ছান্দসিকের অনন্য আয়োজন : হাজার বছরের বাঙলা কবিতা ‘উল্লাসে সংকটে’ ছিলো ছন্দের দোলায় আন্দোলিত এক উপভোগ্য সন্ধ্যা
প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ জুলাই ২০১৭
‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’ – ছান্দসিক আয়োজিত হাজার বছরের বাঙলা কবিতা ‘উল্লাসে সংকটে‘ এই বার্তা-ই দিয়ে গেল।
গত ২ জুলাই রোববার পূর্ব লন্ডনের ব্রাডি আর্টস সেন্টারে অনুষ্ঠিত আবৃত্তি অনুষ্ঠানে আগত সুধীজনের মন্তব্য ছিল এরকম।
কবিতা আবৃত্তির সাথে নৃত্য, বাঁশির সুরলহরী ও তবলার তাল আর কীবোর্ডের সুরব্যঞ্জনা পুরো অনুষ্ঠানটি এক মোহনীয় আবহে স্পন্দিত হয় । গ্যালারি ভর্তি দর্শক ও শ্রোতা লন্ডনের ভ্যাপসা গরমে ডুবেও মুগ্ধ হয়ে কবিতা আবৃত্তি উপভোগ করেন ও ছন্দের দোলায় আন্দোলিত হন।
উল্লেখ্য, সিলেটের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও আবৃত্তি শিক্ষক প্রয়াত শ্রী হেমচন্দ্র ভট্টাচার্যের স্মরণে ছান্দসিকের এ আয়োজন ছিল তাঁর ছাত্রছাত্রীদের পরিবেশিত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত একটি ব্যতিক্রমী সংযোজন।
ছান্দসিকের অন্যতম কর্মী জাকী চৌধুরী সন্ধ্যা ৭টা বাজতেই অনুষ্ঠান শুরুর ঘোষণা দেন। এ সময় ছান্দসিকের শুভ্যানুধ্যায়ী সাংবাদিক ইসহাক কাজল প্রয়াত শ্রী হেমচন্দ্র ভট্টাচার্যের প্রতি শ্রদ্ধ জানিয়ে এবং ছান্দসিকের পথ চলাকে স্বাগত জানিয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন। এরপর অন্যতম সংগঠক কবি হামিদ মোহাম্মদ ছান্দসিক সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন ও উপস্থিত সুধীবৃন্দকে অনুষ্ঠান উপভোগ করার আমন্ত্রণ জানান।
ছান্দসিকের প্রধান সংগঠক মুনিরা পারভীনের মূল পরিচালনায় ও সম্মিলিত উপস্থাপনায় চর্যাপদ থেকে আরম্ভ করে সাম্প্রতিক কবিদের কবিতা আবৃত্তিতে অংশ নেন আবৃত্তিকার রেজুওয়ান মারুফ, আফসানা সালাম, ফারহানা মনি, শতরূপা চৌধুরী, জিয়াউর রহমান সাকলেন, তাহেরা চৌধুরী লিপি ও রাজিব জেবতিক।
চন্ডি দাসের ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’ মানবিকতার এই অমোঘ মন্ত্র শ্রোতাদের মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে তারা একে একে পাঠ করেন প্রচলিত লোক সাহিত্য, বাংলা সাহিত্যের ধ্রুবতারা কবি মাইকেল মধুসুদন দত্তের মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির প্রেম ঋদ্ধ কবিতা ‘বঙ্গভাষা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন সšধানি ‘পরিচয়’ ও ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ‘, জীবনানন্দ দাশের রূপসীবাংলাকে নিয়ে ভালোবাসায় উজ্জীবিত ‘আবার আসিব ফিরে, সুকান্ত ভট্টাচার্যের অধিকার-সোচ্চার কবিতা ছাড়পত্র, কবি শামসুর রাহমানের জাতির বিবেকের পতাকা ‘আসাদের শার্ট‘। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বিদগ্ধ উচ্চারণ ‘না-পাঠানো চিঠি‘ মুক্তিযুদ্ধের পটভুমিকায় রচিত জসীম উদ্দিনের দগ্ধগ্রাম, কবি সৈয়দ শামসুল হকের ‘পরানের গহীন ভিতর‘, কবি নির্মলেন্দু গুণের ‘স্বাধীনতা শব্দটি কি করে আমাদের হলো’ আর নীলিমা ইব্রাহিমের লেখা ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি‘।
এছাড়া হাজার বছরের কবিতার মধ্যে জনপ্রিয় কবিদের লেখা অনেক বিখ্যাত কবিতা যা ‘উল্লাসে সংকটে’ জাতির পরিচয় বহন ও সঠিক পথ নিদেশ করে এমন সব কবিতা পাঠ করা হয়।
