বীভৎস পাশবিকতা : কেন আসে করোনাভাইরাসরা?
প্রকাশিত হয়েছে : ১০:৫৪:৩৩,অপরাহ্ন ১৭ মার্চ ২০২০
তাইসির মাহমুদ :: একটি ভিডিওটি বিভিন্ন হাত বদল হয়ে আমার হোয়াটসঅ্যাপে এসোছিলো সপ্তাহ তিনেক আগে । আমরা এক বন্ধু পাঠিয়ে বলেছিলেন, “আপনারা তো লেখালেখি করেন। এই ভিডিওটা নিয়ে কিছু লিখবেন । পারলে আপনার পত্রিকায় একটি রিপোর্ট করবেন” । তাঁকে বলেছিলাম লিখবো, রিপোর্টও করবো। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে হয়ে ওঠেনি । করোনা-ভাইরাসজনিত কারণে দু’দিন ধরে পরিবারের সাথে ঘরে আছি । ভাবলাম তাহলে এই সময়টা কাজে লাগানো যায় ।
ভিডিওতে ভাইরাল হওয়া ঘটনাটি কবে, কখন ঘটেছে জানি না । তবে এটি সৌদির কোনো এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘটেছে এটি ভিডিওদাতার ভাষ্য থেকে অনুমান করা যায় । ভিডিওটি দেখে আমি কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে যাই। এসব কী দেখছি আমি? এই আধুনিক সভ্যতার যুগে মানুষের ওপর এভাবে মধ্যযুগীয় কায়দায় বর্বরতা চলতে পারে- এটি বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় । দারুন কষ্ট।
ভিডিও’র অস্পষ্ট কথাবার্তা থেকে যা বুঝতে পারলাম তাহলো- সৌদি আরবের কোনো প্রত্যন্ত অঞ্চলে মাজরা বা শস্যক্ষেত এলাকায় কর্মরত একজন বাংলাদেশীর ওপর এই অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়েছে । তার দেশের বাড়ি সিলেটের নূর নগর এলাকায় । সম্ভবত ভারত হয়ে তিনি সৌদি গেছেন । তাকে তারই এলাকার আফতাব আলী নামক ব্যক্তির ছেলে ‘মাজরা ভিসা’য় সৌদি পাঠিয়েছেন । মাজরা ভিসার কাজ হলো- শস্যক্ষেত পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা । মালিকপক্ষের লোকজন মাজরায় এলে তাদের খেদমত করা । পান-তামাক চা-কফি, ঘাওয়া বানিয়ে পরিবেশন করা । হালকা পাতলা কাজ । মাসে বেতন ১২শ রেয়াল । পাঁচ মাস আগে তিনি সৌদিতে গেছেন। একমাসের বেতন দেয়া হয়েছে। বাকি চার মাসের কোনো বেতন দেয়া হয়নি। বেতন চাইলেই তাকে মারধর করা হয় । উপরন্ত বেতন না চাইলেও মারা হয় । কেন মারা হয় তিনি তা জানেন না। তার কী দোষ তাও তিনি জানেন না।
কী ধরনের মারধর? মারধর বলতে আমরা বুঝি কিছু কিল ঘুষি কিংবা লাঠিপেটা । কিন্ত এটাকে কি মারধর বলা যায়? এটা হলো পাশবিক নির্যাতন। মধ্যযুগীয় বর্বরতা । নির্যাতনে তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। উলঙ্গ করে চারটি খুঁটির মধ্যে দুই হাত ও দুই পা শক্ত করে টেনে বেঁধে রেখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্লাস্টিকের লাঠি দিয়ে পেটানো হয়েছে। প্লাস দিয়ে নাক কেটে দেয়া হয়েছে। প্লাস্টিকের পাইপ দিয়ে খুঁচিয়ে দুই কান ও চোখে মারত্মক যখম করা হয়েছে। কান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সবচেয়ে ভয়ংকর বর্ণনা হচ্ছে, দিনেরবেলা প্রচণ্ড রৌদে উত্তপ্ত বালুতে গলায় রশি লাগিয়ে গাড়ির সাথে বেধে হেঁচড়ানো হয়েছে । কখনো দুই পায়ে রশি লাগিয়ে গাড়ির পেছনে বেঁধে পাথরের উপর হেঁচড়ে টানা হয়েছে। গোটা শরীর একেবারেই ক্ষতবিক্ষত। শরীরে তিল পরিমাণ অক্ষত জায়গা নেই। চোখ দিয়ে পানি বের হচ্ছে। শরীর থেকে বের হচ্ছে পুঁজ ।
