‘গার্ডেন্স অব পিস’ : ফুরিয়ে আসছে কবরের জায়গা
প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ জুলাই ২০১৭
তাইসির মাহমুদ: ‘গার্ডেন্স অব পিস’। পূর্ব লন্ডনে মুসলিম কমিউনিটির সর্বাধিক পরিচিত একটি গোরস্থান। মৃত্যুর পর শেষ ঠিকানার জন্য অনেকেই বেছে নেন এ জায়গাটি। পুম্প সুশোভিত, গাছ-গাছালিঘেরা এই বিস্তৃত গোরস্থানের পরিবেশ যে কাউকে আলোড়িত করে। ঘুরতে গেলে মনে হয়, সত্যিকার অর্থেই যেনো গার্ডেন্স অব পিস বা শান্তির বাগানে হেঁটে বেড়াচ্ছেন। সম্প্রতি এই গোরস্থানটি ঘুরে জানা গেলো অনেক অজানা তথ্য। সাপ্তাহিক দেশ’র পাঠকের জন্য তা তুলে ধরা হলো।
গত শতাব্দির শেষের কথা। পূর্ব লন্ডনের ইলফোর্ডের বাসিন্দা বৃটিশ-আফ্রিকান (পুর্বপুুরুষ ভারতীয়) ছয় বন্ধু মিলে গোরস্থানটি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। এদের মধ্যে একজনের নাম মোহাম্মদ ওমর। গার্ডেন্স অব পিস অফিসে কথা হয় গোরস্থান প্রতিষ্ঠার ইতিকথা ও বর্তমান অবস্থা নিয়ে।
মোহাম্মদ ওমর বলেন, আমরা দেখলাম আমাদের মুসলিম কমিউনিটি অনেকদূর এগিয়ে গেছে। কমিউনিটিতে সবকিছুই আছে। প্রতিটি এলাকায় মসজিদ আছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে। আমাদের পূর্ব পুরুষদের অক্লান্ত পরিশ্রমেই এসব হয়েছে। কিন্তু একটি জিনিস নেই। সেটি হলো আমাদের পরকালের ঠিকানা। যেই ভাবা সেই কাজ। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, একটি মুসলিম গোরস্থান প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আমরা বৃটেনের নাগরিক। আমাদের ছেলেমেয়ে এ দেশেই বড় হবে। এদেশেই আমরা মারা যাবো। আমাদের ও পরবর্তী প্রজন্মের জন্য মৃত্যুপরবর্তী স্থায়ী ঠিকানা প্রয়োজন। সেই পরিকল্পণা থেকে আমরা একটি চ্যারিটি সংস্থা রেজিস্টার করি। নাম দিই গার্ডেন্স অব পিস। একদিকে ফান্ড সংগ্রহ করতে থাকি। অন্যদিকে জায়গা খুঁজি। এক সময় বর্তমান হেইনুলটে ২১ একর জায়গা পেয়ে যাই। ৯৮ সালে জায়গাটুকু ক্রয় করে গোরস্থান প্রস্তুতের কার্যক্রম শুরু করি। প্লানিং পারমিশন লাভসহ অন্যান্য কার্যক্রম শেষ করে ২০০২ সালে কবরস্থানটি দাফন-কাফনের জন্য সম্পুর্ণ প্রস্তুত করতে সক্ষম হই। পুরোদমে শুরু হয় দাফন-কাফন। জানাজা ও দাফনের জন্য আগত মানুষের মধ্যে এক ধরনের প্রশান্তি দেখতেই পাই। কারণ সকলেই চান মৃত্যুর পরের ঠিকানাটি যেনো সুন্দর হয়, সংরক্ষিত থাকে।
