শনিবার ইস্ট লন্ডন মসজিদের লাইভ ফান্ড রেইজিং : ৩.৩ মিলয়ন পাউন্ডের ঋণ পরিশোধে সহযোগিতা কামনা
প্রকাশিত হয়েছে : ০৮ জুন ২০১৭
সন্ত্রাস মোকাবেলায় সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার অঙ্গীকার
দেশ রিপোর্ট: ৩.৩ মিলয়ন পাউন্ডের ক্বরজে হাসানা পরিশোধে কমিউনিটির সর্বস্তরের মানুষের আন্তরিক সহযোগিতা চাইলেন ইস্ট লন্ডন মসজিদ ও লন্ডন মুসলিম সেন্টারের নেতৃবৃন্দ। মসজিদকে ঋণমুক্ত করতে বিভিন্ন কর্মসূচির অংশ হিসেবে ১০ জুন শনিবার বিকেল ৩টা থেকে ফজর পর্যন্ত চ্যানেল এস টিভিতে অনুষ্ঠিত হবে বিশেষ ফান্ড রেইজিং অ্যাপিল। এতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে আসতে সকলের প্রতি আহবান জানানো হয়।
গত ৬ জুন মঙ্গলবার সন্ধ্যায় লন্ডন মুসলিম সেন্টারের সেমিনার হলে বিলেতের বাংলা মিডিয়ার সাংবাদিকদের সম্মানে আয়োজিত ইফতার মাহফিলপূর্ববর্তী সংবাদ সম্মেলনে এ আহবান জানানো হয়। এসময় মসজিদ পরিচালনা কমিটির নেতৃবৃন্দ গত সপ্তাহে লন্ডন ব্রিজে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে নিহতদের পরিবার-পরিজনের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন এবং চিকিৎসাধীন ব্যক্তিদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করেন। মসজিদ কমিটির নেতৃবৃন্দ বলেন, সন্ত্রাসী, সন্ত্রাসীই। সন্ত্রাসীর কোনো ধর্ম নেই। যারাই সন্ত্রাস করে সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করতে চায় তাদের প্রতিহত করা আমাদের সকলের দায়িত্ব। সন্ত্রাস প্রতিরোধে আমরা সকলের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করবো। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ইস্ট লন্ডন মস্ক ও লন্ডন মুসলিম সেন্টারের সেক্রেটারি আইয়ূব খান। বক্তব্য রাখেন চেয়ারম্যান মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, নির্বাহী পরিচালক দেলওয়ার খান, ট্রাস্টি ড. মোহাম্মদ আব্দুল বারী, ইমাম ও খতীব শায়খ আব্দুল কাইয়ূম ও ট্রেজারার মুহাম্মদ আব্দুল মালিক। শুরুতে পবিত্র কুরআন থেকে তেলাওয়াত করেন মিশর থেকে আগত খ্যাতনামা হাফিজ শায়খ আহমদ রাজাব।
লিখিত বক্তব্যে মসজিদের বহুমুখী কার্যক্রমের বর্ণনা তুলে ধরে বলা হয়, প্রতিবারের মতো এবারও তারাবিহের নামাজের জন্য এসেছেন বিদেশী হাফিজগণ। এবার মদীনা শরীফ থেকে এসেছেন প্রখ্যাত আলেম শায়খ সাউদ নাফি আল আনাজী। তিনি রিয়াদের ইমাম মুহাম্মদ সাউদ ইসলামিক ইউনিভার্সিটি থেকে শরীয়াহ শাস্ত্রে উচ্চতর ডিগ্রীধারী। মিশর থেকে এবার চতুর্থবারের মতো এসেছেন হাফিজ আহমদ রাজাব। রয়েছেন সোমালী বংশোদ্ভুত বৃটিশ হাফিজ ক্বারী জামাল মোহাম্মদ এবং মিশর থেকে ইসলামি শাস্ত্রে ডিগ্রীধারী ইস্ট লন্ডন মসজিদ পরিচালিত আল-মিজান ও লন্ডন ইস্ট একাডেমীর প্রাক্তণ ছাত্র মোহাম্মদ সাকির আহমদ। এছাড়াও রয়েছেন মসজিদের নিয়মিত ইমাম হাফিজ আবু তাইয়্যেব।
