বাংলাদেশের সংবিধান ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আমার ভাবনা
প্রকাশিত হয়েছে : ০৮ আগস্ট ২০২৩
আব্দুস সহিদ
বর্তমান ক্ষমতাশীন দলের শীর্ষ নেতারা প্রায়শই একটি কথা বলে থাকেন যে, সংবিধানের বাইরে এক চুল নড়া যাবেনা, অর্থাৎ বর্তমান সংবিধানের আলোকেই তারা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে চান। যে সংবিধান ২০১১ সালে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে নিজের মত করে সংশোধন করে নিয়েছে বর্তমান সরকার। আমি এই বিষয়ে দুটি কথা বলতে চাই।
আমাদের সবার মনে আছে, মাগুরার একটি মাত্র উপনির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুলে, বর্তমান ক্ষমতাশীন আওয়ামীলীগ, তখনকার সময় বিরোধী দলে থাকাকালীন, জামায়াতের দেয়া ফর্মুলা ‘নিরপেক্ষ তত্তাবধায়ক সরকার’ ব্যবস্থার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। জাতীয় পার্টি ও জামায়াতকে সাথে নিয়ে ১৭৩ দিন হরতাল/অবরোধের নামে, দেশের জান/মালের বিশাল ক্ষতি সাধন করে দলটি। শেখ হাসিনার নির্দেশে, লগী বৈঠা দিয়ে ঢাকার রাজপথে সর্পের মত মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করে,লাশের উপর নিত্য করে এই আওয়ামীলীগ।
সরকারে থাকা বিএনপি, প্রথম দিকে রাজী না হলেও পরবর্তীতে জনণের দাবীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ৯৬ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ‘নির্দলীয় তত্তাবধায়ক সরকার’ ব্যবস্থা সংবিধানে সন্নিবেশিত করে বিএনপি এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৫২ বছরে মোট ১১ বার সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮-এই চারটি নির্বাচন বাংলাদেশের মানুষের কাছে নিঃসন্দেহে গ্রহণযোগ্যতা পায়। যদিও ২০০৮ সালে সেনা সমর্থিত সরকারের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ ছিল। এরপরও এই চারটি সংসদ নির্বাচন উত্তম নির্বাচন বলে জাতীর কাছে বিবেচিত হয়েছে।
২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করার পর নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানটি সংশোধন করার উদ্যোগ গ্রহণ করে।
আওয়ামীলীগের সংসদীয় বোর্ড, সুপ্রিম কোর্টের ইমিকাস কিউরি, সবকটি রাজনৈতিক দল (আওয়ামীলীগসহ) সুশীল সমাজ এবং দেশের আপামর জনগন ‘নিরপেক্ষ তত্তাবধায়ক সরকার’ ব্যবস্থার পক্ষে মতামত দেয়। কিন্তু হঠাৎ করে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বেকে বসেন এবং তার একক সিদ্ধান্তে, তৎকালীন প্রধান বিচারপতি খায়রুল হককে (অবসরে যাওয়ার পর) দিয়ে আওয়ামীলীগ সরকার বিতর্কীত একটি রায়ের মাধ্যমে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানটি সংবিধান থেকে বাতিল করে নেয়।
যদিও সেই রায়ে আগামী দুই মেয়াদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে পারে বলে পরিস্কার উল্লেখ করা হয়। আওয়ামীলীগ যখন বুঝতে পারল, নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে তার দল নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় যেতে পারবেনা তখনই তারা সুকৌশলে, আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে নিজের লোক দিয়ে এই বিধানটি বাতিল করে নেয়। তারাই জন্ম দিল, আবার নিজ হাতে তারাই হত্যা করল। এই হল আওয়ামীলীগের নীতি।
বিগত ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামীলীগ ১৫৩ আসনে বিনাপ্রতিদ্বন্ধিতায় এবং ২০১৮ সালে আগের রাতে ভোট কেটে বাংলাদেশের ইতিহাসে দুটি নিকৃষ্ট নির্বাচনের উদাহরণ সৃষ্টি করে শাসক। যা অতীতের সকল নির্বাচনকে হার মানিয়েছে। দেশে এবং বিদেশে হয়েছে নিন্দিত।
সংবিধান হচ্ছে- সেফটি অব দ্যা পিপল। সংবিধান কোন পবিত্র ধর্মগ্রন্থ নয় যে, তা পরিবর্তন করা যাবেনা। জনগণের জন্যই সংবিধান, জনগণের কল্যাণে সংবিধান সর্বদা পরিবর্তন যোগ্য।
আমাদের দেশের সংবিধান ১৭ বার পরিবর্তন করা হয়েছে। শেখ মুজিব তার সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে ৪ বার সংবিধান পরিবর্তন করেছেন। সুতরাং সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগনের প্রয়োজনে আরেকবার সংবিধান সংশোধন করতে অসুবিধা কোথায় ?
