বগুড়ায় মধ্যযুগীয় বর্বরতা
প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ আগস্ট ২০১৭
০ ধর্ষণের পর মা-মেয়ের মাথা ন্যাড়া করে শহর ছাড়ার হুমকী
০ ধর্ষক শ্রমিক লীগ নেতা তুফান চার সহযোগীসহ গ্রেফতার
ঢাকা প্রতিনিধি: বগুড়ায় ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশ করায় ধর্ষিতা কিশোরী ও তার মাকে লাঠিপেটা করে মাথা ন্যাড়া করে দিয়েছে সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনায় পুলিশ শ্রমিক লীগের চার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে পৌরসভার এক নারী কাউন্সিলরসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা হয়েছে। ২৮ জুলাই শুক্রবার গভীর রাতে বগুড়া সদর থানা পুলিশ শহরের চকসূত্রাপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে চারজনকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃতরা হচ্ছে শহর শ্রমিক লীগের সভাপতি তুফান সরকার, তার সহযোগী আলী আজম দিপু, আতিকুর রহমান ও রুপম হোসেন।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, বগুড়া বাদুড়তলা এলাকায় বসবাসকারী চা বিক্রেতার কিশোরী কন্যা শহরের জুবলী ইনস্টিটিউিশন থেকে এবার এসএসসি পাস করে। ওই কিশোরী কোথাও ভর্তি হতে না পারায় প্রতিবেশী আলী আজম দিপু তাকে শ্রমিক লীগ নেতা তুফান সরকারের মাধ্যমে সরকারি কলেজে ভর্তি করে দেয়ার প্রস্তাব দেয়। দিপু ওই কিশোরীকে মোবাইল ফোনে তুফান সরকারের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেয়। এরপর তুফান সরকার দিপুর মাধ্যমে ওই কিশোরীকে চার হাজার টাকা দিয়ে একটি কলেজে ভর্তির জন্য পাঠায়। কিন্তু ওই কিশোরী ভর্তি হতে না পারার বিষয়টি দিপুর মাধ্যমে তুফান সরকারকে জানায়।
গত ১৭ জুলাই তুফান সরকারের স্ত্রী-সন্তান বাসায় না থাকার সুযোগে ওই কিশোরীকে তার ক্যাডার বাহিনী দিয়ে বাসায় ডেকে আনে। এরপর দিনভর তাকে আটকে রেখে তুফান সরকার কয়েক দফা ধর্ষণ করে। এতে ওই কিশোরী অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরে তাকে চিকিৎসা দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। পাশাপাশি বিষয়টি কাউকে না বলার জন্য ভয়ভীতি দেখানো হয়। কিন্তু ধর্ষণের ঘটনাটি ওই কিশোরীর মা জানতে পারে এবং বিভিন্ন মাধ্যমে তুফান সরকারের স্ত্রীর কানে যায়। এরপর শুক্রবার বিকেলে তুফান সরকারের স্ত্রী আশা খাতুন, তার বড় বোন পৌরসভার সংরক্ষিত আসনের নারী কাউন্সিলর মারজিয়া হাসান রুমকি এবং তার মা রুমী বেগম ওই কিশোরীর বাড়িতে যায়। তারা ধর্ষণের ঘটনার বিচার করে দেয়ার কথা বলে ধর্ষিতা ও তার মাকে পৌর কাউন্সিলর রুমকির অফিস চকসুত্রাপুরে নিয়ে আসে। সেখানে বিচারের নামে ধর্ষিতাকে পতিতা আখ্যায়িত করে এবং মেয়েকে দিয়ে দেহ ব্যবসা করানোর উলটো অভিযোগ আনা হয়। এরপর তুফান সরকারের কয়েকজন সহযোগী লাঠিপেটা করে মা ও মেয়েকে। এরপর তারা নাপিত ডেকে এনে মা-মেয়েকে প্রথমে মাথার চুল কেটে দেয়া হয়। এক পর্যায়ে তুফান সরকারের স্ত্রীর নির্দেশে তাদের মাথা ন্যাড়া করে দেয়া হয়। শুধু তাই নয়, ২০ মিনিটের মধ্যে বগুড়া শহর ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার জন্য রিকশায় তুলে দেয়া হয়। ওই অবস্থায় তারা বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়। রাত ১১টার দিকে সদর থানা পুলিশ বিষয়টি জানতে পেরে হাসপাতালে গিয়ে মা ও মেয়ের বক্তব্য শুনে রাতেই অভিযান শুরু করে। রাত সাড়ে ১১টার দিকে তুফান সরকারকে তার বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর তার আরো তিন সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে। এদিকে তুফান সরকারকে গ্রেপ্তারের পর পরই তার স্ত্রী আশা খাতুন, স্ত্রীর বড় বোন পৌর কাউন্সিলর রুমকি এবং তুফানের শাশুড়ি রুমী বেগম আত্মগোপন করে। শনিবার এ ঘটনায় ধর্ষিতার মা মুন্নী বেগম বাদী হয়ে তুফান সরকারসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেন। ওই মামলায় গ্রেপ্তারকৃত চারজনকে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে।
শনিবার দুপুরে বগুড়া সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (গণমাধ্যম) সনাতন চক্রবর্তী তার কার্যালয়ে এক প্রেস ব্রিফিং-এ উপরোক্ত তথ্য জানান। তিনি সাংবাদিকদের বলেন মা ও মেয়েকে নির্যাতন করে মাথা ন্যাড়া করে দেয়ার ঘটনায় জড়িত সবাইকে গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশি তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। আমরা কি আর এই শহরে থাকতে পারব? ‘এখন তো আপনারা আছেন, পুলিশও আসছে। কিন্তু হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর আমরা কি আর এই শহরে থাকতে পারব? একবার তো ইজ্জতের ওপর দিয়ে গেছে, এবার যাবে জীবন। আসলে গরিব মানুষের কোথাও জায়গা নাই।’
বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিছানায় বসে কথাগুলো বলতে বলতে মাথা নিচু করে ওড়না দিয়ে চোখ মুছছিল ধর্ষণের শিকার মেয়েটি। আক্ষেপ করে বাকরুদ্ধ কণ্ঠে সে বলে, ‘কোথাও কোনো ঘটনা ঘটলে আমি মানুষের জন্য রাস্তায় দাঁড়াইছি। মানববন্ধন করেছি, সমাবেশ করেছি। এখন আমার জন্য মানুষ এসব করছে। ইজ্জত গেল, অনেক শখের চুল ছিল মাথায়, তা-ও গেল। আমার জীবনের আর থাকল কী?’ মেয়েটির মা এ সময় পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। নির্যাতনের পর দুজনেরই মাথা ন্যাড়া করে দিয়েছে তুফানের সহযোগীরা। ওড়নায় ঢাকা মেয়ের মাথার দিকে তাকিয়ে মা বললেন, ‘মারধরের পর তুফানের বউ আমার বেটির চুল টেনে ধরে বলল, “তোর মাথায় ম্যালা চুল। এই চুল দিয়া তুফানেক পাগলা করচু? দাঁড়া, তোর চুল কাটমু।” বলেই চুল কাটা শুরু করে দিল। মেয়েটা কতবার হাতে পায়ে ধরল। কিছুই শুনল না।’ মায়ের কথা আর শেষ হয় না। বলেই যাচ্ছেন, ‘তুফানের লোক আতিক বাড়ির সামনে পিকআপ নিয়ে আইলো। বললো, ৩০ মিনিটের মধ্যে মালপত্র নিয়া বগুড়া ছাড়। আর কোনো দিন যেন বোগড়াতে না দেখি। পরে তুফানের ভাই জাহাঙ্গীর আইসা বলল, ঠিক আছে ৩০ মিনিট না, দুই দিন থাকতে পারবু, তারপর যাবু।’
বগুড়ার শহর শ্রমিক লীগের আহ্বায়ক তুফান সরকার ১৭ জুলাই মেয়েটিকে তাঁর ক্যাডার দিয়ে বাসায় তুলে নিয়ে ধর্ষণ ও নির্যাতন করেন। তুফানের স্ত্রী তখন বাড়িতে ছিলেন না। পরে মেয়েটিকে ভয়ভীতি দেখিয়ে সহযোগী আতিকুর রহমানের সঙ্গে তার বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সোমবার হাসপাতালে মা-মেয়ের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। দুদিন থেকেই হাসপাতালের ওয়ার্ডে বেশ জটলা। জেলা পুলিশ পাহারা বসিয়েছে। চিকিৎসক-নার্সের ভিড়। ঘন ঘন সাংবাদিকেরা আসছেন, আসছেন এলাকার মানুষ। রাজনৈতিক দলের নেতারাও আসছেন। সকালে আসেন বগুড়া-১ আসনের সাংসদ আবদুল মান্নান। মিডিয়াকে তিনি বলেন, এই পরিবারের ওপর যা হয়েছে তা অমানবিক। এসব খারাপ লোকের দায় দল নেবে না। এদের বিচার হবেই।
সাংসদের সঙ্গে ছিলেন হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম মাসুদ আহসান। তিনি বললেন, ‘মা-মেয়ে হাসপাতালে আসার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের যা যা করার ছিল করেছি।’ সার্জারি বিভাগের প্রধান আবদুল মোত্তালিব হোসেন বলেন, মেয়েটিকে অনেক মারধর করা হয়েছে। শরীরের সাত-আট জায়গায় দাগ আছে। মেয়েটা এখনো ট্রমায় আছে। এটা কাটতে সময় লাগবে। মেয়েটি আরও বলল, ‘মারধরের পরও আমি তো ভয়ে কাউকে কিছু বলিনি। তুফানের বউ আশা এসএমএস করে বলেছে, “তোর জন্য আমার স্বামীর যদি কিছু হয় মাডার করে জেল খাটমু।” হাসপাতালে আসার পর ডাক্তার সব শুনলেন, এরপর পুলিশ এল। আমি বললাম, আমার কিছু হয়নি। কিন্তু পুলিশ বলল, “ভয় নাই সব খুলে বলো আমরা তোমাদের সঙ্গে আছি।” এরপর সব বলি।’
মেয়েটির মা জানান, তাঁর আর সন্তান নেই। স্বামী ছোট ব্যবসা করেন। একমাত্র মেয়েটি এবার এসএসসি পাস করল। ভালো কলেজে ভর্তির সুযোগ হয়নি। তিনি ১০-১২ দিন আগে মেয়েকে নিয়ে ঢাকায় যান। হঠাৎ শুনতে পান বগুড়ায় তাঁর বাড়িতে কাউন্সিলর মার্জিয়া আক্তারের লোক আতিক, মুন্না, দিপু, পারভেজ এসে তালা দিয়েছে। এর কারণ তিনি প্রথমে বুঝতে পারেননি। কারণ, ১৭ জুলাই ধর্ষণের ঘটনা ঘটলেও প্রাণ ভয়ে মেয়ে তা প্রকাশ করেনি। ঢাকা থেকে গত বৃহস্পতিবার (২৭ জুলাই) বাড়ি এসে দেখেন, ঘরে তালা। সেদিন তিনি অন্যের বাড়িতে থাকেন। পরদিন শুক্রবার দুপুরে মা-মেয়ে যান কাউন্সিলর মার্জিয়া আক্তারের বাসায়। মার্জিয়া তুফানের স্ত্রী আশার বোন। মেয়েটির মা বলেন, ‘কাউন্সিলর আমাদের দেখেই জ্বলে ওঠে। মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়েই লাঠি দিয়ে মারধর শুরু করে। ফোন করে তুফানের লোকজনকে ডেকে আনে। ওরা এসে আবার আমাদের অনেক মারধর করে। তুফানের বউ একটা কাঁচি নিয়ে এসে প্রথমে মেয়ের মাথার চুল কেটে দেয়। এরপর আমার চুল কেটে দেয়। তুফানের লোক আতিক ও মুন্না এসে বলে, এভাবে হবে না। নাপিত ডাকো। এরপর নাপিত এসে আমার ও মেয়ের চুল কেটে ন্যাড়া করে দেয়। মারধর ও চুল কাটার পর পাহারা দিয়ে তারা আমাদের বাসায় নিয়ে আসে। আতিক বাসার তালা খুলে দিয়ে বলে, বাইরে পিকআপ রেডি আছে। সব মালপত্র নিয়ে ৩০ মিনিটের মধ্যে বগুড়া ছেড়ে চলে যাও। পরে তুফানের ভাই এসে দুই দিন থাকার সুযোগ দেয়।’ মা আরও বলেন, বাসায় এসে মেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে। তখন প্রতিবেশী মুরগি বিক্রেতা রুবেল হোসেন এগিয়ে আসেন। তিনি মেয়েকে হাসপাতালে নিতে বলেন। শুক্রবার রাতেই তাঁরা হাসপাতালে ভর্তি হন।
সোমবার দুপুরে রুবেল হোসেনের খোঁজে তাঁর চকসূত্রাপুরের বেগম বাজারের বাসায় গেলে তাঁর ছেলে তামিম জানায়, ওই মেয়েটি ও তারা এক বাড়িতেই থাকে। কাউন্সিলরের লোকজন তালা দেওয়ার পর তারাও ভয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। বাড়িটি আট দিন তালাবদ্ধ ছিল। এলাকার লোকজন বলেছেন, তুফানের ভাই মতিন সরকার বগুড়া জেলা ট্রাক মালিক সমিতির নেতা। তুফানের সব অপকর্মের নেপথ্যে এই ভাই। তুফানের চামড়া গুদাম লেনের বাসায় গেলে কেউ কোনো কথা বলতে রাজি হননি। বাড়িটি তালা দেওয়া। পাশেই তুফানের ভাই মতিন সরকারের বাড়ি। দুপুরে দিকে তিনি বাড়িতে থাকলেও সাংবাদিক পরিচয় শুনে আর কথা বলেননি। হাসপাতালে আসার পর কোনো হুমকি এসেছিল কি না জানতে চাইলে মেয়েটির মা বলেন, ‘২৮ জুলাই শুক্রবার রাতেই হাসপাতালে লোক পাঠিয়েছিল তুফান। আমাকে বলেছে, “মামলা তুলে নাও, মেয়েকে বিয়ে করবে তুফান।” না হলে নাকি আমাদের অনেক ক্ষতি হবে।’