পূর্ব লন্ডনে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এলেন বাংলাদেশী ছাত্র আবু নাসের
প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ জুলাই ২০১৭
তাইসির মাহমুদ : মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এলেন হার্টফোর্ডশায়ার ইউনিভার্সির বাংলাদেশী ছাত্র আবু নাসের তালুকদার । অন্ধকার গলিপথে একদল শ্বেতাঙ্গ যুবক উপর্যুপরি কিল-ঘুষি মারার পর যখন ছুরিকাঘাতের জন্য উদ্যত হয় তখন প্রবল শক্তি খাটিয়ে দৌড়ে পালিয়ে আসতে সক্ষম হন তিনি । ঘটনাটি ঘটেছে ১৯ জুলাই বুধবার রাত ১০টায় পূর্ব লন্ডনের ক্যানিং টাউন এলাকায়। ঘটনার পর তিন রাত পেরিয়ে গেছে অথচ একটিবারের জন্য ঘুমাতে পারেননি তিনি । চোখ বন্ধ করলেই ভেসে আসছে হামলার ভয়ঙ্কর দৃশ্য। স্বামীর উপর হামলার ভয়ঙ্কর বর্ণনা শোনে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন সন্তান সম্ভাবা স্ত্রীও । চরম আতঙ্কের মধ্যে দিনাতিপাত করছেন দুজন।
হামলার বর্ণনা দিতে আবু নাসের তালুকদার সাপ্তাহিক দেশকে বলেন, তিনি ক্যানিং টাউন এলাকার ইগল রোডে বসবাস করেন। ঘটনার দিন রাত ১০টার দিকে তাঁর ঘর থেকে ১০ মিনিট হাঁটার দুরত্বে অবস্থিত এক বন্ধুর ঘরে বেড়াতে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে চার্জেবল রোডে পৌঁছার পর পেছন থেকে এক যুবক এসে জিজ্ঞেস করে, তিনি কি ওইদিকে কাউকে যেতে দেখেছেন? জবাবে তিনি না বলতেই, সে ধামকি দিয়ে বলে “আর ইউ ড্রাং”। পরক্ষণে পায়ে ল্যাং মেরে তাঁকে ফেলে দেয় মাটিতে। তিনি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দেখেন চতুর্দিক থেকে তাকে ঘিরে ফেলেছে ৫/৬ জনের একদল তরুণ। সকলের বয়স ১৭ থেকে ১৮ । তার নাক-মুখ, মাথাসহ সারা শরীরে কিল-ঘুষি ও লাতি মারতে থাকে। একপর্যায়ে তাকে মোবাইল ফোন ও ওয়ালেট বের করতে বলে। তিনি প্রবল শক্তি খাটিয়ে পেছন দিকে দৌড় দেন । কিন্তু নিজেকে রক্ষা করা সম্ভব
হয়না । একটু এগিয়ে দেখেন সেখানে দাঁড়িয়ে আছে আরো চার যুবক। ওরা তাকে ঝাপটে ধরে ওয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড় করে । এরপর সকলে মিলে বেধড়ক পেটাতে থাকে। দীর্ঘক্ষণ পেটানোর পর একসময় পকেট থেকে বের করে ছুরি। আবু নাসের ভাবেন মৃতু্যই বোধহয় তাঁর নিয়তি। হেল্প হেল্প বলে সজোরে চিৎকার করতে থাকেন। কিন্তু চিৎকার শোনার কেউ নেই সেখানে। ছুরিকাঘাতের জন্য যখন তারা উদ্যত হয়, তখন বাঁচার সর্বশেষ চেষ্টা চালান । অপেক্ষাকৃত দুর্বল এক তরুণকে ধাক্কা মেরে দৌড়ে পালিয়ে আসেন। গলিপথ ছেড়ে মুল রাস্তায় এসে তিনি মাটিতে পড়ে যান। তাকে পড়ে থাকতে বেরিয়ে আসেন স্থানীয় এক দোকানী। নাসের হামলার শিকার হয়েছেন জানিয়ে দোকানীকে পুলিশ ডাকতে অনুরোধ করেন। কিন্তু দোকানদার কোনো কর্ণপাত না করে দোকানেই ফিরে যান।
এরপর তিনি কোনোমতে হামাগুড়ি দিয়ে ওঠে হেঁটে বাসায় পৌঁছান । মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়ায় পুলিশকে ফোন দিতে পারেননি। ঘরে ফিরে স্ত্রীর ফোন দিয়ে পুলিশে কল করেন। মাত্র তিন মিনিটের মধ্যে পুলিশ বাসায় পৌঁছে তাঁকে নিয়ে ঘটনাস্থলের পাশে যায় । হামলাকারী যুবকদের কিছুক্ষণ খোঁজাখুজি করে। এসময় পুলিশকে তিনি মূল ঘটনাস্থল ওই গলিপথে যেতে অনুরোধ করলেও পুলিশ বলে, সেখানে এখন আর কেউ নেই। গিয়ে কোনো লাভ হবেনা । নাসের তালুকদারকে নিয়ে পুলিশ স্টেশনে যাওয়া হয়। একটি লেপটপ অন করে তাতে ওই এলাকার কিছু অপরাধী তরুণের ছবি দেখিয়ে হামলাকারীকে শনাক্ত করতে বলে পুলিশ । তিনি এক যুবককে আনুমানের ভিত্তিতে শনাক্ত করেন। পুলিশ তাকে শতভাগ নিশ্চয়তার সাথে শনাক্ত করতে বলে। তিনি শতভাগ নিশ্চয়তা দিতে না পারলে পুলিশ তাঁকে একটি ক্রাইম রেফরেন্স হাতে ধরিয়ে দিয়ে গাড়িতে করে বাসায় পৌছে দিয়ে আসে। বাসায় নামিয়ে দেয়ার সময় পুলিশ বলে, ঘটনাস্থলে কোনো সিসিটিভি নেই। তাই হামলাকারীদের গ্রেফতারের ব্যাপারে আর কিছু করার নেই। চলতি পথে তিনি কাউকে দেখলে যেনো পুলিশকে তৎক্ষনাত অবহিত করেন ।
আবু নাসের জানান, হামলায় তিনি শরীরের ভেতরে গুরুতর আঘাত পেয়েছেন । তৎক্ষনাত বেশ কিছু টের না পেলেও পরদিন সকাল থেকে সারা শরীরে প্রচণ্ড ব্যাথা অনুভব করছেন। তিনদিন অতিবাহিত হচ্ছে অথচ বিছানা থেকে ওঠে দাঁড়াতে পারছেন না। তিনি সাপ্তাহিক দেশকে আরো বলেন, এটি ছিন্তাইয়ের ঘটনা বলে তার কাছে মনে হয়নি। ছিন্তাই হলে প্রথমেই তার কাছে মোবাইল এবং মানিব্যাগ চাইতো। তাকে আটকে এভাবে উপর্যুপরি পেটাতো না। তিনি বলেন, এটি হেইট ক্রাইম (ঘৃণাজনিত অপরাধ) বলেই মনে করি । আমাকে এশিয়ান বুঝতে পেরে হামলা করেছে।
উল্লেখ্য, আবু নাসের তালুকদারের দেশের বাড়ি চট্রগ্রামের রাউজান উপজেলায় । তিনি এ বছর হার্টফোর্ডশায়ার ইউনিভার্সিটি থেকে এমএসসি ম্যানেজমেন্টে ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছেন। লেখাপড়ার পাশাপাশি সেইন্সবারী টাওয়ার হিল শাখায় কাস্টমার সার্ভিস অফিসার হিসেবে চাকরি করেন।