লন্ডনে ভয়াবহ হেইট ক্রাইম
প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ জুলাই ২০১৭
০ বেথনাল গ্রীনে দুই বাঙালি তরুণের ওপর এসিড
০ মৃত্যুমুখ থেকে যেভাবে ফিরলেন আবু নাসের
০ এসিডে বদলে গেছে মুসা মিয়ার চেহারা
দেশ রিপোর্ট: পূর্ব লন্ডনে বাঙালি অধ্যুষিত টাওয়ার হ্যামলেটসের বেথনাল গ্রীন এলাকায় এসিড জাতীয় পদার্থে আরো দুই বাঙালি তরুণ গুরুতর আহত হয়েছেন। ঘটনাটি ঘটেছে গত ২৫ জুলাই মঙ্গলাবার বিকাল ৭টায় বেথনাল গ্রীন পুলিশ স্টেশনের খুব কাছে রোমান রোডে। আহতরা বয়সে তরুণ বলে জানা গেছে। গত ১৩ জুলাই নর্থ লন্ডন ও ইস্ট লন্ডনে দেড় ঘন্টার ব্যবধানে ৫ জনের উপর এসিড হামলার পর এটাই বড় হামলা। ঘটনার পরপরই পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও প্যারামেডিকস টিম অকুস্থলে পৌঁছে। আহতদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ ঘটনায় এখনো কাউকে গ্রেফতার করেনি পুলিশ।
এ ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে স্থানীয় এক দোকানী বলেন, আমার দোকানে দুইজন বাঙালি কিশোর আসে ৭টার কিছুক্ষণ আগে। তারা এসে বলতে থাকে, আমরা এসিড আক্রান্ত হয়েছি, আমাদের শরীর পুড়ে যাচ্ছে, আমাদের পানি দাও। পরে তারা নিজেরাই শরীরে পানি ঢালতে থাকে। পরে আমি পুলিশ কল করলে ২০ মিনিটের মধ্যে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, উভয় কিশোরের মুখ মারাত্মকভাবে ঝলসে গেছে। পুলিশ বলছে এসিড নয়, ব্লিজ জাতীয় কোনো পদার্থ হতে পারে। হামলাকারীদের ধরতে সহযোগিতা চেয়েছে পুলিশ।
মৃত্যুমুখ থেকে যেভাবে ফিরলেন আবু নাসের:
মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এলেন হার্টফোর্ডশায়ার ইউনিভার্সির বাংলাদেশী ছাত্র আবু নাসের তালুকদার। অন্ধকার গলিপথে একদল শ্বেতাঙ্গ যুবক উপর্যুপরি কিল-ঘুষি মারার পর যখন ছুরিকাঘাতের জন্য উদ্যত হয় তখন প্রবল শক্তি খাটিয়ে দৌড়ে পালিয়ে আসতে সক্ষম হন তিনি। কিন্তু প্রাণে বাঁচলেও দুর্বৃত্তচক্রের উপর্যুপরি কিল-ঘুষিতে তাঁর নাকের হাড় ভেঙ্গে গেছে। ডাক্তার জানিয়েছে, অস্ত্রপচারের পরও নাকটি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার সম্ভবনা কম। ঘটনাটি ঘটেছে ১৯ জুলাই বুধবার রাত ১০টায় পূর্ব লন্ডনের ক্যানিং টাউন এলাকায়। ঘটনার পর এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে অথচ ঘুমাতে পারছেন না আবু নাসের। চোখ বন্ধ করলেই ভেসে আসছে হামলার ভয়ঙ্কর দৃশ্য। হামলার ভয়ঙ্কর বর্ণনা শোনে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন সন্তান সম্ভাবা স্ত্রীও। চরম আতঙ্কের মধ্যে দিনাতিপাত করছেন দু’জন।