মোহাম্মদ ওমর বলেন, গার্ডেন্স অব পিসে গত পনেরো বছরে সাড়ে ৯ হাজারেরও বেশি মানুষকে কবরস্থ করা হয়েছে। তবে এখন কবরের জায়গা ফুরিয়ে আসছে। অবশিষ্ট আছে মাত্র ৪শ’ কবর। আগামী নভেম্বরের মধ্যেই গোরস্থানটি পুর্ণ হয়ে যাবে। পঞ্চাশ বছর পর শুরু হবে দ্বিতীয়দফা দাফন তথা কবরের উপর কবর দেয়ার কাজ। তবে ইতোমধ্যে আমরা মুসলিম কমিউনিটির জন্য দ্বিতীয় ও তৃতীয় গোরস্থানের জায়গা কিনে তা দাফন কাফনের জন্য প্রস্তুত রেখেছি। মোহাম্মদ ওমর বলেন, গার্ডেন্স অব পিস সম্পুর্ণ অলাভজনক একটি চ্যারিটি সংস্থা। চ্যারিটির অর্থেই এটা চলে। স্থানীয় কাউন্সিল কিংবা সরকারী তরফ থেকে কোনো অনুদান নেয়া হয়না। এটি পরিচালিত হয় গার্ডেন্স অব পিস চ্যারিটির তত্ত্বাবধানে। চ্যারিটিই গোরস্থানের শতভাগ মালিক। সুতরাং এই জায়গা ভবিষ্যতে বেহাত হওয়ার আশংকা নেই। তিনি জানান, গার্ডেন্স অব পিসে ফুলটাইম পার্টটাইম সব মিলিয়ে প্রায় ৪০ জন মানুষ কাজ করেন। লাশ দাফনের ফি ও মানুষের দেওয়া দান থেকে প্রাপ্ত অর্থে পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চলে। দৈনন্দিন খরচের পর উদ্বৃত্ত থাকলে জমা রাখা হয় ভবিষ্যৎ গোরস্থান প্রতিষ্ঠার জন্য।
আয়ের অর্থে ইতোমধ্যে দ্বিতীয় ও তৃতীয় গার্ডেন্স অব পিসের জায়গা ক্রয় করে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। আগামী নভেম্বর থেকেই দ্বিতীয় গোরস্থানে দাফন-কাফনের কার্যক্রম শুরু হবে। বর্তমান গার্ডেন অব পিস থেকে মাত্র দুই মাইল দূরে চিগওয়েলের ফাইভ অকস লেইন এলাকায় ১৩ একর জায়গায় গোরস্থানটির অবস্থান। নতুন এই গোরস্থানে ৬ হাজার প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের কবর হবে। স্থানীয় কাউন্সিল থেকে ২০১৪ সালে পারমিশন লাভ করার পর ইতোমধ্যে ড্রেনেস ব্যবস্থাপনা, অভ্যন্তরিণ রাস্তা ঘাট পাকাকরণ, পার্কিং ব্যবস্থাপনা, সিসিটিভি সিকিউরিটি সিস্টেম স্থাপন, সীমানা প্রাচীর নির্মাণ, গাছ লাগানো ও দু’টি ভবন নির্মাণের কাজ শেষ করে ইতোমধ্যে কবরস্থানটি সম্পুর্ণ প্রস্তুত রাখা হয়েছে। দ্বিতীয় গোরস্থানটি পরিপূর্ণ হয়ে গেলে শুরু হবে তৃতীয় গোরস্থানের কাজ। সেটিও গার্ডেন্স অব পিস থেকে মাত্র ৭ মাইল দুরে অবস্থিত। রমফোর্ডের ম্যায়েল্যান্ড ফিলডস সাইটে। ২০০৭ সালে সেখানে ৩০ একর জায়গা কিনে গোরস্থান তৈরির কাজ চলছে। বছর তিনেকের মধ্যে গোরস্থানটি প্রস্তুত হয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। ওই জায়গায় ১২ হাজার কবরের সংস্থান হবে।
মোহাম্মদ ওমর আরো জানান, বর্তমানে ১০ফিট গভীর কবর খনন করে ৬ ফিটের মধ্যে লাশ দাফন করা হচ্ছে। উপরে চারফিট জায়গা আছে। তিন ফুটের গভীরতায় যেকোনো মৃতদেহ কবরস্থ করা যায়। বর্তমান গার্ডেন্স অব পিসের ১০ হাজার কবর ৫০ বছরের জন্য বন্দোবস্ত দেয়া হচ্ছে। এই সময় পর্যন্ত কোনো কবরই স্পর্শ করা হবে না। তবে ৫০ বছর পর প্রয়োজনে দ্বিতীয়দফা কবর দেয়ার কাজ শুরু হবে। অর্থাৎ কবরের উপর কবর দেয়া হবে। তবে মুল কবর অস্পর্শ থাকবে। তখন কবরে উপরে আরো দশ হাজার কবর দেয়া হতে পারে। এভাবে দ্বিতীয় ও তৃতীয় গার্ডেন্স অব পিসেও প্রথমদফা দাফন শেষে ৫০ বছর পর দ্বিতীয়দফা কবর দেয়া শুরু হবে। বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে ৫ জনের লাশ দাফন করা হয়। সেই হিসেবে চলতি বছরের নভেম্বর নাগাদ অবশিষ্ট ৪শ কবর শেষ যাবে।