এই অবস্থা থেকে তাকে উদ্ধার করেছেন তারই এলাকারই কিছু প্রবাসী । ৫ ঘণ্টা ড্রাইভ করে অনেক কষ্টে সেই মাজরা এলাকায় তারা পৌছতে সক্ষম হয়েছেন । তাকে উদ্ধার করে তাদের ম্যাসে নিয়ে এসেছেন।
নির্যাতিত এই মানুষের চিকিৎসা করাতে পারছেন না । হাসপাতালে নিয়ে গেলে তাকে চিকিৎসা দেওয়া হবে না । কারণ তার হেলথ কার্ড নেই। প্রথমদিন কর্মস্থলে যাওয়ার পরই তার পাসপোর্ট ওয়ার্কপার্মিট, হেলথ কার্ডসহ যাবতীয় কাগজপত্র কফিল বা নিয়োগকর্তা নিয়ে গেছেন । এখন এলাকার প্রবাসীরা ফার্মেসী থেকে ওষুধ কিনে এনে তাকে খওয়াচ্ছেন।
তাকে সহসা সহজে বাংলাদেশেও পাঠানো যাবে না । কারণ তার পাসপোর্ট সেই । দেশে পাঠাতে হলে পুলিশের কাছে রিপোর্ট করতে হবে । আর পুলিশের কাছে গেলে তাঁকে জেলে যেতে হবে । কতদিন জেলে থাকতে হবে তা কেউ জানে না। তাই ক্ষতবিক্ষত শরীর নিয়ে অনিশ্চিত জীবনে ধুকে মরছেন তিনি।
এই হলো একটি মুসলিম দেশে এক মুসলমান কর্তৃক আরো এক মুসলমানের প্রতি উপহার । কী দোষ ছিলো তার? এই লোক কি দোষ করতে পারে? দোষের কিছুই নেই ।
আমি নিজে সৌদি আরবের মাজরা এলাকা ঘুরে দেখেছি । মাজরা হচ্ছে জনমানবহীবন একটি এলাকা। সেখানে বিদ্যুৎ গ্যাস থাকেনা । যোগাযোগ ব্যবস্থা বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের চেয়েও আরো খারাপ। ছোট একটি ছাপড়া ঘরে থাকতে হয় । খাট নেই। বিদু্যৎ নেই। গ্যাস নেই। ৪২ ডিগ্রি গরমের মধ্যে ফ্যান ছাড়া মোমবাতির ক্ষীণ আলোয় ভোরের আশে প্রতিটি রাত কাটে।
সৌদি সরকার তাদের দেশের যুবসমাজকে কর্মমুখী করতে এই মাজরাগুলো বরাদ্দ দিয়ে থাকে। তারা সেখানে কিছু খাজুর গাছ লাগায় । টমোটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি ও আলু ক্ষেত করে । কিছু ভেড়া ও হাঁস, মোরগ লালন পালন করে । এগুলো পালনের জন্য বাংলাদেশ থেকে মাসিক ১০/১২ হাজার টাকা বেতনে শ্রমিক আনে । তাদের কাজ হয় মাজরাগুলো দেখাশোনা করা । সৌদি যুবকেরা তার বন্ধুবান্ধব নিয়ে এলে সেখানে ভেড়া বা দুম্বা পুড়িয়ে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে হয় । চা-কফি-ঘাওয়া শিশা পরিবেশন করা ইত্যাদিই মুল কাজ । মুলত সৌদি যুবকদের একটা আমোদ-প্রমোদের জায়গা হলো মাজরা।
কিন্তু এই মাজরা ব্যবসার আড়ালে রয়েছে শ্রমজীবী গরীব মানুষের ওপর নির্যাতনের বীভৎস কাহিনী। কিভাবে নির্যাতন করা হয় এই ভিডিওটি তার একটি প্রমাণ । ওরা কি মানুষ? ওরা কি মুসলমান? দোষ করলেও তো মানুষ এভাবে মানুষকে নির্যাতন করতে পারে না । কিন্তু এই ব্যক্তির দোষ কী। কোনো দোষ নেই। বিনাদোষে নির্যাতন।
এসব হলো বিকৃত মানসিকতা। এটা এক ধরনের উন্মাদনা। মানুষ মানুষকে নৃশংস ও বর্বর কায়দায় নির্যাতন করে আনন্দ উপভোগ করে । একজন মানুষের কষ্ট দেখলে সাধারণত: মানুষের কষ্ট লাগার কথা । কিন্তু মানুষ নামক এই নরপশুরা দুর্বল মানুষকে নির্যাতন করে তার কান্না, চিৎকার, কষ্ট দেখে উল্লাস করে আনন্দ পায়। এরা উন্মাদ, পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট।
