সুরত মিয়া থেকে রফিকুল : ২৫ বছরে ৭ লাশ, আর কত প্রাণ যাবে?
প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ আগস্ট ২০২২
দেশ রিপোর্ট:: ২৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট। ১০দিন পেরিয়ে গেলেও কোনো কুল-কিনারা হয়নি সিলেটের ওসমানীনগরে প্রবাসী পিতা-পুত্রের রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনার। এই ঘটনায় সিলেট ওসমানী হাসপাতালের আইসিইউতে থাকা তিনজনের মধ্যে দুজন বাড়িতে ফিরেছেন। তাঁরা হলেন নিহত রফিকুল ইসলামের স্ত্রী হোসনে আরা বেগম ও পুত্র সাদিকুল ইসলাম । তবে মেয়ে সামিরা ইসলামের অবস্থা আশংকাজনক হওয়ায় এখনও আইসিইউতে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
বুধবার (৩ জুলাই) হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে তাজপুরের সেই বাসায় ফিরে যান রফিকুল ইসলামের স্ত্রী-পুত্র। একই সময়ে তাদের সাথে কথা বলতে তাজপুর যান সিলেটের পুলিশ সুপার মুহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন ও সিনিয়র কর্মকর্তারা । তাঁরা হোসনে আরা বেগমের সাথে কথা বলে মিডিয়ায় ব্রিফিং দেন ।
পুলিশ সুপার জানান, প্রবাসী পরিবার যে ঘরে থাকতেন সেখানে একটি জেনারেটর ছিলো । বিদ্যূৎ চলে গেলে জেনারেটরটি চালানো হতো । আর তখন জেনারেটর থেকে ধোঁয়া নির্গত হতো । ধোঁয়ার কারণে তাদের শ্বাস নিতে কষ্ট হতো । ঘটনার দিন রাতে দীর্ঘসময় জেনারেটর চালু ছিলো। এতে করে সাফোকেশনের (শ্বাসরোধ) কোনো সমস্যাও হতে পারে । এই কথাগুলো হোসনে আরা বেগম পুলিশ সুপারকে জানিয়েছেন। ঘটনাস্থল পরিদর্শনকালে ঘরের একটি রুমে সেই জেনারেটরটিও পাওয়া যায়। তাই পুলিশ সুপার বলছেন, আপাতত ধারণা করা হচ্ছে, জেনারেটরের ধোঁয়ায় শ্বাস বন্ধ হয়ে প্রবাসী পিতা-পুত্র মারা যেতে পারেন । তবে খাদ্যে বিষক্রিয়ার ধারণাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না । সব কিছু মিলিয়ে ফরেনসিক তদন্ত চলছে । খুব শীঘ্রই রিপোর্ট চলে আসবে এবং মৃত্যূর প্রকৃত রহস্য উদঘাটিত হবে বলে আশা করছেন তিনি । তবে এ ঘটনার নেপথ্যে কোনো নিকট-আত্মীয়ের হাত থাকতে পারে বলে প্রথম দিকে ধারণা করা হলেও পুলিশ তা থেকে সরে আসছে।
উল্লেখ্য, গত ২৬ জুলাই যুক্তরাজ্য-প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও তার ছোট ছেলে মাইকুল ইসলামের রহস্যজনক মৃত্যু হয় । ১২ জুলাই রফিকুল ইসলাম ছেলের চিকিৎসার জন্য সপরিবারে দেশে যান। ২৬ জুলাই মঙ্গলবার সকালে সিলেটের ওসমানীনগরে একটি বাসা থেকে অচেতন অবস্থায় ৫ জনকে উদ্ধার করে সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক রফিকুল ইসলাম ও তাঁর ছোট ছেলে মাইকুল ইসলামকে মৃত ঘোষণা করেন। আশঙ্কাজনক অবস্থায় বাকি তিনজনকে হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগে ভর্তি করা হয়। ময়না তদন্ত শেষে ঘটনার পরদিন বিকেলে মৃত বাবা-ছেলের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করে পুলিশ । পরে উপজেলার দয়ামীর ইউনিয়নের বড় ধিরারাই গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে তাদের দাফন করা হয়।
সুরত মিয়া থেকে রফিকুল- ২৫ বছরে ৭ লাশ :
জীবন-জীবিকার তাগিদে তারা দেশ ছেড়ে বিলেতে এসেছিলেন । দীর্ঘদিন বিলেতে থাকার পর দেশ ও পরিবারের টানে তারা এক সময় দেশে ফিরলেও তাদের আর কোনোদিন বিলেতে ফেরা হয়নি । কারণ নিজ দেশে গিয়ে তারা নির্মমভাবে প্রাণ হারিয়েছেন । গত ২৫ বছরে ৭ ব্রিটিশ বাংলাদেশী দেশে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন । পৃথক এসব ঘটনায় অনেক অন্দোলন সংগ্রাম হয়েছে। কিন্তু বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও আজ অবধি এসব ঘটনার কোনো বিচার হয়নি। ফলে নিহতের পরিবারের পাশাপাশি প্রবাসীদের মাঝে ক্ষোভ আর হতাশা বাড়ছে।
