিউম্যান রইটস এন্ড পীস ফর বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় প্রেসিডেন্ট এডভোকেট মনজিল মোরসেদের সাথে আলোচনা করি। সাথে সাথে তাকে এ ব্যাপারে আইনগত সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করি।
আমরা যখন ফিরে আসি তখন রাত দশটা বাজে। সকাল দশটায় আমরা যাত্রা শুরু করেছিলাম। তাই এ দুর্যোগপূর্ণ অবস্থায় মোট বারো ঘন্টা অনবরত আমরা মানবতার সেবায় কাজ করতে পেরেছি বলে মনে কিছুটা তৃপ্তি পেলাম। আমার সহকর্মীরাও এতে আশ¡স্ত বলে জানালেন। তবে অনুজপ্রতিম সুয়েব কবিরকে তার সাহসিকতার জন্য ধন্যবাদ জানাতেই হয়। এ কঠিন যাত্রায় তারমধ্যে কোন ক্লান্তির ছাপ লক্ষ্য করিনি। বরং যাত্রা শেষে তার সহকর্মী রাজিবের প্রস্তুত করে রাখা জন্মদিনের কেক ভক্ষণ করেই যেন সে সেই ক্লান্তি দূর করার চেষ্টা করেছে। আমরা ফিরে আসার পর টেলিফোনে আমাদেরকে অনেকেই অভিনন্দন জানিয়েছেন। এ যেন যুদ্ধ জয়ের এক অভিযাত্রা। বার্মিংহামের অনর উদ্দিন, জুবের ভাই ও আশরাফ আমদসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ।
মোঃ রহমত আলী: সম্পাদক, মাসিক দর্পণ