হামলার বর্ণনা দিতে গিয়ে আবু নাসের তালুকদার সাপ্তাহিক দেশকে বলেন, তিনি ক্যানিং টাউন এলাকার ইগল রোডে বসবাস করেন। ঘটনার দিন রাত ১০টার দিকে তাঁর ঘর থেকে ১০ মিনিট হাঁটার দুরত্বে অবস্থিত এক বন্ধুর ঘরে বেড়াতে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে চার্জেবল রোডে পৌঁছার পর পেছন থেকে এক যুবক এসে জিজ্ঞেস করে, তিনি কি ওইদিকে কাউকে যেতে দেখেছেন? জবাবে তিনি না বলতেই, সে ধামকি দিয়ে বলে “আর ইউ ড্রাং”। পরক্ষণে পায়ে ল্যাং মেরে তাঁকে ফেলে দেয় মাটিতে। তিনি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দেখেন চতুর্দিক থেকে তাকে ঘিরে ফেলেছে ৫/৬ জনের একদল যুবক। সকলের বয়স ১৭ থেকে ১৮। তার নাক-মুখ, মাথাসহ সারা শরীরে এলাপাতাড়ি কিল-ঘুষি ও লাথি মারতে থাকে। একপর্যায়ে তাকে মোবাইল ফোন ও ওয়ালেট বের করতে বলে। তিনি প্রবল শক্তি প্রয়োগ করে পেছন দিকে দৌঁড় দেন। কিন্তু নিজেকে রক্ষা করা সম্ভব হয়না। একটু এগিয়ে দেখেন সেখানে দাঁড়িয়ে আছে আরো চার যুবক। ওরা তাঁকে ঝাপটে ধরে ওয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড় করে। এরপর সকলে মিলে বেধড়ক পেটাতে থাকে। দীর্ঘক্ষণ পেটানোর পর একসময় পকেট থেকে বের করে ধারালো ছুরি। আবু নাসের ভাবেন মৃত্যুই বোধহয় তাঁর নিয়তি। হেল্প হেল্প বলে সজোরে চিৎকার করতে থাকেন। কিন্তু চিৎকার শোনার কেউ নেই সেখানে। একপর্যায় ছুরিকাঘাতের জন্য যখন তারা উদ্যত হয়, তখন বাঁচার সর্বশেষ চেষ্টা চালান আবু নাসের। অপেক্ষাকৃত দুর্বল এক যুবককে ধাক্কা মেরে দৌঁড়ে পালিয়ে আসেন। গলিপথ ছেড়ে মূল রাস্তায় এসে তিনি মাটিতে পড়ে যান। তাকে পড়ে থাকতে দেখে বেরিয়ে আসেন স্থানীয় এক দোকানী। নাসের হামলার শিকার হয়েছেন জানিয়ে দোকানীকে পুলিশ ডাকতে অনুরোধ করেন। কিন্তু দোকানদার তাতে কোনো কর্ণপাত না করে দোকানে ফিরে যান।
এরপর তিনি কোনোভাবে হামাগুড়ি দিয়ে ওঠে হেঁটে বাসায় পৌঁছেন। মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়ায় পুলিশকে ফোন দিতে পারছিলেন না। ঘরে ফিরে স্ত্রীর ফোন দিয়ে পুলিশে কল করেন। মাত্র তিন মিনিটের মধ্যে পুলিশ বাসায় পৌঁছে তাঁকে নিয়ে ঘটনাস্থল এলাকায় যায় । হামলাকারী যুবকদের কিছুক্ষণ খোঁজাখুজি করে। এসময় পুলিশকে তিনি মূল ঘটনাস্থল ওই গলিপথে যেতে অনুরোধ করলেও পুলিশ বলে, সেখানে এখন আর কেউ নেই। গিয়ে কোনো লাভ হবেনা। আবু নাসেরকে নিয়ে পুলিশ স্টেশনে যাওয়া হয়। একটি লেপটপ অন করে তাতে ওই এলাকার কিছু ‘অপরাধী’ যুবকের ছবি দেখিয়ে হামলাকারীকে শনাক্ত করতে বলে পুলিশ। তিনি এক যুবককে আনুমানের ভিত্তিতে শনাক্ত করেন। পুলিশ তাকে শতভাগ নিশ্চয়তার সাথে শনাক্ত করতে বলে। তিনি শতভাগ নিশ্চয়তা দিতে না পারলে পুলিশ তাঁকে একটি ক্রাইম রেফরেন্স হাতে ধরিয়ে দিয়ে গাড়িতে করে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসে। বাসায় নামিয়ে দেয়ার সময় পুলিশ বলে, ঘটনাস্থলে কোনো সিসিটিভি নেই। তাই হামলাকারীদের গ্রেফতারের ব্যাপারে আর কিছু করার নেই। চলতি পথে তিনি কাউকে দেখলে যেনো পুলিশকে তৎক্ষনাত অবহিত করেন।
