ঘরে-বাইরে বিপাকে থেরেসা মে : আরেকটি নির্বাচন কি আসন্ন?
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ জুন ২০১৭
দেশ ডেস্ক : ওয়েস্ট লন্ডনে গ্রেনফিল টাওয়ারের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ঝুলে গেলো থেরেসা মে’র সরকার গঠনের কোয়ালিশন প্রক্রিয়া। ১৩ জুন ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নিস্ট পার্টির সাথে কনজার্ভেটিভের চুড়ান্ত আলোচনা হওয়ার কথা ছিলো। কিন্ত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এই আলোচনা পিছিয়ে গেলো। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী সপ্তাহের আগে আর আলোচনার সুযোগ নেই। তাছাড়া কোয়ালিশন প্রক্রিয়ায় যত বেশি দেরি হবে রাণীর ভাষণ আসতেও তত দেরি হবে। রাণীর ভাষণ আসতে আরো কয়েক সপ্তাহ দেরি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে । আর রাণীর ভাষণ যত দেরি হবে ততই ব্রেক্সিট নিয়ে আলোচনাও বিলম্বিত হবে।
এদিকে আত্মবিশ্বাসী করবিন বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমি মনে করি এ বছরেই বা আগামী বছরের শুরুর দিকে আরেকটি নির্বাচনের সম্ভবনা রয়েছে। আমরা অস্থিতিশীলতার মধ্যে চলতে পারি না। আমাদের একটা কার্যক্রম রয়েছে, সমর্থন রয়েছে আর আমরা যত দ্রুত সম্ভব আরেকটি নির্বাচনী লড়াই করতে প্রস্তুত।’ করবিন আরো বলেন, আমরা যেসব এজেন্ডা প্রস্তাব করেছি তার ভিত্তিতে এ দেশের জনগণের সেবা করতে চাই। আমাদের এজেন্ডাগুলো সংস্কারমূলক এবং তার অসাধারণ সমর্থন অর্জন করেছে।’
এদিকে ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড সানডে মিররকে এক সাক্ষাতকারে জেরেমি করবিন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, সত্যিই এখনো সম্ভাবনা আছে। আমি এখনো প্রধানমন্ত্রী হতে পারি।
সবকিছু মিলিয়ে থেরেসা মে এখন কঠিন সময় পার করছেন। তাঁর ঘরেও আগুন এবং বাইরেও আগুন। কোনোমতে প্রধানমন্ত্রিত্ব আঁকড়ে ধরে আছেন তিনি। বৃটিশ গণমাধ্যমগুলো বলছে, মে’র ক্ষমতা ঝুলে আছে এক সুতোয়। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সরকার গঠনের জন্য নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডভিত্তিক ডিইউপি’র সঙ্গে সমঝোতায় উপনীত হতে পারেনি কনজারভেটিভরা। মে’র মন্ত্রিসভা তাকে খোলামেলা সতর্কবার্তা দিয়েছেন যে অবস্থান পালটাতে হবে। নির্বাচনে ভরাডুবির পর টোরিদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। কয়েকজন সাবেক মন্ত্রী খোলস থেকে বের হয়ে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। বলেছেন, ধার করা সময়ে দিন কাটাচ্ছেন মে। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নিকি মরগান বলেন, নতুন প্রধানমন্ত্রী বেছে নিতে হবে। সাবেক চ্যান্সেলর জর্জ অসবর্ন মে’কে ডেড ওম্যান ওয়াকিং আখ্যা দিয়েছেন। ওদিকে, দলের কয়েকজন এমপি বরিস জনসনকে প্রধানমন্ত্রিত্ব অর্জনের লড়াইয়ে নামার আহ্বান জানিয়েছেন। বিরোধী লেবার দলের নেতা জেরেমি করবিন সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, আরেকটি নির্বাচনে লড়ার জন্য প্রস্তুত তিনি। এমনকি মে’র একান্ত বিশ্বস্ত প্রতিরক্ষামন্ত্রী স্যার মাইকেল ফ্যালনও প্রধানমন্ত্রীকে সতর্ক করেছেন। তিনি ও তার সিনিয়র সহকর্মীরা মে’কে স্পষ্ট বার্তা দিয়ে বলেছেন যে, টিকে থাকতে হলে ভিন্নভাবে এগোতে হবে।
ডিইউপি’র সঙ্গে জোট বেঁধে সরকার গঠন করার চেষ্টা জটিল আকার ধারণ করেছে। দলটির সঙ্গে এখনো কোনো সমঝোতাই করতে পারে নি কনজারভেটিভ শিবির।
এদিকে, কনজারভেটিভ পার্টির তৃণমূল ৬০ ভাগ সমর্থক তেরেসার পদত্যাগ দাবি করেছেন। ডাকা হয়েছে ‘ব্যাকবেঞ্চার ১৯২২’ কমিটির মিটিং। কমিটির চেয়ারম্যান মি. গ্রাহাম ব্রেডি বলেন, এখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর সব বিষয় নিয়ে দলীয় এমপিদের সঙ্গে কথা বলা।
