ঠান্ডা, ফ্লু না অন্যকিছু : শীতকালিন অসুস্থতা আপনি কীভাবে চিহ্নিত করবেন?
প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ অক্টোবর ২০২৩
শরৎকাল শুরু হয়েছে। রাতগুলো দীর্ঘ হচ্ছে। শীতের মাসগুলোতে দীপাবলী বা বড়দিনের মতো উৎসবগুলো উদযাপনের জন্য আমরা মূলত ইনডোরেই সমবেত হই। এ সময় কফ ও স্নিফেল এড়ানো কঠিন হয়ে যায়। কিন্তু আমরা কফ, ফ্লু বা অন্যকিছুতে আক্রান্ত হয়েছি কিনা তা কী করে জানবো?
সাউথ লন্ডনের জিপি ডা. মোহাম্মদ নাগভি বলেন, ‘আমাদের লক্ষণগুলো কতটা গুরুতর এবং কতটা দ্রুততার সঙ্গে সমস্যাগুলো শুরু হয়েছে তা থেকে বিষয়টি অনেকাংশেই বোঝা সম্ভব হতে পারে । ঠান্ডা, ফ্লু ও কোভিড আলাদা ভাইরাসে সৃষ্টি হয়। তবে এসব অসুস্থতার লক্ষণ
একই।
ঠান্ডায় আপনার নাক ও গলা বেশি আক্রান্ত হয়। এগুলো খুব বেশি গুরুতর নয় । ফ্লুয়ের তুলনায় এগুলোতে আক্রান্ত হতেও সময় বেশি লাগে। অন্যদিকে ফ্লুতে আক্রান্ত হতে খুব কম সময় লাগে। অনেক ক্ষেত্রে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এর লক্ষণ প্রকাশ পেতে শুরু করে।
ডা. নাগভি আরো বলেন, ‘এসব অসুস্থতা সাধারণত নিজ থেকেই সেরে যায়। তবে আপনার কফের সঙ্গে যদি রক্ত আসে বা শ্বাসকষ্ট শুরু হয় তাহলে দ্রুত চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। জরুরি সহায়তার প্রয়োজন থাকলে দ্রুত ৯৯৯-এ ফোন করে যোগাযোগ করুন।‘
আপনার যদি তিন সপ্তাহের বেশি সময় কফ থাকে তাহলে জিপি বা এনএইচএসে ১১১ নম্বরে ফোন করুন। এ ধরনের কাশি ভালো নয় এবং এগুলোর দ্রুত অবনতি হয়। এছাড়া আপনার যদি বুকে ব্যথা থাকে, শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, ঘাড়ের গ্রন্থিগুলো ফুলে যায়, দ্রুত ওজন কমতে থাকে বা আপনি যদি অসুস্থ বোধ করেন এবং দুর্বল রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থা থাকে তাহলে দ্রুত এনএইচএসের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। আপনার যদি কখনো কোভিড হয়ে থাকে বা এর লক্ষণ থাকে তাহলে আপনি Your COVID recovery ওয়েবসাইটে যোগাযোগ করতে পারেন।
এটা কি কোভিড?