কবিতা আবৃত্তির সাথে বাঁশির সুর সংযোজনে ছিলেন বংশীওয়ালা মখলিসুর রহমান, তাল সঞ্চালনে ছিলেন গৌতম কুমার সিকদার, কীবোর্ডে রিয়াদ এবং সাউন্ড ব্যবস্থাপনায় সামসুল জাকী স্বপন। সুশোভন স্টেজ নির্মাণ করেন মো” আবদুস সামাদ।
আবৃত্তি শেষে ছিল উপস্থিত শ্রোতা ও দর্শকদের প্রতিক্রিয়া পর্ব। প্রচন্ড গরমের মধ্যে দেড় ঘন্টার অনুষ্ঠান উপভোগের পরও কবি ইকবাল হোসেন বুলবুলের পরিচালনায় প্রতিক্রিয়া পর্বে অনুষ্ঠানটি বিলেতের অন্যতম সেরা একটি উপস্থাপনা হিসেবে উল্লেখ করে বক্তব্য রাখেন বিশিষ্টজন।
সব শেষে ছান্দসিকের প্রাণ মুনিরা পারভীন উপস্থিত সুধীজনকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বক্তব্য রাখেন । মুনিরা পারভীন তাদের প্রিয় শিক্ষক প্রয়াত শ্রী হেমচন্দ্র ভট্টাচার্যের অনুপ্রেরণা, সংগঠনের ছান্দসিক নাম প্রদান, আবৃত্তি শিল্পের প্রতি দায়বদ্ধতার দীক্ষাদানের ঋণ স্বীকার করে বলেন, আজকের অনুষ্ঠান উপস্থাপনার সকল বাচিক শিল্পী তাঁরই ছাত্রছাত্রী। পরিচয় পর্বে মুনিরা পারভীন বলেন- আবৃত্তি করতে সুদুর ব্রিস্টল থেকে এসেছে ফারহানা মনি, বার্মিংহাম থেকে এসেছে আফসানা সালাম ও রাজিব জেবতিক। প্রাণের টান ছাড়া বিলেতের কঠিন জীবনযাত্রার মধ্যে এ বিরল সময়টুকু কারো পক্ষে দান করা সম্ভব নয়। শতরূপা চৌধুরীকে দেখিয়ে মুনিরা পারভীন বলেন, রিহার্সেলে অংশগ্রহণ করতে আমার এই ছোট্টবোনটি ট্রেনে বাসে বা কখনো হেঁটে প্রতিটি মহড়ায় ছুটে এসেছে। কাজের চাপে পিষ্ট হয়ে বাসায় না গিয়ে শুকনো মুখে ছুটে এসে মহড়ায় যোগ দিয়েছে তাহেরা চৌধুরী লিপি। কবি রেজুয়ান মারুফ ও জিয়াউর রহমান সাকলেনও অনেক কষ্ট করে মহড়ায় যোগ দিয়েছেন। আর এ সব মহড়া ও অনুষ্ঠানকে সফল করার পেছনে ছান্দসিকের মূল প্রনোদনাকারি ব্যক্তি সব সময় আমাদের সঙ্গী ছিলেন কবি হামিদ মোহাম্মদ। আমরা যখন কোথাও মহড়া দেবো এসব চিন্তা করে হিমসিম খাচ্ছিলাম তখন ‘পত্রিকা’ অফিসে মহড়ার সুযোগ করে দিয়ে অপরিসীম সহযোগিতা করেছেন সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ এমদাদুল হক চৌধুরী। আর আর্থিক সহযোগিতা করেছেন কমিউনিটির ব্যবসায়ী অনেক বিশিষ্টজন। যাদের অবদান শিল্প সাহিত্য বিকাশে অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।
উপস্থিত সুধীজনের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন ও সহযোগিতা কামনা করে মুনিরা পারভীন বলেন, আপনাদের সহযোগিতা ও অনুপ্রেরণা পেলে ছান্দসিক নিয়মিত কবিতা আবৃত্তির অনুষ্ঠানের আয়োজনে বিলেতের মূলধারা ও বহুভাষাভাষীদের সংযুক্ত করার স্বপ্ন রয়েছে। এই ধারায় বাংলাকাব্যের বহুমাত্রিক দর্শন, স্পিরিটি ও এর উচ্চমান এবং বৈশ্বয়িক মানবভাবনাকে ছড়িয়ে দিতে চাই বিলেতের মূলধারায়, সর্বত্র।
উল্লেখ্য, ছান্দসিকের এ আয়োজন উপভোগ করতে বিশিষ্টজনের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কমিউনিতা নেতা মাহমুদ হাসান এমবিই, মাহমুদ এ রউফ, সাংবাদিক আবু মুসা হাসান, নিলুফা ইয়াসমীন, ডা. মখলিসুর রহমান, খলিল কাজী, আবদুল আজিজ তকি, কবি শামীম আজাদ, লেখক ফারুক আহমেদ, কবি আতাউর রহমান মিলাদ, কাজল রশীদ, সংস্কৃতিকর্মী সৈয়দ এনামুল ইসলাম, উদীচীর সভাপতি হারুন অর রশীদ, আফতাব হোসেইন, মুজিবুল হক মনি ও রুবি হকসহ আরো অনেকে। -বার্ত প্রেরক : কবি হামিদ মোহাম্মদ