বৃটেনজুড়ে নির্মল ঈদ উদযাপন : মাইল এন্ড পার্ক ছিলো ক্ষনিকের ঈদগাহ ময়দান
প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ জুন ২০১৭
দেশ রিপোর্ট: শঙ্কা ও উদ্বেগের মধ্য দিয়ে কঠোর নিরাপত্তায় রোববার (২৫ জুন) পবিত্র ঈদুল ফেতর উদযাপন করলেন বৃটেনের ৩০ লক্ষাধিক মুসলমান। আলোকোজ্জল দিনটি নির্মল আনন্দ উদযাপনের জন্য ছিলো চমৎকার। দেশজুড়ে মুসলমানগন নির্মল আনন্দ উদযাপন করেছেন । কিন্তু একটি দূর্ঘটনা নির্মল আনন্দে খানিকটা ভাটা ফেলে দেয়। কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে সারাদেশে ঈদ উদযাপিত হলেও নিউক্যাসেলে একটি গাড়ি দূর্ঘটনায় ৩ শিশুসহ ৬জন মুসলমান গুরুতর জখম হয়েছেন। ৪২ বছর বয়সী এক মুসলিম মহিলা নিয়ন্ত্রন হারিয়ে গাড়িচাপা দেন পার্কে ঈদের নামাজ পড়তে আসা একদল মুসল্লিকে। আহতদের মধ্যে ১শিশুর অবস্থা গুরুতর । গাড়িচাপায় রক্তাক্ত হওয়া শিশুটির ভিডিও সোস্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। ভিডিওটি দেখলে গা শিউরে ওঠে। বিবিসি প্রথমে এটি একটি হামলা বলে সংবাদ প্রচার করলেও পরবর্তীতে সংশোধন করে দূর্ঘটনা বলে উল্লেখ করে । এ ঘটনায় গাড়িচালক মহিলাকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। এটি স্রেফ দূর্ঘটনা নাকি ঘটনার পেছনে অন্য কোনো রহস্য আছে- তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
এই একটি ঘটনা ছাড়া ভালোই কেটেছে বৃটেনের মুসলমানদের ঈদ । পূর্ব লন্ডনের বাঙালি অধু্যষিত টাওয়ার হ্যামলেটসে আনুমানিক ৪৫ মসজিদে ঈদের একাধিক জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৃটেনের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ইস্ট লন্ডন মস্ক ও লন্ডন মুসলিম সেন্টারে অনুষ্ঠিত হয়েছে ৫টি জামাত । সকাল সাড়ে ৭টা থেকে শুরু হয়ে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত এক ঘণ্টা পরপর জামাতগুলো অনুষ্ঠিত হয়। ৫ জামাতে হাজার হাজার মুসল্লি অংশগ্রহণ করেন। ঈদের প্রথম জামাতে ইমামতি করেন ইস্ট লন্ডন মসজিদের প্রধান খতীব শায়খ আব্দুল কাইয়ূম। এরপর অন্যান্য জামাতে ইমাম ও খতীব হাফিজ আবুল হোসেনসহ অন্যান্য ইমামগণ নামাজ পড়ান। ঐতিহ্যবাহী ব্রিকলেন জামে মসজিদে অনুষ্ঠিত হয়েছে চারটি জামাত। তাছাড়া স্থানীয় ফোর্ডস্কয়ার মসজিদ, হেকনী রোড শাহপরান জামে মসজিদ, স্টেপনী শাহজালাল মসজিদসহ সকল মসজিদেই একাধিক জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছে। লন্ডনের বাইরে মুসলিম অধু্যষিত প্রতিটি শহর ও এলাকায় মসজিদগুলোতে ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছে।
তবে এবারের ঈদে ব্যতিক্রম ছিলো ‘ঈদ ইন দ্যা পার্ক’ অর্থাৎ পার্কে ঈদ উদযাপন । পূর্ব লন্ডনের মাইল এন্ড পার্কে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল, চ্যারিটি সংস্থা হিউম্যান অ্যাপিল ও রেডকোর্ট রেসিডেন্ট ফোরামের সম্বয়ে গঠিত’ ঈদ ইন দ্যা পার্ক কমিটি’র উদ্যোগে সকাল সাড়ে ৯টায় ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হয় । বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ শায়খ আব্দুর রাহমান মাদানী ঈদের নামাজে ইমামতি করেন। ঈদ জামাত শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই পার্কের উপস্থিত ছিলেন টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের নির্বাহী মেয়র জন বিগস। ছিলেন কাউন্সিলের স্পীকার সাবিনা আক্তার, ডেপুটি স্পীকার আয়াস মিয়াসহ অন্যরা। তাঁরা মুসল্লিদের সাথে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।