কোভিড নাইন্টিন আর ফ্লু দুটো আলাদা অসুস্থতা। দুই ক্ষেত্রেই শ্বাসযন্ত্র আক্রান্ত হয়। দুটি রোগের লক্ষণেও বেশ মিল আছে। কিছু মানুষের জন্য কোভিড বা ফ্লু আক্রান্ত হওয়া কিছুটা অস্বস্তিকর হতে পারে । তবে আপনার বয়স যদি বেশি হয়, আপনি যতি গর্ভবতী হন বা কয়েক ধরনের শারীরিক জটিলতা থাকে এই রোগ আপনার প্রাণঘাতি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
লন্ডনের জিপি তাহসিন খানের মতে, ‘কোভিডের এক নতুন ধরন পিরোলা ইউকেজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। সেক্ষেত্রে আপনাকে পরীক্ষা করার পরামর্শ দেয়া হতে পারে এবং অন্য কারো সংস্পর্শে না যাওয়ার নির্দেশনাও দেয়া হবে। আপনাকে ঘন ঘন হাত ধোয়ার কথা মনে রাখতে হবে। বিশেষ করে হাঁচি-কাশির পর। এছাড়া ফেইস মাস্ক ব্যবহার করুন এবং সামাজিক দূরত্ব রক্ষার বিধিনিষেধগুলো মেনে চলুন।”
প্রতিকারের চেয়ে প্রতিষেধক ভালো
ডা. খান বলেন, ‘আপনার যদি কোভিড ও ফ্লুতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়তে থাকে এবং আপনাকে যাদি টিকা নেয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয় তাহলে আপনার উচিত দ্রুত টিকা নিয়ে নেয়া। গত শীতে কোভিড ও ফ্লুয়ের ভ্যাকসিন দেয়ার পর হাজারো মানুষের প্রাণ বেঁচেছে এবং বহু মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হওয়া এড়াতে পেরেছে।‘
বিশেষজ্ঞ ও ইউকে হেলথ সিকিউরিটি এজেন্সির (ইউকেএইচএসএ) মতে, ওমিক্রনের পর ইউকেতে ছড়িয়ে পড়া সবচেয়ে গুরুতর কোভিডের ভ্যারিয়েন্ট হচ্ছে পিরোলা। ২০২১ সালের শেষ দিকে ইউকেতে ওমিক্রণ ছড়িয়ে পড়ে । আপনার বয়স যদি ৬৫ বা তারচেয়ে বেশি হয়, আপনি যদি গর্ভবতী হন তাহলে আপনি ফ্লু ও কোভিডের ভ্যাকসিনের জন্য আবেদন করতে পারবেন। যারা কেয়ার হোমে থাকেন বা বাসায় থাকেন তারা স্থানীয় এনএইচএস টিমের কাছ থেকে এই টিকা নিতে পারেন।
ফ্লু ও কোভিড থেকে বাঁচতে ১২বছরের বেশি বয়সী ঝুঁকির মধ্যে আছেন এমন যে কেউ ভ্যাকসিন নিতে পারেন। তবে শর্ত হচ্ছে, তাদের এমন কোন বাড়িতে থাকতে হবে যেখানে দুর্বল ইমিউন সিস্টেম বা বাড়তি যত্নের প্রয়োজন হয় এমন কেউ থাকেন এবং ফ্রন্টলাইন স্বাস্থ্যকর্মী বা সমাজসেবা কর্মী থাকেন।
ডা. খান বলেন, ‘আপনি হয়তো একসঙ্গে দুটি ভ্যাকসিন পাবেন। এটা নিরাপদ এবং একই সঙ্গে দুই ভাইরাস থেকেই আপনাকে নিরাপত্তা দেবে । বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। আপনার হয়তো আগে ফ্লু বা কোভিড ভাইরাস হয়েছে। তবে এই ভাইরাসগুলো ক্রমাগত নিজের গঠনে পরিবর্তন এনে যাচ্ছে। কাজেই তাদের বিরুদ্ধে আমাদের ইমিউন সিস্টেম লড়াই করার ক্ষমতা হারাতে থাকে।’
এনএইচএসের সব ভ্যাকসিনই নিরাপদ এবং কার্যকর। নানা কমিউনিটির হাজারো মানুষের ওপর পরীক্ষার পর ভ্যাকসিনগুলো সাধারণ মানুষের ওপর প্রয়োগ করা হচ্ছে।
ডা. খান বলেন, ‘স্বাস্থ্য ও সমাজসেবা খাতে ফ্রন্ট লাইনে কাজ করা পেশাজীবী হওয়ার কারণে আমাদের ফ্লু ও কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। সামনের শীতকাল খুবই চ্যালেঞ্জিং হতে চলেছে। কোভিডের নতুন ভ্যারিয়েন্টের কারণে ইনফেকশনের ঝুঁকি অনেক বেশি। এ ক্ষেত্রে আমার সবচেয়ে বড় সুরক্ষাটিই হচ্ছে ভ্যাকসিন। ‘
আমার সন্তানেরও কি ফ্লু, কোভিড বা হাম হতে পারে?