তিনি বলেন, একটি লাশ কবর দেয়ার এক বছর পর সিডাম মেট নামক একধরনের ফুল কবরের উপর রূপন করা হয়। এই ফুলগাছগুলো কবরের উপরের নতুন মাটি বৃষ্টির পানিতে গলে যাওয়া থেকে রক্ষা করে। এই বিশেষ ফুল গাছটি কবরের উপরের মাটিকে আঁটার মতো ধরে রাখে। এরপর কবরে ন্যাইম প্লেট লাগানো হয়। লাশ প্রতি ফি জানতে চাইলে বিস্তারিত জানান মোহাম্মদ ওমর। বলেন, বয়সবেধে পৃথক পৃৃথক ফি। একজন প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ-মহিলার জন্য ফি হচ্ছে ৩ হাজার ৯০০ পাউন্ড। তবে কেউ ফিউনারেল সার্ভিস (লাশ বহন করে আনা, গোসল দেয়া ইত্যাদি) নিতে চাইলে দুরত্ব অনুযায়ী আরো ৬৫০ থেকে ৯৫০ পাউন্ড পরিশোধ করতে হয়।
শিশুদের কবরস্থ করার জন্য চার ক্যাটাগরির ফি রয়েছে। ১৭ মাসের চেয়ে কম বয়সী বাচ্চা মৃত ভুমিষ্ট হলে ৭৫ পাউন্ড। ১৭ মাসের চেয়ে বেশি বয়সী হলে ১৭৫ পাউন্ড। ভুমিষ্ট হওয়ার এক বছর পর্যন্ত মারা গেলে ৫শ পাউন্ড এবং ২ থেকে ১২ বছর পর্যন্ত শিশুর জন্য ৭৫০ পাউন্ড ফি নির্ধারিত রয়েছে। আর ফিউনারেল সার্ভিসের জন্য শিশুপ্রতি ফি ২৫০পাউন্ড। মোহাম্মদ ওমর বলেন, আমাদের নিজস্ব ফিউনালে সার্ভিস রয়েছে। কারো আত“ীয়-স্বজন ইন্তেকালের পর আমাদের সাথে যোগাযোগ করা হলে আমরা হাসপাতাল থেকে মরদেহ নিজস্ব অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে এসে গোসল ও কাফনের ব্যবস্থা করে থাকি। এছাড়া প্রয়োজনে মৃত্যুর পর লাশ আনার জন্য ডেথ সার্টিফিকেটেরও ব্যবস্থা করা হয়।
স্থানীয় স্কুল, ইয়ুথ ও স্কাউট গ্রুপকে আমন্ত্রণ জানিয়ে সময় সময় গোরস্থান পরিদর্শন করানো হয় যাতে তাঁদের ধর্মীয় জ্ঞান বৃদ্ধি পায়। গোরস্থানে প্রায়ই বৃক্ষরোপ কর্মসূচি থাকে। এসব কর্মসূচিতে অনেকেই সানন্দে অংশগ্রহণ করেন। এছাড়াও দাফন কাফন সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ কর্মশালাও আয়োজন করা হয় সময়-সময়। যেখানে অনেকেই অংশগ্রহণ করে দাফন সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন। ‘গার্ডেন্স অব পিস’ লাশ দাফন ও জেয়ারতের জন্য সরকারী ও ইসলামিক ছুটির দিনসহ বছরের ৩৬৫ দিনই খোলা থাকে। দিনের সর্বশেষ দাফন বিকেল ৪টার আগে শুরু করে ৫টার মধ্যে শেষ করতে হয়। গ্রীস্মকালে ১ এপ্রিল থেকে ৩০ সেপ্টম্বর পর্যন্ত সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৭টা পর্যন্ত এবং শীতকালে ১ অক্টোবর থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত গোরস্থান খোলা থাকে। প্রতি শুক্রবার দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে বিকেল ২টা পর্যন্ত জুমার নামাজের জন্য বন্ধ রাখা হয়।