সাংবাদিকদের জন্য ডেঞ্জার জোন দক্ষিণ এশিয়া
প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ জুলাই ২০১৭
দেশ ডেস্ক: সাংবাদিক হত্যার প্রতিবাদ পাকিস্তানে- ফাইল ছবিসাংবাদিকদের জন্য ডেঞ্জার জোন বা ভয়ংকর অঞ্চল হয়ে উঠেছে দক্ষিণ এশিয়া। তার মধ্যে রয়েছে ভারত, পাকিস্তান, মালদ্বীপ ও বাংলাদেশ। গত ৬ মাসে সাংবাদিকদের ওপর হামলা ও তাতে নিহত হওয়ার ঘটনার ওপর ভিত্তি করে এ কথা লিখেছেন আসামের গুয়াহাটিভিত্তিক সাংবাদিক নাভা ঠাকুরিয়া। তার লেখা প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে অনলাইন ইউরেশিয়া রিভিউয়ে।
এতে বলা হয়েছে- এই ৬ মাসে ভুটান, নেপাল বা শ্রীলঙ্কায় কোনো সাংবাদিক নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। এ বছরের প্রথম অর্ধাংশে এ অঞ্চলে হত্যা করা হয়েছে কমপক্ষে ১০ জন সাংবাদিককে। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জে নিহত সাংবাদিক আবদুল হাকিম শিমুল হত্যার কথাও। তাকে গত ২রা ফেব্রুয়ারি ক্ষমতাসীন দলের দু’পক্ষের মধ্যকার সংঘর্ষ নিয়ে রিপোর্ট করতে গেলে তাকে হত্যা করা হয়। ২০১৭ সালে এটাই ছিল প্রথম সাংবাদিক হত্যার ঘটনা। এজন্য কড়া নিন্দা জানিয়েছে মানবাধিকার সাংবাদিক ফোরাম।
দীর্ঘ ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের জন্য প্রথম দুর্ভাগ্যজনক খবর শুরু হয় ঝাড়খন্ড থেকে। সেখানে হাজারিবাগ এলাকায় একটি সড়কের পাশে ২রা জানুয়ারি পাওয়া যায় সাংবাদিক হরি প্রকাশ (৩১) এর মৃতদেহ। এর কয়েকদিন আগে তিনি নিখোঁজ হন। তিনি আইনের গ্রাজুয়েট ছিলেন। কাজ করতেন একটি হিন্দি দৈনিক পত্রিকায়। তার পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, তাকে হত্যা করতে অপহরণ করেছিল দুর্বৃত্তরা।
ভারতের জন্য আরেকটি খারাপ খবর যেন অপেক্ষা করছিল। ৩রা জানুয়ারি বিহারের সমস্তিপুর এলাকায় মাথায় আঘাত করে মারাত্মক আহত করা হয় সাংবাদিক ব্রজেশ কুমার সি (২৮) কে। এর ফলে ঘটনাস্থলেই তিনি নিহত হন। গত বছর এই বিহারেই হত্যা করা হয় আরো দু’জন সাংবাদিক রাজদেও রঞ্জন ও ধর্মেন্দ্র কুমার সিংকে। ভারতে এ বছর আরো দু’জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে মধ্যপ্রদেশের শ্যাম শর্মা (৪০) অন্যতম। তিনি একটি সান্ধ্যকালীন পত্রিকায় কাজ করতেন। ১৫ই মে তাকে ইন্দোরের আনশুল এলাকায় কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। কোপের ফলে তিনি মারাত্মক আহত হন এবং ঘটনাস্থলেই মারা যান।
এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে স্থানীয় পুলিশ দু’জনকে আটক করেছে। অন্যদিকে মধ্যপ্রদেশেরই মান্দসুউরে ৩১শে মে পিপলিয়ামান্দি এলাকায় নিজ অফিসের ভিতর গুলি করে হত্যা করা হয কমলেশ জৈন (৪২) কে। তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ওই এলাকায় দায়িত্বরত পুলিশ বলেছে, দু’জন দুর্বৃত্ত তার অফিসে প্রবেশ করে এবং তাদের একজন তাকে গুলি করে। এরপর মোটরসাইকেলে করে দ্রুত তারা ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। তিনি কাজ করতেন হিন্দি ভাষার একটি দৈনিক পত্রিকায়। সেখানে স্থানীয় কিছু মানুষের মাদক ব্যবসা নিয়ে তিনি রিপোর্ট করেছিলেন। ঘটনার কয়েকদিন আগে তারা তাকে করুণ পরিণতি ভোগ করার হুমকি দিয়েছিল।
এ ঘটনায়ও পুলিশ সন্দেহজনকভাবে আটক করেছে দু’জনকে। ঝাড়খন্ড, বিহার, মধ্যপ্রদেশের বিভিন্ন মানবাধিকারবিষয়ক সংগঠন এর নিন্দা জানিয়েছে। এর পাশাপাশি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন। এর মধ্যে রয়েছে জার্নালিস্টস ফোরাম আসা, ইন্ডিয়ান জার্নালিস্টস ইউনিয়ন, ন্যাশনাল ফেডারেশন অব নিউজপেপার এমপ্লয়িজ, কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে), রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ), ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব জার্নালিস্টস প্রভৃতি। তারা দ্রুত অপরাধীদের ধরে আইনের আওতায় নেয়ার আহ্বান জানায়। সাংবাদিক শ্যাম ও কমলেশ হত্যার নিন্দা জানিয়ে আইএফজে বিবৃতিতে বলেছে, প্রায় দু’সপ্তাহের ব্যবধানে দু’জন সাংবাদিককে হত্যার ফলে এটা ফুটে উঠেছে ভারতীয় সাংবাদিকরা কি ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি।
