এনআরবি ব্যাংকের ৩ পরিচালকের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান : শত শত কোটি টাকা বিদেশে পাচার
প্রকাশিত হয়েছে : ১:০৯:২৩,অপরাহ্ন ২১ জানুয়ারি ২০২১

এনআরবি ব্যাংক ডাইরেক্টর নাফিহ রশিদ খান, নাভিদ রশিদ খান, বদিউজ্জামান
দেশ ডেস্ক, ২২ জানুয়ারি : মানিলন্ডারিংয়ের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচারে একের পর এনআরবি ব্যাংকের ডাইরেক্টরদের নাম উঠে আসছে। গত বছর ডিসেম্বরে মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগে জাতীয় পত্রিকায় খবরের শিরোনাম হন এনআরবি ব্যাংকের পরিচালক মোহাম্মদ বদিউজ্জামান, যিনি ৩৮২ কোটি টাকার মালিক। তার বিরুদ্ধে শত শত কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগ উঠে।
আর এবার অর্থপাচারের অভিযোগ ওঠেছে এনআরবির আরো দুই পরিচালকের বিরুদ্ধে। তারা হলেন দুই সহোদর নাফিহ রশিদ খান ও নাভিদ রশিদ খান। বিডিনিউজ২৪ডটকম-এ প্রকাশিত সংবাদের বরাতে জানা যায়, মানিলন্ডারিং মাধ্যমে বিদেশে অর্থপাচারসহ জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে এনআরবি ব্যাংকের দুই পরিচালক নাফিহ রশিদ খান ও নাভিদ রশিদ খানের এবং তাদের বাবা আমিনুর রশিদের ব্যাংক হিসাবের তথ্য চেয়ে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কাছে চিঠি দিয়েছে দুদক। রোববার (১৭ জানুয়ারি) দুদক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
জানা যায়, দুর্নীতি, অনিয়ম, কর ফাঁকি এবং বিদেশে হুন্ডি কারবারের মাধ্যমে বিপুল অর্থবিত্ত গড়েছেন আমিনুর রশিদ খান ও পরিবার। বাবার সুবাদে দুই ছেলে এনআরবি ব্যাংকের পরিচালক হয়েছেন। সংযুক্ত আরব আমিরাতে রয়েছে ফ্ল্যাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। মানিলন্ডারিং মাধ্যমে বিদেশে অর্থপাচারসহ জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে বাংলাদেশ ব্যাংকের বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কাছে তথ্য চেয়ে চিঠি দিয়েছে দুদক। তাদের নামে দেশে-বিদেশে কোনো চলতি বা সঞ্চয়ী ব্যাংক হিসাব, স্থায়ী আমানত, শেয়ার, লকারসহ অন্যান্য ব্যাংক হিসাব থাকলে বিবরণী চাওয়া হয়েছে। এছাড়া স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি থাকলে সে তথ্যও চেয়েছে দুদক। দুদকের অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, আমিনুর রশিদ খান সিঙ্গাপুর কেন্দ্রিক হুন্ডি ব্যবসায়ের অংশীদার এনআরবি ব্যাংকের পরিচালক এম বদিউজ্জামান, তার স্ত্রী নাসরিন জামান ও মেয়ে তানিয়া জামান। এ চক্রের আরেক সহযোগী ইউরোপের হুন্ডি ব্যবসায়ী ইদ্রিস ফরায়জী। তার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল এক্সচেঞ্জের মাধ্যমেই বিদেশে অবৈধ উপায়ে অর্থপাচার করা হয় বলে অভিযোগ আছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, দেশে-বিদেশে আমিনুর রশিদ খান এবং তার ছেলের নামে বিভিন্ন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে দেশ ট্রেডিং করপোরেশন, বাল্ক ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, জব্বার জুট মিলস লিমিটেড, বাংলাদেশ মেডিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি লিমিটেড, হাইড্রোকার্বন, এম ইশরাত হিমাগার লিমিটেড। এ ছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাতে রয়েছে জেনট্রেড এফজেডই (ইন্টারন্যাশনাল কমোডিটি ট্রেডিং) ইউএই, কমোডিটি ফাস্ট ডিএমসিসি (ইন্টারন্যাশনাল কমোডিটি ট্রেডিং) ইউএই, লোচ শিপিং ইন্টারমিডিয়ারি এফজেই (ইন্টারন্যাশনাল কমোডিটি ট্রেডিং) ইউএই। আমিনুর রশিদ খান এবং তার দুই ছেলের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের অনুসন্ধানের দায়িত্বে রয়েছেন দুদকের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ সিরাজুল হক ও উপসহকারী পরিচালক মো. সহিদুর রহমানের সমন্বয়ে দুই সদস্য বিশিষ্ট একটি টিম। (সূত্র: বাংলানিউজ২৪ডটকম, ১৭ জানুয়ারি ২০২১)
৩৮২ কোটি টাকার মালিক বদিউজ্জামান :
এদিকে বাংলাদেশে শত শত কোটি টাকার সম্পদ থাকলেও কোনো আয়কর নথি নেই। বাংলাদেশ ও সিঙ্গাপুরের দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকা এনআরবি ব্যাংকের পরিচালক মোহাম্মদ বদিউজ্জামান ৩৮২ কোটি টাকার মালিক। তার বিরুদ্ধে শত শত কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগ উঠেছে। বদিউজ্জামানের বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থ পাচার ও নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণের সম্পদ অর্জনের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে অনুসন্ধান চালাচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রকৃত সম্পদের পরিমাণ জানতে বদিউজ্জামান এবং তার দুই স্ত্রী নাসরিন জামান ও তৌহিদা সুলতানাকে সম্প্রতি সম্পদ বিবরণী দাখিলের জন্য দুদক নোটিস দিলেও তারা এর জবাব না দিয়ে সিঙ্গাপুরে পালিয়ে গেছেন বলে জানা গেছে। জানা গেছে, বিপুল সম্পদের মালিক হয়েও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে বদিউজ্জামান কখনো আয়কর রিটার্ন জমা দেননি। শুধু ব্যবসায়িক প্রয়োজনে ২০১৪ সালে তিনি ই-টিআইএন নিয়েছেন। দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে তার বিরুদ্ধে অ্যাডভান্স হোম প্রাইভেট লিমিটেড ও ফিনিক্স লিমিটেডের বিশাল অঙ্কের শেয়ার কেনা ও বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ ছাড়াও বিপুল পরিমাণের অবৈধ সম্পদ অর্জনের তথ্য পাওয়া গেছে।
দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা গেছে, ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলায় প্রায় ১০ কোটি টাকা মূল্যের ১৪৮ বিঘা জমির ওপর বদিউজ্জামানের অ্যাডভান্স ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক রয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে জোয়ার সাহারা মৌজার জগন্নাথপুরে ১১ কাঠা জমিতে তৈরি করা ৯ তলা আবাসিক ভবন, যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ১৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া বারিধারা এলাকায় তার স্ত্রীর নামে প্রায় ১০ কোটি টাকা মূল্যের আবাসিক ভবন। গোপালগঞ্জ জেলা সদরে রয়েছে প্রায় ৩৫০ বিঘা জমির ওপর অ্যাডভান্স নিরালা ও অ্যাডভান্স সুগন্ধা নামে আবাসিক প্রকল্প। এ ছাড়া রয়েছে গোপালগঞ্জ সদরে সার্কিট হাউজ রোডে বিলাসবহুল আবাসিক বাড়ি। এসব স্থাবর সম্পদের আনুমানিক মূল্য ধরা হয়েছে প্রায় ৩৩২ কোটি টাকা।
এ ছাড়া অস্থাবর সম্পদের মধ্যে রয়েছে ফিনিক্স ইনস্যুরেন্স লিমিটেডে বদিউজ্জামানের নামে প্রায় ২০ কোটি টাকার শেয়ার, এনআরবি ব্যাংক লিমিটেডে প্রায় ৩০ কোটি টাকার শেয়ার, সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক লিমিটেডের দুটি শাখায় সঞ্চয়ী হিসাব, এনআরবি ব্যাংকসহ বেশ কয়েকটি ব্যাংক হিসাব মিলিয়ে প্রায় ৪৫ লাখ টাকা থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ধরা হয়েছে প্রায় ৫০ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। বদিউজ্জামানের পরিবারের সদস্যদের নামে অঙ্গন রেস্টুরেন্ট, তানিয়া ট্রেডিং প্রাইভেট লিমিটেড, তানিয়া ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট লিমিটেড ও এশিয়া প্যাসিফিক রিয়ালিটি ইনভেস্টমেন্ট সার্ভিস নামে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মালিকানার অচ্চিত্ব পেয়েছে দুদক। দুদকের সহকারী পরিচালক সিরাজুল হক ও উপসহকারী পরিচালক সহিদুর রহমান অনুসন্ধানের দায়িত্ব পালন করছেন।
গত ৭ সেপ্টেম্বর বদিউজ্জামান ও তার দুই স্ত্রী যথাক্রমে নাসরিন জামান ও তৌহিদা সুলতানার সম্পদ বিবরণী দাখিলের জন্য নোটিস দেয় দুদক। সংস্থার পরিচালক কাজী শফিকুল আলম কমিশনের অনুমোদনক্রমে এই নোটিসে স্বাক্ষর করেন। ওই নোটিসের মাধ্যমে তাদের অর্জিত স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ও দায়দেনাসংবলিত সম্পদ বিবরণী নোটিস প্রাপ্তির ২১ কার্যদিবসের মধ্যে কমিশনে দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু এখনো তারা তাদের সম্পদের হিসাব দাখিল করেননি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকেও বদিউজ্জামান ও তার দুই স্ত্রী, ছেলের হিসাব চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আয়কর অধ্যাদেশের ধারা ১৩৩ এফ অনুযায়ী এনবিআরের সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেলের উপপরিচালক ওয়াকিল আহমদের স্বাক্ষরে এ চিঠি দেওয়া হয়। এনআরবি ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, দেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হওয়ার প্রথম দিক থেকে মোহাম্মদ বদিউজ্জামান সপরিবারে সিঙ্গাপুরে চলে যান। এরপর আর তারা দেশে ফেরেননি।
দুদক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বদিউজ্জামানের অনেক সম্পদ হলেও সব তার নিজের নামে নয়। কোনোটি তার প্রথম স্ত্রী, কোনোটি তার দ্বিতীয় স্ত্রীর নামে কেনা। আবার কিছু আম্নীয়ের নামেও রয়েছে। এসব যাচাই-বাছাই শেষে বলা যাবে কার নামে কী পরিমাণ সম্পদ আছে।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, বদিউজ্জামান বাংলাদেশ ও সিঙ্গাপুরের জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্টধারী। সিঙ্গাপুরের জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর-ই২১৩১৭৭৬বি ও পাসপোর্ট নম্বর ই৫৬৬৭৭২৯এন। তাকে রেকর্ডপত্রসহ গত বছরের ৪ নভেম্বর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা হলেও হাজির না হয়ে লিখিত বক্তব্য দাখিল করেন। যেখানে তিনি জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেননি বলে দাবি করেন। (সূত্র: দৈনিক দেশ রূপান্তর, ৭ ডিসেম্বর ২০২০)