সুপ্রিম কোর্টকে হাতে নিতে চাচ্ছেন —অ্যাটর্নি জেনারেলকে প্রধান বিচারপতি
প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ মে ২০১৭
ঢাকা, ২৪ মে : প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের উদ্দেশে বলেছেন, অধস্তন আদালতকে কবজা করে নিয়ে নিচ্ছেন। এখন চাচ্ছেন সুপ্রিম কোর্টকে হাতে নিয়ে নিতে। বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে ন্যস্ত করে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল শুনানিতে প্রধান বিচারপতি এসব কথা বলেন।
প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বেঞ্চে গত মঙ্গলবার পঞ্চম দিনের মতো শুনানি হয়। আজ বুধবার শুনানির জন্য দিন রয়েছে। শুনানিতে অধস্তন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলা-সংক্রান্ত সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদের প্রসঙ্গও ওঠে। প্রধান বিচারপতি শুনানিকালে অ্যাটর্নি জেনারেলকে বলেন, ‘আপনি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা চান কি না।’ জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘অবশ্যই’। তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘অধস্তন জুডিশিয়ারি নির্বাহীর হাতে থাকলে তা কীভাবে হবে?’ অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘এটি তো অন্য বিষয়।’ প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘৮০ ভাগ বিচারক অধস্তন আদালতের। ওখানে কার্যত সুপ্রিম কোর্টের নিয়ন্ত্রণ নেই। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা বললে এই প্রসঙ্গটি আসবে।’
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট, অধস্তন আদালত পঙ্গু হয়ে গেছে এ কারণে বলতে বাধ্য হচ্ছি।’ অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘এটি ভিন্ন প্রসঙ্গ।’ প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘একটি জেলায় পাঁচ মাস ধরে জেলা জজ নেই। তাহলে বিচার বিভাগ কি রকম কার্যকর আছে? জেলা জজ না থাকলে বিচার বিভাগ কি কার্যকর হবে?’ জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘এটি আইন মন্ত্রণালয়ের (বিষয়)।’ প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনার জবাব হচ্ছে আইন মন্ত্রণালয়ের বিষয়। আর উচ্চ আদালতের বিষয়টি সংসদে নিয়ে গেলেন, তাহলে আর থাকল কী?’
শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, বাহাত্তরের সংবিধানে ৯৬ অনুচ্ছেদ যেভাবে ছিল, ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে সেভাবে নিয়ে আসা হয়েছে। সংবিধানের মূল বিধান ঠিক না বিচার বিভাগ (এটা) বলতে পারে না। তবে সংশোধনী সম্পর্কে বলতে পারেন।
শুনানির একপর্যায়ে প্রধান বিচারপতি ষোড়শ সংশোধনী বিল দেখাতে বলেন। এরপর অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থা সামরিক আইন জারির মাধ্যমে প্রবর্তন করা হয়েছে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নয়। ১৯৭২-এর মূল চেতনায় ফিরে যেতেই সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়েছে। পঞ্চদশ সংশোধনীর সঙ্গে যুক্ত করতে পারলে ভালো হতো। ‘মিস হওয়ায়’ দেশের স্বার্থে ওই সংশোধনী আনা হয়।
ষোড়শ সংশোধানী নিয়ে হাইকোর্টের রায়ে কিছু বিরূপ মন্তব্য রয়েছে বলে উল্লেখ করে অ্যাটর্নি জেনারেল শুনানিতে বলেন, ‘আশা করি এগুলো বাদ দেওয়া হবে।’ প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপত্তিকর কিছু থাকলে তা বিবেচনা করা হবে। একটি গণতান্ত্রিক সভ্য দেশে একটি কল্যাণকর রাষ্ট্র হিসেবে অনেক কিছু চিন্তা করে রায় দিতে হয়। মার্শাল লর (সামরিক আইন) কথা বলছেন? এখনো ১৯৮২ (মার্শাল ল আমলের) সালের আইন রয়ে গেছে। অথচ মার্শাল ল গেছে কবে। বিচার বিভাগ চিন্তাভাবনা করে, রাষ্ট্রের কাজে যাতে বিঘ্ন না ঘটে।’ শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী জনগণ সকল ক্ষমতার মালিক। এই চেতনা পুনর্বহালের জন্যই ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করা হয়েছে। সংসদ সদস্যরা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন। বিষয়টি এমন না যে, সংসদ সদস্যরা হাত তুললেই বিচারপতি অপসারিত হয়ে যাবেন। আইনে প্রক্রিয়া বলা আছে।’
শুনানিতে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে ভোট দিলে সংসদ সদস্যপদ থাকবে না, এমন বিধানসংবলিত সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের প্রসঙ্গও আসে। একপর্যায়ে প্রধান বিচারপতি অ্যাটর্নি জেনারেলের উদ্দেশে বলেন, ‘সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদ রেখেছেন কেন?’ জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘এর একটি ইতিহাস আছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে “হর্স ট্রেডিং” (দর-কষাকষি) হচ্ছে।’ প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনারা তাঁদের (সাংসদ) প্রতি আস্থা রাখতে পারছেন না? তাহলে বিচারকদের ক্ষেত্রে হর্স ট্রেডিং হবে না, এর নিশ্চয়তা কোথায়?’
শুনানির শেষ পর্যায়ে লিখিত বক্তব্য তুলে ধরে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘হাইকোর্টের রায়ে একজন বিচারপতি লিখেছেন বিরাট সংখ্যক সংসদ সদস্যের ফৌজদারি রেকর্ড রয়েছে। এটি সত্যি হলে তালিকা করে তাঁদের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। আর যদি সত্যি না হয় তাহলে যে বিচারপতি অভিযোগ এনেছেন, তাঁর ব্যাপারেও নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ রাষ্ট্রপতির কিছু করা উচিত।’ তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আইন না থাকলেও রাষ্ট্রপতি কি একজন বিচারপতিকে অপসারণ করতে পারেন?’ জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘এখন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থা নেই, আইনও নেই।’ প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘এটি কী বললেন? আইন না থাকলেও রাষ্ট্রপতি একজন বিচারপতিকে সরিয়ে দেবেন? কত হাজার বছর পেছনে নিয়ে যাচ্ছেন?’ জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘এটা আমার অভিমত। এ বিষয়ে রায়ে বলে দিতে পারেন।’ প্রধান বিচারপতি তাৎক্ষণিক বলেন, ‘আমরা উঠে যাচ্ছি।’ এরপর বেঞ্চের অপর বিচারপতিরা এজলাস ত্যাগ করেন। তখন এজলাসের ঘড়িতে সোয়া একটা। শুনানিকালে রিট আবেদনকারীদের পক্ষে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ ছাড়াও অ্যামিকাস কিউরিদের মধ্যে এম আমীর-উল ইসলাম, রোকন উদ্দিন মাহমুদ, এম আই ফারুকী ও ফিদা এম কামাল উপস্থিত ছিলেন।
বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাস হয়। ২২ সেপ্টেম্বর তা গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। এই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একই বছরের ৫ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের নয়জন আইনজীবী হাইকোর্টে রিট করেন। চূড়ান্ত শুনানি শেষে গত বছরের ৫ মে হাইকোর্টের তিন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিলের ওপর ৮ মে শুনানি শুরু হয়।