ওয়েস্ট লন্ডনে স্মরণকালের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড : ২৪ তলা ভবন পুড়ে কঙ্কাল
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ জুন ২০১৭
দেশ রিপোর্ট: ওয়েস্ট লন্ডনে লাটিমার রোডস্থ গ্রেনফিল টাওয়ারে স্মরণকালের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে বৃহস্পতিবার গভীর রাতে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত কমপক্ষে ৩০ জন নিহত হয়েছেন। আহত অবস্থায় ৭০ জনকে উদ্ধার করে লন্ডনের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ১৮ জনের অবস্থা আশংকাজনক। পুলিশ জানিয়েছে হতাহতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে। পুড়েযাওয়া টাওয়ারে চারটি বাঙালি পরিবার বাস করতো। এই চার বাঙালি পরিবারের অনেকেই এখনও নিখোঁজ রয়েছেন। তাদের মধ্যে মৌলভী বাজারের একাটুনা ইউনিয়নের অধিবাসী কমরু মিয়ার ৫ সদস্যের পরিবার মতূ্যবরণ করেছেন বলে পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে।
ওয়েস্টমিনস্টার, মানচেস্টার ও লন্ডন ব্রিজে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনার পর গ্র্যানফিল টাওয়ারের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় লন্ডনের মানুষ বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। শোকে স্তব্ধ গোটা লন্ডনবাসী। লন্ডন মেয়র সাদিক খান এটাকে ‘অত্যন্ত ভয়াবহ ঘটনা’ বলে উল্লেখ করেছেন।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, গ্রেটার লন্ডনের সবচেয়ে ধনী বারা কেনসিংটন এণ্ড চেলসির গ্র্যানফিল টাওয়ার থেকে মঙ্গলবার দিবাগত রাত (বুধবার ভোর) আনুমানিক ১২টা ৫৪ মিনিটে ফায়ার সার্ভিসে কল করা হয়। ২৪ তলার এই ভবনে ১২০টি ফ্ল্যাটে প্রায় ৬০০ মানুষের বসবাস। আগুন লাগার সময় কেউ ঘুমাচ্ছিলেন, কেউ সিটিংরুমে বসে টিভি দেখছিলেন। মুসলিম কমিউনিটির বেশির ভাগ মানুষই তখন তারাবিহের নামাজে ছিলেন। আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার পর যে যেভাবে পারেন প্রাণ রক্ষার চেষ্টা করেছেন। কেউ ঝাঁপ দিয়েছেন ১৫ তলা ভবন থেকে। কেউ চিৎকার করে প্রাণ রক্ষার জন্য অর্তনাদ করেছেন। কেউ বাচ্চাদের ছুঁড়ে ফেলেছেন বহুতল ভবনের বিভিন্ন তলা থেকে। কেউ মোবাইলে কল করে, ট্যাক্স ম্যাসেজ করে বিদায় নিয়েছেন স্বজনদের কাছ থেকে।
গ্রেনফিল টাওয়ারের সাত তলার বাসিন্দা পল মুনাকর কোনোরকমে ভবন থেকে বাইরে বের হয়ে আসেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বিবিসিকে বলেন, ‘আমরা যখন সিড়ি দিয়ে নামছিলাম তখন দেখলাম দমকলকর্মীরা ওপরে উঠছে। তারা আগুনের মধ্যে ঢুকে যেভাবে পারছে মানুষকে বের করে আনার চেষ্টা করছে’। তিনি জানান, ভবনে যে আগুন লেগেছে সেটা কিন্তু তিনি ফায়ার অ্যালার্মের মাধ্যমে বুঝেন নি। রাস্তায় থাকা মানুষেরা চিৎকার করে বলছিল ‘ঝাঁপ দিও না, ঝাঁপ দিও না’ তখন তিনি বুঝতে পারেন যে ভবনে আগুন লেগেছে। তিনি বলেন, ‘আগুন থেকে বাঁচার জন্য কত মানুষ নিচে ঝাঁপ দিয়েছে আমি জানি না । কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এটাই যে, ভবনের ফায়ার অ্যালার্ম বাজেনি’।
অন্যদিকে জর্ডি মার্টিন নামে গ্র্যানফিল টাওয়ারের এক প্রতিবেশী জানান, আগুন দেখার পর প্রথমে তিনি দৌড়ে ভবনটির কাছে গিয়ে বাসিন্দাদের বেরিয়ে আসতে চিৎকার করতে থাকেন। তিনি বলেন, ‘আমি একজনকে পড়ে যেতে দেখেছি, শিশু কোলে এক নারীকে দেখেছি জানালার ধারে চিৎকার করছিল।’