ডা. নাকভি বলেন, ‘আপনি সন্তানের পরীক্ষা করে দেখতে পারেন তার কোভিড নাইন্টিন হয়েছে কিনা। ফ্লুয়ের ক্ষেত্রে শিশু ও বড়দের লক্ষণগুলো একই। তবে শিশুদের ক্ষেত্রে খেয়াল করতে হবে তাদের কানে ব্যথা আছে কিনা। তারা ঠিক মতো শুনতে পাচ্ছে কিনা সেই বিষয়টিও নিশ্চিত হওয়া দরকার।‘
ইউকে ও ইউরোপে হামের প্রাদুর্ভাবও দেখা দিয়েছে। সাধারণত ঠান্ডা লাগার লক্ষণগুলো দিয়েই হাম শুরু হয়। কয়েক দিন পর র্যাশ বের হয়। পুরো শরীরেই র্যাশ দেখা দিতে পারে। ডা. নাকভি বিষয়টি আরেকটু বিস্তারিত করে বলেন, ‘নানা ধরনের র্যাশ বের হতে পারে। এটা লাল হতে পারে বা সাদা চামড়ার ক্ষেত্রে লালচে বাদামি হতে পারে। বাদামি বা কালো চামড়ার ক্ষেত্রে র্যাশ খুব একটা চোখে নাও পড়তে পারে। এটা কিছুটা গাঢ় রঙের বা হাইপারপিগমেন্টেশনের মতো হতে পারে। কিছুটা গোটা আকৃতিরও হতে পারে।’ এ ব্যাপারে আরো তথ্য জানতে যোগাযোগ করুন World Health Organisation website.
আপনার যদি মনে হয়, আপনার শিশুর হাম হয়েছে তাহলে হয় আপনার জিপি প্র্যাকটিসের সঙ্গে যোগাযোগ করুন অথবা ১১১ নম্বরে চিকিৎসা সহায়তার জন্য ফোন করুন।
ডা. নাগভি বলেন, ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে, হামে আক্রান্ত প্রতি পাঁচটি শিশুর মধ্যে একটিকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয় । হাম থেকে গুরুতর জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। যেমন নিউমোনিয়া, মেনিনজাইটিসের মতো মস্তিস্কের সংক্রমণ, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত। সংক্রমণের কয়েক বছর পরও শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল করে দিতে পারে হাম।
এটা অত্যন্ত সংক্রামক। ভ্যাকসিন দেয়া হয়নি এমন প্রতি ১০টি শিশুর মধ্যে নয়টি শিশুই এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে থাকে। যদি তাদের ক্লাসের অন্তত একটি শিক্ষার্থী এই রোগে আক্রান্ত হয়। র্যাশ বের হওয়ার পর আপনার শিশুকে অন্তত চারদিন স্কুরে পাঠাবেন না। তাতে করে আক্রান্ত হওয়ার ক্ষেত্রে যারা ঝুঁকিপূর্ণ অর্থাৎ শিশু-বৃদ্ধসহ অন্যরা কিছুটা হলেও সুরক্ষা পাবে।
শিশুদের সুরক্ষা
জীবন পাল্টে দিতে পারে এমন রোগগুলো থেকে সুরক্ষার জন্য এনএইচএসের ভ্যাকসিন প্রকল্প রয়েছে । আপনার সন্তানের হেলথ রেকর্ড বুক অর্থাৎ ‘রেড বুক’ দেখে বা তাদের জিপি প্র্যাকটিসের কাছ থেকে তাদের কী কী ভ্যাকসিন দেয়া হয়েছে সে সম্পর্কে আপনি নিশ্চিত হতে পারেন।
হামের কোন প্রতিকার নেই। তবে ইউকেতে ১৯৬৮ সালে হামের ভ্যাকসিন দিতে শুরু করার পর থেকে প্রায় ২০ মিলিয়ন মানুষ এই সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা পেয়েছেন এবং সাড়ে চার হাজার জীবন বেঁচে গেছে।
ডা. নাকভি বলেন, ‘এমএমআর ভ্যাকসিনের দুটি ডোজ হাম, মাম্পস ও রুবেলা থেকে সারা জীবনের জন্য সুরক্ষা দিতে পারে। আপনি বা আপনার সন্তান যদি এই ডোজগুলোর একটি বা দুইটি না পেয়ে থাকেন তাহলে আপনার জিপি প্র্যাকটিসের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।‘
