বৃটেনে ৬ মাসে ৪শ’ এসিড হামলা বাংলাদেশিরাও আতঙ্কে
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ জুলাই ২০১৭
দেশ ডেস্ক: বৃটেনে অব্যাহত এসিড হামলার ঘটনায় মুসলিম বিশেষত বাংলাদেশ কমিউনিটির ঘরে ঘরে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবি, বার্তা পাঠিয়ে হামলার ভয়াবহতার বিষয়ে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বৃটিশ নাগরিকদের একে অন্যকে সতর্ক করছেন। দেশে থাকা স্বজনদের কাছেও তারা সচিত্র বার্তা পাঠাচ্ছেন। বিষয়টি লন্ডন, ম্যানচেষ্টার ও বার্মিংহামস্থ বাংলাদেশ মিশনে কর্মরত কূটনীতিকদেরও ভাবিয়ে তুলেছে। তবে এটি একান্তই বৃটেনের অভ্যন্তরীণ এবং দেশটির নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ায় বাংলাদেশি কূটনীতিকরা অত্যন্ত সতর্ক এবং ঘনিষ্ঠভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। বৃটিশ পুলিশের বরাতে বিবিসি বাংলার রিপোর্টে জানানো হয়, গত ৬ মাসে (চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত) ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসে ৪০০টি এসিড হামলার ঘটনা রেকর্ড হয়েছে। ২০১২ সাল থেকে ২০১৬-১৭ সাল পর্যন্ত ৫ বছরে এ ধরনের হামলা দ্বিগুণ আকার ধারণ করেছে। এর বেশিরভাগ ঘটনাই ঘটছে রাজধানী লন্ডনে।
সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার নর্থ-ইস্ট লন্ডনে ৫ জনকে লক্ষ্য করে এসিড হামলা চালানো হয়। গত মাসে পূর্ব লন্ডনের রাস্তায় গাড়ির জানালা দিয়ে এসিড নিক্ষেপের ঘটনায় মারাত্মকভাবে দগ্ধ হন পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত বৃটিশ তরুণী রেশাম খান এবং তার সহযাত্রী জামিল মুখতার। এপ্রিল মাসে ইস্ট লন্ডনে এসিড হামলায় অন্তত ২০ জন আক্রান্ত হয়েছেন বলে বিবিসি’র রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। বৃটেনের ন্যাশনাল পুলিশ চিফ কাউন্সিলের তথ্যে চলতি বছরে প্রথম ছয় মাসে যুক্তরাজ্য এবং ওয়েলসে পৃথকভাবে ৪০০টি এসিড হামলার ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এসব হামলায় অভিযুক্তদের অধিকাংশই তরুণ। তাদের বয়স ১৮ এর মধ্যে। বৃহস্পতিবারের ঘটনায় একজন ১৬ বছর বয়সী কিশোরকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। গত সপ্তাহে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত লন্ডনের সাংবাদিক মুনজের আহমদ চৌধুরী দেশটিতে এসিডের সহজলভ্যতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। এসিড হামলার অনেক ঘটনা ‘মুসলিম বিদ্বেষ’ এবং ইসলামের নামে উগ্রপন্থিদের বিভিন্ন হামলার পাল্টা হামলা হিসেবে ঘটছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। মুসলিম নারী ও তরুণীরা এসিড হামলার বেশির ভাগ ঘটনায় ভুক্তভোগী (ভিকটিম) বলে জানান চ্যানেল আই ইউকে’র বার্তা সম্পাদকের দায়িত্বে থাকা ওই প্রবাসী সাংবাদিক। তবে পুরুষরাও আক্রান্ত হচ্ছে। বিবিসি বাংলার রিপোর্টে গত নভেম্বরে ইস্ট লন্ডনে এসিড হামলার শিকার রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী ইমরান খানের করুণ চিত্র প্রকাশ পেয়েছে। সেখানে এসিডে মুখ ঝলসে যাওয়া ইমরান খান বলেন, একদল তরুণ তার সঙ্গে বর্ণবাদী আচরণ করে এবং অর্থ ও খাবার দাবি করে। এরপর গাড়ির ভেতর তার মুখের ওপর তরল পদার্থ ঢেলে দেয় তারা। ইমরানের আশঙ্কা তিনি হয়তো পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যাবেন। পূর্ব লন্ডনে স্কুলপড়ুয়া দুই মেয়ে নিয়ে বসবাস করেন সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার জলডুপ গ্রামের মুমতাহিনা জান্নাত (সাজু)। ইস্ট লন্ডন মসজিদ লাগোয়া একটি বাড়িতে থাকেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ওই নারী।