আবু নাসের জানান, প্রাথমিকভাবে তিনি এই হামলার প্রভাব বুঝে ওঠে পারেননি। যেহেতু শরীরে বাহ্যিক কোনো যখম হয়নি তাই অ্যাম্বুল্যান্স ডাকারও প্রয়োজনবোধ করেননি। পরদিন সকালে বুঝতে পারেন বিছানা থেকে উঠতে পারছেন না। তাই স্থানীয় নিউহ্যাম হাসপাতালে যান। সেখানে এক্সরে করার পর ডাক্তার জানান, তার নাকের হাড় ভেঙ্গে গেছে। নিউহ্যাম হাসপাতাল থেকে তাঁকে পাঠানো হয় রয়েল লন্ডন হাসপাতালে। আগামী ৪ আগস্ট তাঁর নাকে প্রথমদফা অস্ত্রপচার হবে। দ্বিতীয়দফা অপারেশন হবে আরো ৯ মাস পর। আবু নাসের সাপ্তাহিক দেশকে আরো বলেন, এটি ছিনতাইয়ের ঘটনা বলে তার কাছে মনে হয়নি। ছিনতাই হলে প্রথমেই তার কাছে মোবাইল এবং মানিব্যাগ চাইতো। তাকে আটকে এভাবে উপর্যুপরি পেটাতো না। তিনি বলেন, এটি হেইট ক্রাইম (ঘৃণাজনিত অপরাধ) বলেই মনে করি। আমাকে এশিয়ান বুঝতে পেরে হামলা করেছে।
উল্লেখ্য, আবু নাসের তালুকদারের দেশের বাড়ি চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলায়। তিনি এ বছর হার্টফোর্ডশায়ার ইউনিভার্সিটি থেকে এমএসসি ম্যানেজমেন্টে ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছেন। লেখাপড়ার পাশাপাশি সেইন্সবারী টাওয়ার হিল শাখায় কাস্টমার সার্ভিস অফিসার হিসেবে চাকরি করেন। ঘটনার তিনদিন পর সাপ্তাহিক দেশর অনলাইনে সংবাদটি ছাপা হলে সোশ্যাল মিডিয়ায় সংবাদটি ভাইরাল হয়ে যায়। ২৬ জুলাই বুধবার এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত রিপোর্টটি দশ হাজারেরও বেশি পাঠক পড়েছেন। এ ঘটনায় কমিউনিটিতে প্রচণ্ড ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
এসিডে বদলে গেছে মুসা মিয়ার চেহারা:
এসিড হামলায় ২৩ বছর বয়সী মুসা মিয়ার চেহারা বদলে গেছে। গত মার্চে টাওয়ার হ্যামলেটসের ইস্ট ইন্ডিয়া ডকে মুসা মিয়ার উপর এসিড নিক্ষেপ করা হয়। এসিড নিক্ষেপের সময় সঙ্গে তার এক বন্ধুও ছিলেন। এরপর প্রায় ৩ সপ্তাহের বেশি সময় তাকে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। চ্যামসফোর্ড বার্ন ইউনিয়টে দুই দফা তাঁর স্কীনের অপারেশন করা হয়। প্রায় ১৫ শতাংশ ভিশন ক্ষমতা হারিয়েছে তার বাম চোখ। মুসা মিয়া জানান, এসিডে তার মুখের বাম পাশ ঝ¡লসে গিয়েছিল। তার চেহারা এমন হয়েছিল যে, তিনি নিজেকে নিজে দেখে ভয় পেতে পেতেন। এ জন্য হাসপাতালের রুমের সব গ্লাস কাপড় দিয়ে ডেকে রাখা হত, যাতে তিনি নিজের মুখে নিজে দেখতে না পারেন। এরপর প্রায় ৬ মাসের বেশি সময় তাকে ঘরে আটকে থাকতে হয়েছে।
মুসা মিয়ার উপর এসিড নিক্ষেপের অভিযোগে ২০ বছর বয়সী তরুণ এবং ১৬ বছর বয়সী এক কিশোরকে অভিযুক্ত করেছে পুলিশ। তাদেরকে গত এপ্রিল মাসে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে হাজির করা হয়। আগামী অক্টোবরে তাদেরকে স্নেয়ার্সব্রোক কাউন কোর্টে হাজির করা হবে। তবে ১৬ বয়সী বয়সী কিশোর এখনো পুলিশী হেফাজতে আছেন। আর ২০ বছর বয়সী ব্যক্তি আপতত জামিনে মুক্ত আছেন।