ঈদ ইন দ্যা পার্ক কমিটির অন্যতম সদস্য সাবেক কাউন্সিলার আবদাল উল্লাহ সাপ্তাহিক দেশকে বলেন, দিন দিন ঈদ জামাত আরো বড় হচ্ছে। প্রতি বছরই মানুষের অংশগ্রহণ বাড়ছে। আগামীতে আরো বর্ধিত কলেবরে আয়োজন করা হবে ইনশাল্লাহ । তিনি ঈদ জামাত আয়োজনে যারা সহযোগিতা করেছেন সকলকে ধন্যবাদ জানান।
ঈদ উদযাপন কমিটির অন্যতম সদস্য রেডকোর্ট রেসিডেন্ট ফোরামের আহবায়ক আখলাক আহমদ সাপ্তাহিক দেশকে বলেন, কমিউনিটির মানুষের সহযোগিতায় গত পনোরো বছর ধরে তাঁরা মাইল এন্ড পার্কে ঈদের জামাত আয়োজন করে আসছেন। ঈদ জামাতগুলোতে মানুষের স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহণ দেখে তিনি মুগ্ধ ও অভিভূত। এ ধরনের একটি মহৎ কাজে সম্পৃক্ত থাকতে পেরে নিজেকে গর্বিত মনে করেন। তিনি বলেন, আমাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, ঈদের জামাতের মাধ্যমে কমিউনিটির মানুষকে একটি দিনের জন্য একই প্লাটফর্মে একিভূত করা। আমাদের এই চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। তিনি জানান, এবারের জামাতে প্রায় ৮ হাজার পুরুষ-মহিলা, তরুণ, যুবক ও শিশু-কিশোর অংশগ্রহণ করেন। নিরাপত্তার জন্য ১৫জনের একটি সিকিউরিটি টিম দায়িত্বে ছিলো। কমিটির অন্যতম সদস্য মরফত আলী সাপ্তাহিক দেশকে বলেন, মানুষের স্বতস্ফুর্ততা দেখে খুবই ভালো লাগছে। আশাকরি আবহওয়া অনুকূলে থাকলে আমরা প্রতিবছরই এমন সুন্দর ঈদ জামাত উপহার দিতে পারবো।
আকাশ কিছুটা মেঘাচ্ছন্ন থাকলেও দিনটি ছিলো বৃষ্টিহীন ঝরঝরে। তাই সকাল ৮টা থেকেই কাধে জায়নামাজ ফেলে মুসল্লিদেরকে স্বপরিবারে পার্ক অভিমুখে আসতে লক্ষ্য করা যায়। কেউ গাড়িতে চড়ে, কেউ খলি পায়ে হেঁটে আসছিলেন মাইল এন্ড পার্কে । নামাজের আগ মুহূর্তে চারদিক থেকে পার্ক অভিমুখে মানুষের ঢল নামে। পুরুষের পেছনে একটি নির্ধারিত স্থানে ছিলো মহিলাদের নামাজের ব্যবস্থা। তাই অনেক মা-বাবা ছেলে মেয়েদের নিয়ে স্বপরিবারে ছুটে আসনে পার্কে। মাইল এন্ড পার্ককে কিছুক্ষণের জন্য মনে হয়েছিলো বাংলাদেশের কোনো ঈদগাহ ময়দান।
পার্কে কথা হয়, চ্যারিটি সংস্থা হিউম্যান রিলিফের ফান্ডরেইজিং অফিসার খায়রুল শাহিদ-এর সাথে। অনুভূতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, খোলা ময়দানে ঈদের নামাজ পড়ার আনন্দই আলাদা। ঈদের ময়দানে নামাজ পড়তে পারার চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে? তিনি বৃটেনের সর্বস্তরের মুসলমানদেরকে ঈদের শুভেচ্ছা জানান।
ঈদের নামাজ শেষ হতেই পারস্পারিক আলিঙ্গনে মেতে ওঠেন মুসল্লিরা। দীর্ঘসময় কাটে মুসাফাহা আর আলিঙ্গনের মধ্য দিয়ে। আলিঙ্গনের এ দৃশ্যে ভেসে ওঠে কবি নজরুলের সেই বিখ্যাত ঈদের গানের দুটো পক্তি- “আজ ভুলে যা তোর দোস্ত-দুশমন, হাত মিলা হাতে। তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল ইসলামে মুরিদ।” । চ্যানেল এস, এনটিভি, এসএ টিভিসহ অন্যান্য টেলিভিশনের সাংবাদিকরা মুসল্লিদের সাক্ষাতকার গ্রহণ করেন। অনলাইন টিভি এলবি২৪ ঈদ ইন দ্যা পার্ক লাইভ সম্প্রচার করে।
এদিকে বৃটনের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ইস্ট লন্ডন মসজিদের চারপাশে ছিলো ঈদের ব্যতিক্রমী আমেজ। মসজিদ সংলগ্ন ক্যাফে কাসাব্লাঙ্কা রেস্টুরেন্টে বসে বিলেতের বাংলা মিডিয়ার সাংবাদিকদের জমজমাট ঈদ আড্ডা। সাংবাদিকদের কফি হাউজ খ্যাত ‘কাসাব্লাঙ্কা’র ডাইরেক্টর সাংবাদিক আব্দুল মুনিম জাহেদি ক্যারল ঈদের কেক আয়োজন করেন। ঈদের নামাজ শেষে সাংবাদিকগণ এখানে জড়ো হন এবং কেক কেটে ঈদ উদযাপন করেন।
উল্লেখ্য, মাইল এন্ড পার্ক ছাড়াও ইলফোর্ডের ভ্যালেন্টাইন পার্ক, বার্মিংহামসহ গোটা দেশের বিভিন্ন শহরে খোলা মাঠে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছে।