রাবিনা খানের সার্জারিতে সেদিন যা ঘটেছিলো (সরেজমিন প্রতিবেদন)
প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ মার্চ ২০১৮
ফয়সল মাহমুদ:
বাঙালি অধ্যুষিত টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের নির্বাচনে মেয়র পদে প্রার্থী পিপলস অ্যালায়েন্স দলের লীডার রাবিনা খান ও অ্যাস্পায়ার দলের মেয়র প্রার্থী অহিদ আহমদের মধ্যে ঘটে যাওয়া অপ্রীতিকর ঘটনা টক অব দ্যা কমিউনিটিতে রূপ লাভ করেছে। গত ১ মার্চ রাবিনা খানের সার্জারিতে ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার ডালাপালা মেলতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে সংবাদ সম্মেলন থেকে শুরু করে পুলিশ পর্যন্ত গড়িয়েছে ঘটনাটি। আগামী ৩ মে’র টাওয়ার হ্যামলেটস নির্বাচনকে সামনে রেখে দুই প্রার্থী এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছেন।
রাবিনা খান অভিযোগ করেছেন, কাউন্সিলার অহিদ আহমদ ও কাউন্সিলার মাহবুব আলম অনুমতি ছাড়া তাঁর সার্জারিতে ঢুকে তাঁকে হুমকি-ধামকি দিয়েছেন যা তিনি পুলিশকে অবহিত করেছেন। এদিকে অহিদ আহমদ কাউন্সিলার রাবিনা খানের এই অভিযোগ অস্বীকার করে পালটা অভিযোগ করে বলেছেন, আমরা গিয়েছিলাম স্থানীয় একজন বাসিন্দার সঙ্গে দেখা করতে। আমরা জানতাম না সেখানে তাঁর সার্জারি। আমাদেরকে দেখে তিনি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে আমাদের অকথ্য ভাষায় আক্রমণ করেছেন। এই ঘটনার স্বাক্ষী রয়েছেন। দু’জনের পরস্পর বিরোধী বক্তব্যের প্রেক্ষিতে সাপ্তাহিক দেশ’র পাঠকদের জন্য এ প্রতিবেদক সরেজমিন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
সরেজমিনে গত ১২ মার্চ বুধবার দুপুরে ঘটনাস্থল শাডওয়েলের গ্লামিস হলে উপস্থিত হয়ে দেখা যায়, শ্যাডওয়েলের ওশেন চিলড্রেল সেন্টারের পাশে অবস্থিত গ্লামিস হল। হলের মূল প্রবেশপথ ছাড়াও দু’টি করিডোর দিয়ে হলে ঢোকার পথ রয়েছে। কিন্তু করিডোর দু’টির প্রবেশদ্বারে সাটার রয়েছে। করিডোর পাড়ি দিয়ে মূল হলে প্রবেশ করতে হয়। করিডোরটি প্রায় ২০ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ২৫ ফুট প্রস্থ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ১ মার্চ গ্লামিস হলে সার্জারি করছিলেন পিপলস অ্যালায়েন্স পার্টির মেয়র প্রার্থী কাউন্সিলার রাবিনা খান। ওইদিন সকালে বারার বাসন্দিা হ্যারি হোয়াইট ও শিলা স্মিথ অ্যাপোয়েন্টমেন্ট করে গ্লামিস হলে আসেন রাবিনা খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। তাঁরা দু’জনই সাক্ষাৎ করার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এসময় সার্জারিতে প্রায় ১৫জন রেসিডেন্ট ছিলেন। সকাল সাড়ে ১১টার দিকে মেয়র প্রার্থী কাউন্সিলার অহিদ আহমদ, কাউন্সিলার মাহবুব আলম, মাহবুব আলমের স্ত্রী অ্যাসপায়ার দলের সম্ভাব্য কাউন্সিলার প্রার্থী ফারহানা আক্তার ও কাউন্সিলার প্রার্থী শাহীন আহমদ সার্জারির করিডোরে ঢুকেন। এক পর্যায়ে মেয়র প্রার্থী অহিদ আহমদ, উপস্থিত স্থানীয় বাসিন্দা হ্যারি হোয়াইট ও শিলা স্মিথকে নিয়ে সার্জারির বাইরের দিকে যেতে উদ্যত হলে সার্জারির ভেতর থেকে বিষয়টি দেখে এগিয়ে আসেন রাবিনা খান। এসে তাদের জিজ্ঞেস করেন- কেন তাঁর রেসিডেন্টদেরকে বের করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে; যারা তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য অপেক্ষা করছেন? এসময় তিনি আরো জানতে চান- তাঁরা কেন তাঁর প্রাইভেট সার্জারিতে এসেছেন। এ নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয় করিডোরে। এক পর্যায়ে অ্যাসপায়ারের সম্ভাব্য কাউন্সিলার প্রার্থী শাহীন আহমদ ও ফারহানা আক্তার করিডোর থেকে বেরিয়ে যান। তখন দু’পক্ষের বাকবিতন্ডা উত্তেজনায় রূপ নেয়। পরে হ্যারি হোয়াইট ও শিলাকে নিয়ে অহিদ আহমদ ও মাহবুব আলম ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। এরপর কাউন্সিলার রাবিনা খান ঘটনাটি পুলিশ ও কাউন্সিলের মনিটরিং অফিসারকে রিপোর্ট করা ছাড়াও ২ মার্চ শুক্রবার সংবাদ সম্মেলন করে সাংবাদিকদের অবহিত করেন।
ঘটনার দিন সার্জারিতে উপস্থিত থাকা প্রত্যক্ষদর্শী রোশনারা বেগম এ প্রতিবেদককে বলেন, ওইদিন কাউন্সিলার অহিদ আহমদ ও কাউন্সিলার মাহবুব আলমসহ অন্যরা সার্জারিতে ঢুকে হ্যারি হোয়াইট ও শিলা স্মিথকে নিয়ে যেতে চাইলে রাবিনা খান বাধা দেন। এসময় মাহবুব আলম কাউন্সিলার রাবিনা খানের দিকে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে বলেন, “এটা পাবলিক প্রোপার্টি, আমরা আসতে পারি, যে কারো সঙ্গে কথা বলতে পারি”। তুমি বাধা দেবার কে? এ সময় রাবিনা খান মাহবুব আলমকে বলেন, এটা আমার প্রাইভেট সার্জারি। এখানে অনুমতি ছাড়া প্রবেশ নিষেধ। ঘটনা সম্পর্কে রাবিনা খান বলেন, তাঁরা সংঘবদ্ধ হয়ে আমার সার্জারিতে আমাকে অপমান করার জন্য প্রবেশ করেন। তাঁরা যখন আমার রেসিডেন্টদের নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন আমি এটা আমার প্রাইভেট সার্জারি, এখানে অনুমতি ছাড়া প্রবেশ নিষেধ বললে, কাউন্সিলর অহিদ আহমদ উত্তেজিত হয়ে আঙ্গুল উচিয়ে আমাকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেন এবং গালিগালাজ করেন। এ বিষয়ে কাউন্সিলর মাহবুব আলমের বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা এতো নোংরা রাজনীতি এখনো শিখিনি যে, আমার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে ভাবিকে (রাবিনা) অপমান করতে যাবো। আমরা ভাবির জন্য বিগত নির্বাচনে ক্যাম্পেইন করেছি। তিনি আমাদের পরিবারের মানুষ। আমার ঘরের কাছে এই হল হওয়ায় আমি আমার স্ত্রী ফারহানা আক্তারকে নিয়ে গিয়েছিলাম হ্যারি হোয়াইটের সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু ‘ভাবি’ এভাবে ঘটনাকে রং মাখাবেন জানতাম না। আমাদের দেখে তিনি মাথা ঘরম করে উলটাপালটা কথা বলতে থাকেন।
আপনি কি জানতেন এটি রাবিনা খানের সার্জারি? -এমন প্রশ্নের জবাবে মাহবুব আলম বলেন তিনি জানতেন না। কিন্তু রাবিনা খানের বক্তব্য হচ্ছে, মাহবুব আলম অবশ্যই জানেন এটি আমার সার্জারি। কারণ তিনি কাউন্সিলার নির্বাচিত হওয়ার আগে স্থানীয় অনেক বাসিন্দাকে নিয়ে একাধিকবার এখানে এসেছেন। তাঁর ঘর আমার সার্জারি থেকে মাত্র ৪/৫টি ঘরের দুরত্বে অবস্থিত। তাছাড়া, গ্লামিস হাউজ থেকে যে নিউজলেটার বের হয় তাতে আমার সার্জারির বিজ্ঞাপন রয়েছে। এই নিউজলেটার মাহবুব আলমসহ স্থানীয় প্রায় সকল বাসিন্দার ঘরে নিয়মিত বিতরন হয়। সুতরাং তিনি আমার সার্জারির অবস্থান সম্পর্কে ভালো করেই জানেন। তিনি বলেন, ঘটনার পর বিভিন্ন টিভি ইন্টারভিউতে তাঁরা বলেছেন, আমি তাদের প্রতি আক্রমনাত“ক ব্যবহার করেছি। কিন্তু আমার প্রশ্ন, আমি আক্রমনাত“ক আচরণ করলে তারা কেন পুলিশে অভিযোগ করেননি।
অ্যাম্পায়ার দলের মেয়র প্রার্থী কাউন্সিলর অহিদ আহমদ বলেন, ওয়াপিং রেইঞ্জ ম্যানশন সেন্টারটি বন্ধ হওয়ার উপক্রম। তাই সেন্টারটি খোলা রাখার জন্য হ্যারি হোয়াইট আমাকে সাহায্য করতে বলেছিলেন। এরই প্রেক্ষিতে একটি পিটিশন আমাকে দেওয়ার জন্য গ্লামিস হলে আসার জন্য বলেন। আমরা হ্যারির সঙ্গে দেখা করতে সেখানে গেলে রাবিনা খান আমাদের গালাগালি করেন। আমাদের পুলিশে দেওয়ার হুমকি দেন। আমরা তার ব্যবহারে লজ্জিত হয়ে ফিরে আসি।
ঘটনার দিন উপস্থিত ছিলেন পাশের রোডের বাসিন্দা খায়রুল ইসলাম। তিনি বলেন, কাউন্সিলার অহিদ আহমদ ও তাঁর সঙ্গীরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হলে ঢুকে রাবিনা খানকে অপমান করেছেন। যা অত্যন্ত লজ্জাকজনক। আমি রাবিনা খানকে প্রায় ৩ বছর থেকে এখানে সার্জারি পরিচালনা করতে দেখে আসছি। গ্লামিস হলের ম্যানেজার স্টিভ মিল বলেন, এটা রাবিনা খানের প্রাইভেট সার্জারি। তিনি এখানে দীর্ঘদিন থেকে সার্জারি পরিচালনা করে আসছেন। এখানে অনুমতি ছাড়া দলবদ্ধ হয়ে ঢোকা ঠিক নয়।
ঘটনার দিন সকালে শিলা স্মিথ অ্যাপোয়েন্টমেন্ট করে কী প্রয়োজনে রাবিনা খানের সার্জারিতে তাঁর সাক্ষাতপ্রার্থী হয়েছিলেন-বিষয়টি জানা যায়নি। তিনি কি একই বিষয়ে অর্থাৎ রেইঞ্জ সেন্টার খোলা রাখার ব্যাপারে রাবিনা খানের সহযোগিতা চাইতে তাঁর সার্জারিতে গিয়েছিলেন, আর কাউন্সিলার অহিদ আহমদ এবং মাহবুব আলম নিজেদের নির্বাচনী সুবিধার্থে তাঁকে সেখান থেকে বের করে নিয়ে তাঁর পক্ষে ক্যাম্পেইন করতে চেয়েছিলেন- বিষয়টি স্পষ্ট নয়। কারণ শিলা স্মিথের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাঁকে পাওয়া যায়নি। তবে বিষয়টি নিয়ে এ প্রতিবেদকের অনুসন্ধান অব্যাহত আছে। এ ব্যাপারে জানতে পুলিশের সঙ্গে সাপ্তাহিক দেশ থেকে যোগাযোগ করা হলে, পিসি লারা সুইটম্যান বলেন, ১ মার্চ বৃহস্পতিবার ক্যাবল স্ট্রিটের গ্লামিস হলে দু’পক্ষের মধ্যে বাক-বিতণ্ডাকে কেন্দ্র করে একটি পাবলিক অর্ডার অফেন্স রেকর্ড করা হয়েছে। এই অভিযোগ তদন্ত চলছে।
উল্লেখ্য, টাওয়ার হ্যামলেটসের আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যে পুলিশ ৩৩টি অভিযোগ রেকর্ড করেছে। এরমধ্যে ৬টি অভিযোগ গুরুতর- যা ফৌজধারী অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।