কাল পবিত্র ঈদুল আজহা
প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫
মহান ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর মুসলিম উম্মাহর অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উত্সব ঈদুল আজহা আগামীকাল শুক্রবার। ‘ঈদুজ্জোহার চাঁদ হাসে ঐ এল আবার দুসরা ঈদ ! কোরবানী দে, কোরবানী দে, শোন খোদার ফরমান তাগিদ…’ কাজী নজরুল ইসলামের এই কাব্যসুর আকাশ-বাতাস মন্দ্রিত করে মনপ্রাণ উজালা করে তুলছে ঈদের আনন্দ-রোশনাইয়ে। আল্লাহপাকের প্রতি অপার আনুগত্য এবং তারই রাহে সর্বোচ্চ ত্যাগের এক ঐতিহাসিক ঘটনার স্মরণে মুসলিম বিশ্বে ঈদুল আজহা উদযাপিত হয়ে আসছে। মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর আত্মত্যাগ ও অনুপম আদর্শের প্রতীকী নিদর্শন হিসেবে কোরবানির রেওয়াজ। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নির্দেশে হযরত ইব্রাহিম (আ.) তাঁর প্রাণপ্রিয় পুত্র হযরত ইসমাঈল (আ.)-কে কোরবানি করতে উদ্যত হয়েছিলেন। এই অনন্য ঐতিহাসিক ঘটনার ধারাবাহিকতায় কোরবানি প্রচলিত হয়।
ইসলামের পরিভাষায় কোরবানি হলো- নির্দিষ্ট পশুকে একমাত্র আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশে নির্দিষ্ট সময়ে তারই নামে জবেহ করা। মহান সৃষ্টিকর্তার দরবারে জবাই করা পশুর মাংস বা রক্ত কিছুই পৌঁছায় না, কেবল নিয়ত ছাড়া। ঈদুল আজহার অন্যতম শিক্ষা হচ্ছে, মনের পশু অর্থাত্ কুপ্রবৃত্তিকে পরিত্যাগ করা। ‘মনের পশুরে কর জবাই পশুরাও বাঁচে, বাঁচে সবাই..’। পবিত্র হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী, প্রতি বছর জিলহজ মাসের দশ তারিখে বিশ্ব মুসলিম ময়দানে নামাজ আদায়ের পর যার যা সাধ্য ও পছন্দ অনুযায়ী পশু কোরবানি দিয়ে থাকেন। আরবি ‘আজহা’ এবং ‘কোরবান’ উভয় শব্দের অর্থ হচ্ছে উত্সর্গ। কোরবানি শব্দের উত্পত্তিগত অর্থ হচ্ছে আত্মত্যাগ আত্মোত্সর্গ নিজেকে বিসর্জন, নৈকট্য লাভের চেষ্টা ও অতিশয় নিকটবর্তী হওয়া ইত্যাদি।
সূরা হজে বলা হয়েছে, ‘‘এগুলোর গোশ্ত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, কিন্তু তোমাদের তাকওয়া পৌঁছে যায়।’’ আল্লাহর বান্দারা কে কতটুকু ত্যাগ ও খোদাভীতির পরিচয় দিতে প্রস্তুত এবং আল্লাহপাকের নির্দেশ পালন করেন তিনি তা-ই প্রত্যক্ষ করেন কেবল। প্রত্যেক আর্থিক সামর্থ্যবান মুসলমানের ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকার পরও কোরবানি দিলো না, সে যেন আমার ঈদগাহে না আসে’’ (মুসনাদে আহমদ)। আল কুরআনের সূরা কাউসারে বলা হয়েছে, ‘‘অতএব তোমার পালনকর্তার উদ্দেশ্যে নামাজ পড় এবং কোরবানি কর।’’ সূরা হজে বলা হয়েছে, ‘‘ কোরবানি করার পশু মানুষের জন্য কল্যাণের নির্দেশনা।’’
জিলহজ মাসের ১০, ১১ ও ১২ তারিখের যে কোন একদিন কোরবানি করা যায়। গরু, মহিষ, উট, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা এ শ্রেণির প্রাণী দ্বারা কোরবানি করা যায়। কোরবানিকৃত পশুর ৩ ভাগের ১ ভাগ গরীব-মিসকিন, একভাগ আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে বিলিয়ে দিতে হয়। আবার পুরোটাই বিলিয়ে দেয়া যায়। এদিকে ৯ জিলহজ ফরজ নামাজের পর থেকে ১৩ জিলহজ আসর পর্যন্ত প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর তাকবিরে তালবিয়া পাঠ করা ওয়াজিব। তালবিয়াহ হলো, ‘‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়ালিল্লাহিল হামদ।’’
কোরবানির ইতিহাস অতি প্রাচীন। সৃষ্টির প্রথম মানব আমাদের আদি পিতা হযরত আদম (আঃ) এর দু’পুত্র হাবিল ও কাবিল সর্বপ্রথম কোরবানি করেন। মহান আল্লাহ পাক ইব্রাহিম (আঃ) কে তাঁর শেষ বয়সে প্রিয়তম পুত্র ইসমাঈল (আঃ) কে কোরবানি করার নির্দেশ দেন। হযরত ইব্রাহিম (আঃ) ৮৫ বছর বয়সে হযরত ইসমাঈল (আঃ) কে পান। এ অবস্থায় ছেলেকে কোরবানি দেয়া এক কঠিন পরীক্ষা। কিন্তু তিনি তাঁর মহান রবের হুকুমে নত হলেন। নিষ্পাপ পুত্র ইসমাঈল (আঃ) ও নিজেকে আল্লাহর রাহে বিলিয়ে দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নেন। একপর্যায়ে পিতা তাঁর পুত্রকে জবাই করতে যখন উদ্যত ঠিক তখনই মহান আল্লাহর কাছে ঈমানের কঠিন পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হলেন।
হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর অনুপম ত্যাগের অনুসরণে হাজার হাজার বছর ধরে বিশ্ব মুসলমানরা কোরবানি করে আসছেন। তাঁরই নিদর্শনস্বরূপ প্রতিবছর হজ পালনকারীরা কোরবানি দিয়ে থাকেন।
হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম বলেছেন, লিকুল্লি কওমিন ঈদ, হা-যা ঈদুনা অর্থাত্ প্রত্যেক জাতির বাত্সরিক আনন্দ-ফূর্তির দিন আছে। এই দিনে ধনী-গরীব, বাদশা-ফকির নির্বিশেষে সব মুসলমান এক কাতারে ঈদের নামাজ আদায় করে, একে অপরের সঙ্গে কোলাকুলি করে। ঈদ সারাবিশ্বে মুসলিম উম্মাহর জাতীয় উত্সব। কাজী নজরুলের ভাষায়: ‘আজি আরাফাত ময়দান পাতা গায়ে গায়ে/কোলাকুলি করে বাদশাহ্-ফকিরে, ভায়ে ভায়ে’…
আজ থেকে ঈদুল আজহা উপলক্ষে তিনদিনের সরকারি ছুটি শুরু হয়েছে। ঈদকে সামনে রেখে জাতীয় দৈনিকগুলো বিশেষ আয়োজনে বের হয়েছে। বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার, সবক’টি বেসরকারি টিভি চ্যানেল ও এফএম রেডিও ঈদ উপলক্ষে কয়েক দিনব্যাপী বিশেষ অনুষ্ঠানমালা সম্প্রচার করছে। প্রতিবছরের মতো এবারও ঈদ উপলক্ষে রাজধানী ঢাকা ছেড়েছে লাখ মানুষ। ফলে রাজধানী অনেকটা ফাঁকা হয়ে গেছে।
দেশবাসীকে পবিত্র ঈদুল আজহার শুভেচ্ছা জানিয়ে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি এডভোকেট আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া এবং জাতীয় পার্টি জেপি চেয়ারম্যান ও পরিবেশ ও বন মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জুসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। ঈদুল আজহার দিন রাষ্ট্রপতি সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ ও আমন্ত্রিত অতিথিদের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করবেন। প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রে এবং বেগম খালেদা জিয়া লন্ডনে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করবেন। জাতীয় ঈদগাহে প্রধান জামাত অনুষ্ঠিত হবে।
পবিত্র ঈদের দিন রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও সড়ক দ্বীপমালা জাতীয় ও ‘ঈদ মোবারক’ খচিত পতাকায় সুশোভিত হবে। সকল সরকারি-বেসরকারি ভবনেও জাতীয় পতাকা ও ঈদ মোবারক খচিত পতাকা উত্তোলন করা হবে।
ঈদুল আজহা উপলক্ষে কেন্দ্রীয় কারাগারসহ দেশের সকল কারাগার, সরকারি হাসপাতাল, ভবঘুরে কেন্দ্র, বৃদ্ধাশ্রম ও শিশু ও মাতৃসদনে উন্নত খাবার পরিবেশন করা হবে।
রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ কোরবানির শিক্ষা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্যকে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে জাতীয় উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার আহ্বান জানিয়েছে। পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি দেশবাসীসহ বিশ্বের সকল মুসলিম ভাই-বোনদের ঈদুল আজহার শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। বাণীতে তিনি বলেন, আল্লাহর প্রতি গভীর আনুগত্য ও সর্বোচ্চ ত্যাগের মহিমায় সমুজ্জ্বল পবিত্র ঈদুল আজহা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পবিত্র ঈদুল আজহার মর্মবাণী অন্তরে ধারণ করে নিজ নিজ অবস্থান থেকে জনকল্যাণমুখী কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়ে বিভেদ-বৈষম্যহীন সুখী, সমৃদ্ধ ও শাস্তিপূর্ণ বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। ঈদুল আজহা উপলক্ষে দেয়া বাণীতে প্রধানমন্ত্রী দেশবাসী ও বিশ্বের সকল মুসলিম জনগোষ্ঠীকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও ঈদ মোবারক জানিয়ে বলেন, মহান আল্লাহর উদ্দেশে প্রিয়বস্তুকে উত্সর্গের মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টি লাভের যে অনুপম দৃষ্টান্ত হযরত ইব্রাহীম (আঃ) স্থাপন করে গেছেন, তা বিশ্ববাসীর কাছে চিরকাল অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় হয়ে থাকবে।