সম্প্রতি পূর্ব লন্ডনে ঘটে যাওয়া একাধিক এসিড হামলার সিসিটিভি ফুটেজ শেয়ার করে তিনি বলেন, এসিড হামলার ঘটনাগুলো খুবই বীভৎস। অনেক নারী ও তরুণী এরইমধ্যে এর শিকার হয়েছে। তারা এখন জীবন যন্ত্রণায় ভুগছেন। বর্বর এসব ঘটনায় বাঙালি পরিবারগুলোতে গভীর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে জানিয়ে তিনি তার নিজের উদাহরণ দেন। বলেন, ‘আমার দু’টি মেয়ে রয়েছে। তারা স্কুলে যায়। ইসলামী শিক্ষা ক্লাস করতে ইস্ট লন্ডন মসজিদেও (মক্তব) যায়। তাদের আমি দিয়ে আসি। ফেরার সময় অনেক দিনই পরিচিত ভাবীরা (মেয়েদের সহপাঠীদের মায়েরা) ঘরে পৌঁছে দিয়ে যান। এত বছর এভাবেই চলছিলাম। কিন্তু এখন আর পারি না। মেয়েদের চিন্তায় তাদের নিয়ে যাই, আবার নিজেই নিয়ে আসি। রাস্তার পুরোটা সময় আতঙ্কে কাটাই। লন্ডনে প্রকাশ্যে এসিড কেনাবেচায় তেমন বিধি-নিষেধ নেই। তবে সামপ্রতিক এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে বিশেষত উগ্রপন্থিদের হাতে হাতে এসিড থাকায় বেচাকেনা সংক্রান্ত আইন কঠোর করার জোর দাবি উঠেছে। এ নিয়ে সাধারণ মানুষের উদ্বেগ বাড়তে থাকায় এসিড হামলার মতো গুরুতর অপরাধের বিচার পদ্ধতি নিয়ে বৃটিশ প্রশাসন বিস্তারিত পর্যালোচনা করছে বলে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আম্বার রাড।
এ বিষয়ে অপরাধ বিশেষজ্ঞ ডক্টর সিমোন হার্ডিং বিবিসিকে বলেন- এটা এক ধরনের সহজলভ্য অস্ত্র হিসেবে পরিণত হয়েছে। তার মতে, এসিড নিক্ষেপ আধিপত্য, ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণের দাপট দেখানোর উপায় হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এর মধ্য দিয়ে বিভিন্ন গ্যাং ত্রাস সৃষ্টি করে থাকে। তার মতে, সরকারকে এ বিষয়ে তিনটি উদ্যোগ নিতে হবে। প্রথমত, এসিডের সহজলভ্যতা কমানো, দ্বিতীয়ত, কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা এবং তৃতীয়ত, মানুষের মধ্যে শিক্ষার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। লন্ডনের দাতব্য প্রতিষ্ঠান এসিড সারভাইভার্স ট্রাস্ট ইন্টারন্যাশনাল-এর জাফর শাহ বলেন, এই ধরনের ঘটনা নতুন নয়। তবে সামপ্রতিক হামলার ঘটনা উদ্বেগজনক। তার মতে, বিশ্বে সম্ভবত বৃটেনেই এখনো সবচেয়ে এসিড হামলার ঘটনা ঘটছে। এদিকে লন্ডনের সানডে টাইমস জানিয়েছে, এসিড হামলার বিষয়ে কঠোর আইন প্রণয়নের চিন্তাভাবনা করছে বৃটিশ সরকার। তাছাড়া এসিড বিক্রির ওপর কড়া নজরদারি আরোপের ভাবনাও রয়েছে প্রশাসনের। কেবল আইন কঠোর করাই নয়, পুলিশের দায়িত্ব এবং কিভাবে এসিডের মতো ক্ষতিকারক পণ্য মানুষের কাছে পৌঁছায় এবং এসিড হামলার শিকারদের কিভাবে সাহায্য করা যায় তা নিয়েও আলোচনা চলছে বৃটিশ প্রশাসনে। বৃটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সানডে টাইমসকে বলেন, অপরাধীরা যেন আইনের শক্তি পূর্ণমাত্রায় অনুভব করতে পারে সেটাই আমরা চাইছি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এসিড আক্রমণে বেঁচে থাকা ব্যক্তিদের জীবনযাত্রা কঠোর হয়ে যায়। সোমবার হাউস অব কমন্সে বর্বর এসিড হামলা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন এমপিরা।