দুই থেকে তিন বছর বয়সের মধ্যেই বেশিরভাগ শিশুকে হামের ভ্যাকসিন দেয়া হয়। আর স্কুলের শিশুদের দেয়া হয় তাদের স্কুল শুরু থেকে ১১ বছর বয়স পর্যন্ত । শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে ছয় মাস বা তার চেয়ে বেশি বয়সী শিশুকেও এই ভ্যাকসিন দেয়া হয়।
ডা. খান বলেন, ‘স্কুলে যাওয়া শিশু-কিশোররা তাদের ফ্লুয়ের ভ্যাকসিন স্কুল বা কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে নিতে পারে। শিশুদের যদি দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতা থাকে তাহলে তার অভিভাবক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন যে, তারা তাদের শিশুকে স্কুলে ভ্যাকসিন দেবেন না জিপি প্র্যাকটিসের কাছে নিয়ে যাবেন। তবে ভ্যাকসিন নেয়ার বয়স অর্থাৎ দুই থেকে তিন বছর বয়স হলে তাদের অবশ্যই জিপি প্র্যাকটিসের কাছে নিয়ে যেতে হবে। নাকের ওপর স্প্রে করে এই ভ্যাকসিন দেয়া হয়। প্রক্রিয়াটি যেমন দ্রুত তেমনি ব্যথাহীন।
ডা. খান বলেন, ‘ অনেক অভিভাবকই মনে করেন, স্প্রেতে যে জেলেটিন ব্যবহার করা হয় সেটা শুকর থেকে নেয়া। আপনারও যদি এমন বিশ্বাস থাকে তাহলে আপনার উচিত বিষয়টি নিয়ে আপনার ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলা। কারণ স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্যই এ ব্যবস্থা নেয়া হয়। একই সঙ্গে আপনার জিপি প্র্যাকটিসের সঙ্গে কথা বলুন। ইঞ্জেকশনের মাধ্যমেও ভ্যাকসিন দেয়া যায়। সেখানে পশু থেকে নেয়া জেলেটিন ব্যবহার করা হয় না।’
আপনার ভ্যাকসিন বুক করুন
* আপনার যদি সাহায্যের প্রয়োজন হয় বা ফ্লু ও কোভিড ভ্যাকসিন বুক করার জন্য দোভাষীর প্রয়োজন হয় তাহলে ১১৯ নম্বরে ফোন করুন। বিনামূল্যে এই ফোন করা যায়।
* আপনি এনএইচএস অ্যাপ ডাউনলোড করে বা www.nhs.uk.wintervaccinations এই ওয়েবসাইট ভিজিট করে ভ্যাকসিনের জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুক করতে পারবেন।
* এছাড়াও আপনি স্থানীয় এনএইচএস সার্ভিস যেমন জিপি প্র্যাকটিস বা কমিউনিটি ফার্মাসি এবং কিছু এলাকা আছে যেখানে কোভিড নাইন্টিন ভ্যাকসিন দেয়া হয় সেখানে গিয়েও টিকা নিতে পারেন।
* এছাড়াও স্বাস্থ্য ও সমাজসেবা কর্মীদের জন্য তাদের নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানও ভ্যাকসিনের ব্যবস্থা করতে পারে।
* গর্ভবতী নারীদের জন্য তাদের অ্যান্টেনেটাল ক্লিনিকও এ ব্যবস্থা করতে পারে।
* জিপি প্র্যাকটিসের মাধ্যমে ২-৩ বছরের শিশুদের জন্য ফ্লুয়ের ভ্যাকসিন বুক করা যেতে পারে (তিনি আপনার শিশুর বাদ পড়ে যাওয়া ভ্যাকসিনগুলোও দেয়ার ব্যবস্থা করতে পারেন।)
আরো পরামর্শ ও তথ্যের ভিজিট করুন http://www.nhs.uk/vaccinations.
ভ্যাকসিন সম্পর্কে আরো জানতে এবং watch an animation ভ্যাকসিন কী করে কাজ করে- সে বিষয়ে ধারণা পেতে ডা. ডোনাল্ড পালমারের British Society for Immunology website এ ভিজিট করুন।