প্রতি বছরের মতো এবারও থাকছে ইতফারের আয়োজন। প্রতিদিন ৬শ মানুষ লন্ডন মুসলিম সেন্টারের গ্রাউন্ড ফ্লোরে ইফতার করে থাকেন। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা এই ইফতার স্পনসর করে থাকেন। জনপ্রতি দুই পাউন্ড করে অথবা পুরো একদিনের ইফতার ১২শ পাউন্ড দান করে এই ইফতার স্পনসর করা যায়। রামাদ্বানের শেষ ১০ দিনে ১০০ মানুষের ই’তেকাফের জন্য সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। এসব ছাড়াও প্রতিদিন আসরের নামাজের পর বিভিন্ন ধরনের ইসলামিক আলোচনা চলছে। মসজিদের ইমামগণ ছাড়া বিভিন্ন ইসলামিক স্কলার রামাদ্বান সম্পর্কে গুরুত্বপুর্ণ বয়ান পেশ করে থাকেন।
লিখিত বক্তব্যে আরো বলা হয়, ইস্ট লন্ডন মসজিদ ও লন্ডন মুসলিম সেন্টার পরিচালনায় দৈনিক মোটা অংকের অর্থ ব্যয় হয়ে থাকে। উপরন্তু মারিয়াম সেন্টার প্রতিষ্ঠা ও সিনাগগ ভবন ক্রয় বাবদ এখনও ৩.৩ মিলিয়ন পাউন্ড ক্বরজে হাসানা বাকি রয়েছে। এই ঋণ পরিশোধে বিভিন্নভাবে ফান্ডরেইজিং অব্যাহত রয়েছে। গত ২৯ এপ্রিল দ্বিতীয়বারের মতো অনুষ্ঠিত হয়েছে রাইড ফর ইউর মস্ক। এই ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে ৮ হাজারেরও বেশি ফান্ডরেইজ করা সম্ভব হয়েছে। আগামী ১৭ সেপ্টেম্বর রোববার পূর্ব লন্ডনের ভিক্টোরিয়া পার্কে অনুষ্ঠিত হবে ৬ষ্ঠ মুসলিম চ্যারিটি রান। এরপর হবে ইস্ট লন্ডন মস্ক ফুটবল টুর্নামেন্ট ২০১৭। বছরজুড়ে বিভিন্ন কর্মতৎপরতা অব্যাহত থাকবে।
এবারের ফান্ডরেইজিংয়ে ইস্ট লন্ডন মসজিদ নতুন কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তা হলো:
মসজিদ পরিচালনা ব্যয়, ওয়াকফ বা ল্যাগেসি ডনেশন ও আজীবন ক্বরজে হাসান। এই তিনটি নতুন উদ্যোগের বিস্তারিত তথ্য সংক্ষেপে তুলে ধরা হয়।
এক. মসজিদ পরিচালনা ব্যয়: মসজিদ পরিচালনায় পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা, মেরামত-রক্ষনাবেক্ষণ ও নিরাপত্তা এই ছয়টি খাতে বেশি অর্থ ব্যয় হয়ে থাকে। তাই এই খাতগুলোতে পৃথক পৃথক ডনেশন আহবান করা হয়েছে। যেমন প্রতিদিন মসজিদের পানি ব্যবস্থাপনা বাবদ ৭৫ পাউন্ড, গ্যাস সরবরাহে ১০০ পাউন্ড, বিদ্যুৎ বাবদ ৩০০ পাউন্ড, মেরামত-রক্ষনাবেক্ষণ বাবদ ৩৭৫ পাউন্ড, সিকিউরিটি বাবদ ২৭৫ পাউন্ড এবং পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা বাবদ ৭০০ পাউন্ড ব্যয় হয়ে থাকে। কেউ যেকোনো একটি খাতে একদিনের খরচ বহন করতে পারেন। আবার উক্ত ছয়টি খাতে একদিনের খরচ এক সাথেও দিয়ে দিতে পারেন। এক্ষেত্রে ছয়টি খাতের জন্য ১,৮২৫ পাউন্ড দান করতে পরবেন।
দুই. আজীবন ক্বরজে হাসানা: বিগত দিনগুলোতে স্বল্প মেয়াদী ক্বরজে হাসানা সংগ্রহ করা হয়েছিলো। এবার ‘আজীবন ক্বরজে হাসানা’ চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। উদাহরণসরূপ, কেউ তাঁর মৃত্যুর পর দাফন-কাফনের জন্য ৪ থেকে ৫ হাজার পাউন্ড ইস্ট লন্ডন মসজিদে ক্বরজে হাসানা হিসেবে জমা রাখতে পারবেন। দাতা ব্যক্তির ইন্তেকালের পর জমাকৃত অর্থ দিয়ে তাঁর ফিউনারেল সার্ভিসের খরচ আদায় করা যেতে পারে, নতুবা পরিবারের কাছে জমাকৃত অর্থ ফেরত দেওয়া হবে।