আরেকটা কথা আমাদের মনে রাখা দরকার, ১৯৯১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধিনে যে নির্বাচন হয়েছে, তা কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী হয়নি। তিন দলের রুপরেখা অনুযায়ী সেদিন সংবিধানের বাইরে গিয়ে, বিচারপতি শাহাব উদ্দিনকে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করে, নির্বাচন করা হয়েছে। যা পরবর্তীতে সংবিধানে সন্নিবেশিত করা হয় এবং বিচারপতি শাহাব উদ্দিন তার নিজ কর্মে ফিরে যান। ২০০৮ সালে সেনা সমর্থিক সরকার দুই বছর ক্ষমতায় থাকা এবং নির্বাচন কোনটাই সংবিধানের আলোকে হয়নি। সুতরাং ১৯৯১ সালে সংবিধানের বাইরে গিয়ে নির্বাচন করতে পারলে এবার কেন সম্ভব নয় ?
আওয়ামীলীগের নেতারা আমাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমানকে পলাতক বলে আখ্যায়িত করেন। এ বিষয়ে তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, তারেক জিয়া পলাতক নয়, তিনি অচিরেই বীরের বেশে বাংলাদেশে আসবেন। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না আওয়ামীলীগ নেত্রী শেখ হাসিনা ও সেদিন ভারতে পালিয়ে গিয়েছিলেন? তার পিতা মারা যাওয়ার পর ও দেশে যাননি তিনি। দীর্ঘদিন বিদেশে ছিলেন। জিয়াউর রহমান তাকে দেশে এনে রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়েছেন। তিনি পালিয়েছিলেন বলেই আজ স্বদেশ পত্যাবর্তন দিবস পালন করা হয়। অতএব কোনো কিছু বলার আগে আয়নায় নিজের চেহারাটা দেখে নেওয়া উচিত।
সেদিন বেশী দূরে নয় যেদিন তারেক রহমান বাংলাদেশে আসবেন, সেদিন জনগনের বাঁধ ভাঙা জোয়ারে ঢাকা অচল হয়ে যাবে। এখানে একটি কথা স্মরণ রাখা দরকার, ইরানের খোমেনি ত্রিশ বছর ফ্রান্সে নির্বাসিত ছিলেন। ৩০ বছর পর যেদিন ইরানের মাটিতে পা রাখেন, সেদিন ইরানের ‘শাহ’ হেলিকপ্টার করে পালিয়ে প্রাণে রক্ষা পান।
পরিশেষে একটি কথা বলতে চাই, ইতিহাস সাক্ষী, শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্থান্তর করা না হলে, গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে অথবা যে কোন অঘটনের মাধ্যমে তার পরিসমাপ্তি ঘটে। জোর করে, চিরদিন ক্ষমতায় থাকা যায়না। শেখ মুজিব ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বাকশাল করে আজীবন ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পারেননি। সুতরাং আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল লক্ষ, সাম্য , সামাজিক ন্যায়বিচার , মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, জনগণের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে এনে, দল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে, প্রত্যক্ষ ভোটে, জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে, এটাই হোক আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : প্রভাষক, আয়ারল্যান্ড প্রবাসী