নিউ ক্যাসেলের সুরত মিয়া : ১৯৯৬ সালের ৯ মে । বৃটেনের নিউ ক্যাসেলের রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী বৃটিশ বাংলাদেশি সুরত মিয়া (৩৫) কে.এল.এম-এর একটি ফ্লাইটে ঢাকা বিমানবন্দেরে নামেন । সেখানে কাস্টমস লাউঞ্জে দায়িত্বরত কাস্টমস কর্তকর্তারা তাঁর কাছে ঘুষ দাবি করেন। ঘুষ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে এর প্রতিবাদ করেন সুরত মিয়া । একপর্যায়ে কাস্টমস কর্তকর্তারা মিলে তাকে নির্মমভাবে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে । পরে তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে ওইদিনই তিনি মারা যান । সুরত মিয়া সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার সৈয়দপুরের বাসিন্দা ছিলেন । নির্মম এ হত্যাকাণ্ডের খবর ছড়িয়ে পড়লে সর্বস্তরের মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়েন । তারা সুরত মিয়ার হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। কিন্তু কিছুদিন পর সেই আন্দোলনও থেমে যায় । কয়েক মাস পর সুরত মিয়া হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে চারজনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশীট জমা দেওয়া হয় । কিন্তু প্রমাণের অভাবে অভিযুক্তরা পার পেয়ে যায় । সুরত মিয়া হত্যার প্রায় ২৫ বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত এ হত্যাকাণ্ডের বিচার পায়নি তার পরিবার।
মোগল কুরাইশি : ২০০১ সালের জুন মাসে বাংলাদেশে বেড়াতে যান ব্রিটিশ বাংলাদেশি যুবক মোগল কুরাইশি (২২)। দেশে কিছু দিন থাকার পর তিনি লন্ডনে ফেরার সময় ঢাকায় বিমানের নির্ধারিত ট্রানজিট হোটেল থেকে সকালে অপহরণ হন । তাকে ছাড়াই বিমানের ফ্লাইট ছাড়ে লন্ডনের উদ্দেশ্যে। দুইদিন পর ঢাকা বিমানবন্দরের ১০ মাইল দূর থেকে উদ্ধার করা হয় তার লাশ । ঘটনা তদন্তের পর পুলিশ জানায়, পাসপোর্ট ছিনিয়ে নিতে মোগল কুরাইশিকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার পর লন্ডনে বিমান অফিস ঘেরাও করে আন্দোলন করা হয় । কিন্তু দীর্ঘ ২২ বছরেও সেই ঘটনার বিচার হয়নি ।
রচডেলের হাজী তাহির আলী: ২০১১ সালের ২৬ জুন । জমি সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে দেশে গিয়ে সিলেটের বিশ্বনাথে নিজ বাড়িতে দুর্বৃত্তদের হামলায় নিহত হন ব্রিটেন প্রবাসী হাজী তাহির আলী। তিনি বৃটেনের রচডেল এলাকার বাসিন্দা ছিলেন। এ ঘটনার ১১ বছর পেরিয়েছে। কিন্তু আজও তার বিচার হয়নি।
রেহানা বেগম: ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই। পূর্ব লন্ডনের স্টেপনী গ্রীন এলাকার বাসিন্দা রেহানা বেগম তাঁর দেশের বাড়ি সুনামগঞ্জের পাটলিগ্রামে বেড়াতে গিয়ে নির্মমভাবে খুন হন। অভিযোগ ওঠে, রেহানার নিজের কয়েকজন আত্মীয় টাকা ও সোনার জন্য নিজ সন্তানের সামনে তাঁকে ১৮ বার ছুরিকাঘাত করে হত্যা করেন। ঘটনার প্রায় ৯ বছরেও এই হত্যাকাণ্ডের বিচার পায়নি নিহতের পরিবার।
জালাল উদ্দিন : ২০১৮ সালের ৬ জানুয়ারি মৌলভীবাজার শহরের শীমঙ্গল সড়কের পাশে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে খুন হন ব্রিটিশ বাংলাদেশি জালাল উদ্দিন । তাকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ ওঠে । ঘটনার পর জালালের শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। নিহত জালাল হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলার ইনাতগঞ্জের তফতিবাগ এলাকার মৃত মোঃ গিয়াস উদ্দিনের ছেলে।
স্বজনরা জানান, জালাল উদ্দিন ঘটনার ৭/৮ মাস আগে লন্ডন থেকে দেশে যান। মাদকাসক্ত থাকায় তাকে মৌলভীবাজার শহরের শ্রীমঙ্গল সড়কের পাশে মাদক নিরাময় “উদ্দীপন মাদক নিরাময় কেন্দ্রে” ভর্তি করে দুই সপ্তাহ চিকিৎসা শেষে ওই বছরর ২৪ ডিসেম্বর বাড়ি নেওয়া হয়। পরে ২৯ ডিসেম্বর তাকে আবার ওই নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করা হয়। পরে ৬ জানুয়ারি সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে থেকে জানানো হয়, জালাল অসুস্থ হয়ে পড়েছেন । তাকে সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে । এ খবর পেয়ে স্বজনরা দ্রুত সিলেটে যান এবং হাসপাতালে খোঁজাখুঁজি করে জালালকে পাননি ।পরে মৌলভীবাজার ফিরে এসে উদ্দীপন মাদক নিরাময় কেন্দ্রের সামনে একটি অ্যাম্বুলেন্সের ভেতর তার মৃতদেহ দেখতে পান।
রফিকুল ইসলাম ও মাইকুল ইসলাম : সর্বশেষ ২৬ জুলাই লন্ডন প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও তার ছোট ছেলে মাইকুল ইসলামের রহস্যজনক মৃত্যু হলো সিলেটের ওসমানীনগরের তাজপুর বাজারের ভাড়া বাসায় । এই ঘটনারও প্রকৃত রহস্য উদঘাটন হবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। (খবর: রানার মিডিয়া থেকে ট্রান্সস্ক্রিপ্ট এ.জে লাভলু)।