‘আমি সবাইকে বাইরে বের হতে বললেও ভবনে আটকে থাকা লোকজন চিৎকার করে বলছিলেন তাদের বাইরে বের হওয়ার কোনো উপায় নেই। কারণ তখন করিডোরের ভেতরটা পুরোটা ধোঁয়ায় ভরে গিয়েছিল।’
অন্যদিকে বিবিসির সংবাদদাতা অ্যান্ডি মুর বলেন, ‘ভবন থেকে ধ্বংসাবশেষ পড়তে দেখছি। আমরা বড় বিস্ফোরণের শব্দও শুনেছি। কাঁচ ভাঙার শব্দও পেয়েছি।’
জর্জ ক্লার্ক নামের একজন প্রত্যক্ষদর্শী বিবিসি রেডিও ফাইভকে জানিয়েছেন, ‘আমার সারা গায়ে ছাই লেগে গেছে। আগুনটা কত ভয়াবহ হতে পারে চিন্তা করুন।’‘আমি প্রায় ১০০ মিটার দূরে এবং পুরোপুরি ছাইয়ে ঢেকে গেছি।’ তিনি বলেন, ‘এটা অত্যন্ত মর্মান্তিক ঘটনা। আমি দেখেছি ভবনের উপরের দিকে কেউ টর্চ জ্বালাচ্ছিল। তারা অবশ্যই বের হতে পারেনি। হয়তো তারা বেঁচে নেই। বিবিসির সাইমন লেডারমেন জানান, ‘ভবনটি যেভাবে জ্বলছে, তা কয়েক মাইল দূর থেকেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।’
লন্ডন ফায়ার ব্রিগেডের অ্যাসিস্টেন্ট কমিশনার ডেন ডেলি বলেছেন, ‘পরিস্থিতি ভয়াবহ। এমন জটিল পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করছেন দমকলকর্মীরা।’
৪০টি ফায়ার ইঞ্জিন নিয়ে প্রায় ২০০ ফায়ার সার্ভিস অফিসার এবং ২০টি এম্বুল্যান্স রাত থেকে আগুন নিয়ন্ত্রনে আনার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
জানা গেছে, ২০১৬ সালের জুনে ফায়ার রিস্ক এসেসমেন্ট করা হয় এই ভবনে। গত বছর প্রায় ১০ মিলিয়ন পাউন্ডের সংস্কার করা হয়।
আগুনে পুয়ে যাওয়া ভবনটি নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারের মতো ধ্বসে যাবে বলে আশংকা করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। ঘটনার পর থেকে নর্দার্ন রাউন্ডবাউট থেকে মার্লিবোন পর্যন্ত রোড বন্ধ রয়েছে। তাছাড়া লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ডের হ্যামারস্মিথ এবং সিটি অ্যান্ড সার্কেল লাইন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
৫ সদস্যের বাঙালি পরিবার : ২৪তলা বিশিষ্ট গ্রেনফিল টাওয়ারের ১৪২ নম্বর ফ্ল্যাটে বসবাস করতেন মৌলভীবাজার জেলার একাটুনা ইউনিয়নের অধিবাসী বয়োবৃদ্ধ কমরু মিয়া, তাঁর স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়ে। কমরু মিয়ার ভাতিজা চেলসি এলাকার বাসিন্দা আবদুর রহিম বুধবার মিডিয়াকে জানান, মঙ্গলবার দিবাগত রাতে আগুন লাগার পর চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে টেলিফোনে তার শেষ কথা হয়। তখন তিনি বাঁচার আকুতি জানাচ্ছিলেন। ‘রাত আড়াইটার দিকে তানিমার (হাসনা বেগম তানিমা) সঙ্গে কথা হয়। তার আকুতি এখনও আমার কানে ভাসে। সে বলছিল, ‘আমরা সবাই এখন বাথরুমে, আমাদের বের হওয়ার কোনো উপায় নেই, দোয়া করেন আমাদের যেন কষ্টে মৃত্যু না হয়’।’
৯০ বছর বয়সী কমরু মিয়া বছর দিন আগে সপরিবারে গ্র্যানফিল টাওয়ারে বসবাস শুরু করেন বলে জানান রহিম।
কমরু মিয়ার বড় ছেলে আব্দুল হাকিম স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে আলাদা থাকেন। অন্য দুই ছেলে আব্দুল হামিদ, আব্দুল হানিফ ও মেয়ে তানিমা বাবা-মার সঙ্গে থাকেন।
তাদের কারও মোবাইল ফোনে রাত আড়াইটার পর থেকে আর যোগাযোগ করা যাচ্ছে না বলে জানান রহিম।
‘চাচাত ভাই হাকিমকে নিয়ে রাত থেকে টাওয়ারের নিচে ছিলাম। পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেও এখন পর্যন্ত কোনো খবর পাননি বলে জানান রহিম । বৃহস্পতিবার পারিবারিক সুত্রে জানা যায়, কমরু মিয়ার ৫ সদস্যের পরিবার আগুনে পুড়ে মারা গেছেন।