উল্লেখ্য, সংসদে পেছনের সারির এমপি বা যারা সরকারের পদে নেই তাদের বলা হয়ে থাকে ব্যাকবেঞ্চার। দলের ওয়েবসাইটে এ পদত্যাগ দাবি করা হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টার মধ্য ১৫০৩ কর্মী তাদের মতামত ব্যক্ত করেছেন। এরমধ্য ৮৯৪ জন বা ৬০ ভাগ কর্মী প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছেন। ৮ই জুনের নির্বাচনের পর থেকেই দলের সিনিয়র নেতাদের তোপের মুখে প্রধানমন্ত্রী। তারা বলেছেন, তেরেসা মে এখন অন্তর্বর্তীকালীন নেতা। তার চলে যাওয়াটাই দল এবং তার জন্য উত্তম। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী স্বেচ্ছায় পদত্যাগ না করে দলীয় এমপিরা বিশেষ করে ব্যাকবেঞ্চার এমপিরা, ব্যাকবেঞ্চার ১৯২২ কমিটির চেয়ারম্যান মি. গ্রাহাম ব্রেডির কাছে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি তাদের নো-কনফিডেন্স প্রকাশ করে ভোট দাবি করতে পারেন। আর তা করতে মাত্র ১৫ ভাগ এমপি বা ৪৮ জনের সমর্থন প্রয়োজন। উল্লেখ্য, বৃটিশ রাজনীতিতে দলীয় ব্যাকবেঞ্চার বা পেছনের সারির এমপিদের সংসদে খুবই প্রভাব। তারা অনেক সময় সরকারের কোনো সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভোট দিয়ে থাকেন।
এখন দেখার বিষয় থেরেসা মে কতক্ষণ এ অবস্থায় টিকতে পারেন। জর্জ অসবর্ন বলেন, খুব অল্প সময়ের মধ্য আমরা সবকিছু জানবো। হয়তো আগামী সপ্তাহের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর বিপর্যয় দেখতে পাবো। বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের অখ্যাত দল ডিইউপি’র সঙ্গে জোট করে সরকার গঠনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। তবে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে নানা টানাপড়েন দেখা দিয়েছে।
ওদিকে, লেবার প্রধান জেরেমি করবিনের বৃহস্পতি এখন তুঙ্গে। ৮ই জুনের নির্বাচনে বাজিমাত করেছেন। সরকার গঠনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকলেও আগের পার্লামেন্টের তুলনায় ৩০টি আসন বেশি পেয়ে অত্যন্ত জোরালো অবস্থানে আছেন তিনি। নতুন খবর হলো নির্বাচনের পর এক জরিপে দেখা গেছে, লেবার পার্টি এখন ৬ পয়েন্ট এগিয়ে গেছে কনজারভেটিভদের থেকে। মেইল অন সানডে’র এক জরিপে দেখা যায়, ৪৫ ভাগ ভোটার সমর্থন করছেন লেবারকে এবং ৩৯ ভাগ সমর্থন করছেন কনজারভেটিভকে।
এদিকে, গত ২৪ ঘণ্টায় ৫ লাখ ৩ হাজার ৮৮০ বৃটিশ অনলাইনে এক পিটিশন করেছে কনজারভেটিভ পার্টির প্রতি। তারা তেরেসা মে’র পদত্যাগ দাবি করেছেন। তারা বলেছেন, তেরেসা মে নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন না পেয়েও ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নিস্ট পার্টির সঙ্গে জোট করাটা হবে বিপর্যয়কর। উল্লেখ্য, ৮ই জুনের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন (কনজারভেটিভ) ৩১৮টি আসন পায়। যা সরকার গঠনের চেয়ে ৮টি আসন কম। নির্বাচনে টোরিদের বেশ ক’জন শীর্ষ নেতা আসন হারান। নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর থেকেই চাপের মুখে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নিস্ট পার্টির সঙ্গে জোট করার ঘোষণা দিয়ে সরকার গঠনের কথা বললেও কনজারভেটিভ দলের মন্ত্রী-এমপিরা এমনকি তৃণমূল কর্মীরাও তেরেসা মে’কে আর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চাইছেন না। তারা প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর। আর নির্বাচনের ফল ঘোষণা শুরু হওয়ার পর থেকে বিরোধী দল লেবারসহ প্রায় সবক’টি বড় রাজনৈতিক দল প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছেন। লেবার প্রধান জেরেমি করবিন ঘোষণা দিয়েছেন তিনি একটি কার্যকরী সরকার গঠনের জন্য প্রস্তুত রয়েছেন। কয়েক মাসের মধ্যেই মে আরেকটি নির্বাচনের মুখোমুখি হতে বাধ্য হবেন বলেও পূর্বাভাস দিয়েছেন তিনি।
যে ব্রেক্সিট সমঝোতাকে সামনে রেখে পার্লামেন্টে আরো বড় সংখ্যাগরিষ্ঠতার আশায় আগাম ভোটের ডাক দিয়েছিলেন মে তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। কনজারভেটিভ দলের বর্ষীয়ান নেতা লর্ড হেসেলটাইন বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী মে’কে এখন কঠোর (হার্ড) ব্রেক্সিটের ধ্যান-ধারণা বাদ দিতে হবে। ইউরোপ ইস্যুকে কনজারভেটিভ দলের হৃদয়ে বেড় ওঠা ক্যানসার আখ্যা দিয়েছেন তিনি। সেই সঙ্গে সরকার গঠনে অনিশ্চয়তা প্রধানমন্ত্রীর নতুন মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডিইউপির ১০ এমপির সমর্থন নিয়ে কোনোমতে বৈতরণী পার করার আশা বুনছেন তিনি। তাতে কতটা সফল হবেন তা দেখতে বৃটিশদের পাশাপাশি অপেক্ষায় রয়েছে ইউরোপসহ আন্তর্জাতিক মহল। কিন্তু, প্রধানমন্ত্রিত্ব টিকিয়ে রাখাই দায় হয়ে পড়েছে মে’র। গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য মাঠে নামতে পারেন বরিস জনসন। দলের একাংশ তাকে এজন্য সমর্থনও দিয়েছেন। নাটকীয় নির্বাচনের পর ক্ষণে ক্ষণে রং বদলানো বৃটিশ রাজনীতি এখন কোনদিকে মোড় নেবে সেদিকেই সবার চোখ।