সম্প্রতি এক বিবৃতিতে আইএফজে বলেছে, গত বছর সারা বিশ্বে হত্যা করা হয়েছে ৯৩ জন সাংবাদিককে। এর মধ্যে ভারতেই ৬ জন। ইরাকে সবচেয়ে বেশি সাংবাকিদকে হত্যা করা হয়েছে গত বছর। এ সংখ্যা ১৫। এর পরেই রয়েছে আফগানিস্তান (১৩), মেক্সিকো (১১), ইয়েমেনে (৮), গুয়াতেমালা (৬), সিরিয়া (৬), ভারত (৬), পাকিস্তান (৫)। উল্লেখ্য, আইএফজে বিশ্বের ১৪০টি দেশের ৬ লাখেরও বেশি সাংবাদিকের প্রতিনিধিত্ব করছে। ওদিকে পাকিস্তানে এ বছর গত ৬ মাসে হত্যা করা হয়েছে ৪ জন পেশাদার সাংবাদিক ও একজন সাংবাদিকতার ছাত্রকে।
বেলুচিস্তান প্রদেশে একটি উর্দু পত্রিকায় কাজ করতেন সাংবাদিক মুহাম্মদ জান। তাকে ১২ই জানুয়ারি বুলেট ছোড়ে দুর্বৃত্তরা। এতে পরে তিনি নিহত হন। ২২শে এপ্রিল খাইবার পখতুনখাওয়া প্রদেশে ক্ষুব্ধ দাঙ্গাকারীদের শিকারে পরিণত হন সাংবাদিকতার ছাত্র মাশাল খান। ১৭ই মে পাঞ্জাব প্রদেশে একটি টেলিভিশনের সাংবাদিক আবদুল রাজ্জাককে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। পেশোয়ারে ১১ই জুন সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করে আরেকটি টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক বখশেষ এলাহি। জেবা বারনি একজন সিনিয়র সাংবাদিক। তিনি ৩০ বছর ধরে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত। ১৯শে জুন তাকে করাচিতে তার বাসভবনে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। তিনি নাওয়া-ই ওয়াকত পত্রিকায় কাজ করতেন। তার দেহ দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকরা নিশ্চিত করেন, এটা একটি হত্যাকা-। জেবা প্রয়াত সাংবাদিক নঈম কমরের স্ত্রী। তিনি করাচি প্রেস ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তার মৃত্যুতে করাচি ইউনিয়ন অব জার্নালিস্টস কড়া প্রতিবাদ জানায়। সিপিজে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষকে সব সাংবাদিক হত্যার বিষয়ে তদন্ত করে অপরাধীদের জরুরিভিত্তিতে আইনের আওতায় আনতে।
নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক সাংবাদিকদের অধিকার বিষয়ক সংগঠন আফগানিস্তানে গত ৬ মাসে সাংবাদিক হত্যায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। বলা হয়েছে, গত ৬ মাসে সেখানে বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেন সাংবাদিক হাবিবুল্লাহ হোসেন জাদেহ, মোহাম্মদ নাজির, আমির খান, জিনুল্লাহ খান, আবদুল রতিফ, মো. গণি, আজিজ নবীন, ওমর আরগান্দেওয়াল, আমির শিনওয়ারি, মো. জাইনুল্লাহ, সাঈদ আগা প্রমুখ। নিহতদের বেশির ভাগকেই জঙ্গিরা বোমা হামলা চালিয়ে হত্যা করেছে। সুপরিচিত একজন সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী ইয়ামিন রশিদ (২৯) কে হত্যা করা হয়েছে ছোট্ট দেশ মালদ্বীপে।
এতে আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। দেশে দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন তুখোড় সমালোচক। ২৩শে এপ্রিল রাজধানী মালেতে তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এর মধ্য দিয়ে সেখানে মুক্ত সংবাদ মাধ্যমের ওপর বড় ঝুঁকি দেখা দেয়। ওদিকে এ বছরের প্রথম ৬ মাসে মিয়ানমারে একজন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে। তিনি হলেন ইয়াঙ্গুনভিত্তিক সাপ্তাহিক আয়রন রোজ-এর সম্পাদক। তাকে ১৬ই এপ্রিল হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় স্থানীয় সাংবাদিকদের বিভিন্ন ইউনিটসহ সিপিজে, আরএসএফ মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানায় অপরাধীদের ধরে বিচারের আওতায় আনতে।
গত বছর ১৩ই ডিসেম্বর সেখানে হত্যা করা হয় সাংবাদিক সোই মোই টুনকে। স্থানীয় অনৈতিক কর্মকা- নিয়ে রিপোর্ট করার কারণে তাকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় তদন্ত ধীর গতিতে চলার কারণে সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো নিন্দা জানিয়েছে। আরএসএফের এশিয়া-প্রশান্ত ডেস্কের দায়িত্বে থাকা সাবেক প্রধান বেনিয়ামিন ইসমাইল সম্প্রতি এতে নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, এখনও সোই-এর পরিবার সুবিচারের জন্য অপেক্ষায় আছে। ওদিকে শান রাজ্য থেকে ২৬শে জুন মিয়ানমারের সেনাবাহিনী আটক করেছে তিনজন সাংবাদিককে। তারা হলেন লাওয়ি, ওয়েঙ্গ, আই নাইং এবং পাইয়াই বোনে নাইং। তাদের রাখা হয়েছে হসিপাও জেলে। তাদের অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। ওদিকে ভুটান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও তিব্বতে (চীনের নিয়ন্ত্রণে) গত ৬ মাসে কোনো সাংবাদিক হত্যার খবর পাওয়া যায়নি।