তিন: ওয়াকফ বা ল্যাগেসি ডনেশন : মসজিদের জন্য কোনো সম্পদ উৎসর্গ করে দেওয়াকে আরবীতে ওয়াকফ বলা হয়ে থাকে। বাংলাদেশে এই পদ্ধতির দান জনপ্রিয় ও বহুলপ্রচলিত। লন্ডনে এই প্রথম ওয়াকফ পদ্ধতি চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে ইস্ট লন্ডন মসজিদ। এই পদ্ধতিতে বিত্তবান মানুষ নিজেদেরকে মসজিদের সাথে সম্পৃক্ত করতে পারবেন। যেমন: যিনি একাধিক বাড়ি-ঘর কিংবা দোকানের মালিক তিনি চাইলে মসজিদের নামে একটি প্রপার্টি ওয়াকফ বা উৎসর্গ করে দিতে পারেন। মসজিদ এটি বিক্রি করতে পারবে না, তবে ওয়াকফকৃত ঘর-বাড়ি থেকে প্রাপ্ত ভাড়া মসজিদের কাজে লাগাবে। যিনি সম্পদ দান করবেন তিনি মৃত্যুর পরও সাদকায়ে জারিয়ার সওয়াব পেতে থাকবেন। এই তিনটি পদ্ধতিতে ফান্ডরেইজ করে মসজিদকে ঋমুক্ত করার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
লিখিত বক্তব্যে আরো বলা হয়, ইস্ট লন্ডন মসজিদে আল-মিজান প্রাইমারি স্কুল ও লন্ডন ইস্ট একাডেমী নামে দুটো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয়ে আসছে। দুটো স্কুলই প্রতি বছর ভলো ফলাফল করছে। সাফল্যের ধারাবাহিকতায় আল-মিজান স্কুলে এ বছর থেকে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েদেরকে ভর্তির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। তৃতীয় শ্রেনী থেকে ৬ষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত মেয়েরা ভর্তি হতে পারবেন। অফস্ট্যাড এর শর্তাবলী পুরণ করতে পারায় মেয়েদের ভর্তির সুযোগ হয়েছে। মসজিদের নিরাপত্তা প্রসঙ্গে লিখিত বক্তব্যে আরো বলা হয়, বর্তমান সময়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের কোথাও কোনো সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটলে ইসলাম বিদ্বেষী হামলার ঘটনা ঘটতে শুরু হয়। ইস্ট লন্ডন মসজিদ যেহেতু বৃটেনের সবচেয়ে বড় মসজিদ এবং এখানে মানুষের যাতায়াতও অনেক বেশি তাই নিরাপত্তার ঝুঁকিও থাকে বেশি। তাই বার্ষিক প্রায় ১শ হাজার পাউন্ড ব্যয়ে চবিবশ ঘণ্টা সিকিউরিটির ব্যবস্থা করা হয়েছে। ৭ জন দক্ষ ও প্রশিক্ষিত সিকিউরিটি গোটা মসজিদের নিরাপত্তা রক্ষায় সার্বক্ষনিক নিয়োজিত রয়েছেন।
লিখিত বক্তব্যে আরো বলা হয়, ইস্ট লন্ডন মসজিদের কার্যক্রম দেশে বিদেশে প্রশংসিত হয়ে আসছে। বিভিন্ন সময় বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এই মসজিদ পরিদর্শনে এসে মসজিদের কার্যক্রম দেখে অভিভূত হয়েছেন। ২০০১ ও ২০০৪ সালে প্রিন্স চার্লস দুই বার মসজিদ পরিদর্শনে আসেন। বিভিন্ন সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি, এমপিসহ রাস্ট্রের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবর্গ মসজিদ পরিদর্শন করতে আসেন। বৃটেনের সব সরকারের সময়ই মন্ত্রী ও এমপিগণ নিয়মিতই মসজিদ পরিদর্শনে আসেন। অতি সম্প্রতি মসজিদ পরিদর্শনে আসেন বৃটেনের রানীর একমাত্র কন্যা প্রিন্সেন্স এ্যান। তিনি প্রায় দুই ঘণ্টা মসজিদে অবস্থান করে মসজিদের বিভিন্ন কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে অভিভূত হন। এসময় তিনি তাঁর বিভিন্ন প্রজেক্টের সাথে মসজিদের প্রজেক্টের সমন্বয় সাধন করে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এভাবেই বিভিন্নভাবে মসজিদের কার্যক্রম তুলে ধরার চেষ্টা চলছে। উল্লেখ্য, সংবাদ সম্মেলনে বিলেতের বাংলা প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার অর্ধশতাধিক সাংবাদিক অংশগ্রহণ করেন।