একটি মুসলিম দেশ । কিন্তু এত অন্যায় নির্যাতনের শিকার হওয়ার পর বিচার পাওয়া দুরে থাক, বিচার চাওয়ারও সুযোগ নেই। বিচার কার কাছে চাইবে? পুলিশের কাছে যাবে? সেখানে গেলে তো নিজে নিজের আরো বড় বিপদ ডেকে আনবে । পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে নানা ছলে নির্যাতন করে কারাগারে বন্দী করে রাখবে । আদালতে কি বিচার আছে? কী বিচার? বাংলাদেশীরা তো কললু মিসকিন । তাদের আবার বিচার কিসের? অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, প্রবাসী শ্রমজীবীরা সৌদিদের দাস? বাংলাদেশীরা যাবে তাঁদের দাসত্ব করতে । আর তারা নির্যাতন করবে । যেভাবে ইচ্ছা তাদেরকে খাটাবে, নির্যাতন করবে । কোনো কথা বলা যাবে না। প্রতিবাদও করা যাবে না । কারণ ওরা বাংলাদেশী । ওরা গরীব। গরীবের আবার বিচার কি?
বলার আর কিছু নেই । ভিডিওটি দেখে চোখের পানি আটকে রাখতে পারিনি । একবারই দেখছি কষ্ট করে । দ্বিতীয়বার দেখার ইচ্ছা ছিলো বিষয়টি ভালোভাবে বুঝার জন্য। কিন্তু সাহস করতে পারিনি। আমার হার্টবিট কাঁপছিলো।
একটা কথা বলে শেষ করবো । আজ আমরা যারা করোনা ভাইরাসের কথা বলছি। কেউ কেউ বলেন, চীন সরকারের পাপের বোঝা বিশ্ববাসীকে বহন করতে হচ্ছে । চীনে মুসলিম নির্যাতনের কারণেই এই ধরনের গজব এসেছে বলে অনেকেই মনে করেন । কিন্তু ভিডিওটি দেখে কি মনে হয়না, সৌদিতে এই বর্বর নির্যাতনের কারণে এমন গজব আসতে পারে? চীন তো অমুসলিম দেশ। সেখানে অমুসলিমেরা মুসলমানদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে। কিন্তু সৌদি তো মুসলিম রাষ্ট্র। সেখানে মুসলমানরাই মুসলমানদের ওপর এমন জঘন্য বীভৎস নির্যাতন চালাচ্ছে। এরেচেয়ে জঘণ্য আর কী হতে পারে?
এটা কি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা? সৌদিতে কর্মচারী নির্যাতন কি নতুন কিছু? অহরই তো এমন নির্যাতনের কাহিনী মিডিয়ায় শীরোনাম হচ্ছে । নারী-কর্মীদের কীভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে? তা তো ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।
এই ভিডিওর ঘটনাটি অস্পষ্ট। তবে এটি পরিস্কার করা সম্ভব । বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় বিষয়টি আমলে নিলে এটা সম্ভব। মন্ত্রণালয় চাইলে সৌদি দুতাবাসের সাথে যোগাযোগ করে নির্যাতনের রহস্য উদঘাটন করতে পারে । সৌদি দুতাবাস পুলিশের সাথে যোগাযোগ করে নির্যাতনকারীদের বিচারের মুখোমুখী করতে পারে । না হলে এভাবে প্রবাসী বাংলাদেশীদের ওপর বর্বর নির্যাতন চলতেই থাকবে । বাংলাদেশীদের শুধু নির্যাতন সহে যেতে হবে ।
তবে বাংলাদেশীদেরও সতর্ক ও সচেতন হওয়া প্রয়োজন। নিজ দেশে দুই বেলা ডাল-ভাত খেয়ে ভালোভাবে সম্মানের সাথে বাঁচবেন নাকি ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় এভাবে দালালের খপ্পরে পড়ে পরবাসে গিয়ে বীভৎস নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরবেন? । ভালো-মন্দ বিচারের ভার নিজেকেই নিতে হবে।
লন্ডন, যুক্তরাজ্য
রোববার, ১৫ মার্চ ২০২০