বাওয়েল ক্যান্সার পরীক্ষা- পাল্টে দিতে পারে আপনার ভবিষ্যত
প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ এপ্রিল ২০২৪
ইংল্যান্ডে যেসব ক্যান্সার সবচেয়ে বেশি দেখা যায় তার মধ্যে বাওয়েল বা অন্ত্রের ক্যান্সারের অবস্থান তৃতীয় । এনএইচএস-এর হেলথ ইনইকুয়ালিটির ইমপ্রুভমেন্টের জিপি ও ডিরেকটর ডা. বোলা ওউওলাবি জানান, যে কোনো বয়সের যে কোনো মানুষ এই ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারেন। তবে কিছু মানুষের এ ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। যদিও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে শুরুতেই ধরা পড়লে জীবন বাঁচানো সম্ভব।
ডা. বোলা আরো বলেন, ‘স্বাস্থ্যগত বৈষম্য নিরসনের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে মানুষের ক্যান্সারের শুরুর দিকেই পরীক্ষা করার সুযোগ পাওয়া। সে ক্ষেত্রে ক্যান্সারের জটিলতা কম এবং সাফল্যের সম্ভাবনাও অনেক বেশি থাকে । কাজটি দুইভাবে করা যেতে পারে—প্রথমত অন্ত্রের ক্যানসারের পরীক্ষার জন্য আপনাকে এনএইচএস থেকে যখনই ডাকা হবে তখন সে ডাকে সাড়া দেয়া। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, শরীরে পরিবর্তন দেখার সঙ্গে সঙ্গে আপনার জিপি প্র্যাকটিসের সঙ্গে যোগাযোগ করা । প্রাথমিক স্তরেই ক্যান্সারে ধরা পড়লে যথাযথ চিকিৎসার মাধ্যমে আপনার সেরে ওঠার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে।
বাওয়েল বা অন্ত্রের ক্যান্সার কী?
বৃহদান্ত হচ্ছে আমাদের পরিপাকতন্ত্রের একটি অংশ । এটা আমাদের গ্রহণ করা খাবার থেকে পানি শোষণ করে। একই সঙ্গে খাদ্যের বর্জ্য শরীর থেকে বের করে দেয়। এই বৃহদান্তের যে কোনো অংশে ক্যান্সার সৃষ্টি হতে পারে। এর মধ্যে কোলন ও রেকটামও রয়েছে। কোষের সংখ্যাবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে এবং টিউমার হলে ক্যান্সারের আশংকা তৈরি হয়। কোনো কোনো সময় টিউমার ফেটে ক্যান্সারের কোষ শরীরের অন্য অংশেও ছড়িয়ে পড়ে। যদি তেমন কিছু ঘটে থাকে তাহলে তার চিকিৎসা করা অত্যন্ত জটিল হয়ে যায় । অন্ত্রের ক্যানসারের বিভিন্ন লক্ষণ দেখে অথবা লক্ষণ প্রকাশ না পেলেও প্রাথমিক অবস্থায় পরীক্ষা করলে চিকিৎসায় সাফল্য পাওয়া যেতে পারে । এখানে এই বিষয়গুলো নিয়ে আরো বিস্তারিত তথ্য দেয়া হবে। আপনি যদি শরীরে অন্ত্রের ক্যানসারের কোনো লক্ষণ দেখতে পান তাহলে পরীক্ষার জন্য ডাক পাওয়ার অপেক্ষা করবেন না। সেক্ষেত্রে আপনার জিপির সঙ্গে যোগাযোগ করে পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
অন্ত্রের ক্যানসার সব সময় স্পষ্ট বোঝা যায় না
একজন জিপি ডা. আনিশা প্যাটেল বলেন, ‘ইউকেতে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যুর কারণ হয় অন্ত্রের ক্যানসার দ্বারা । এ তথ্যটি ভয়ংকর। ৩৯ বছর বয়সে আমার তৃতীয় স্টেজের অন্ত্রের ক্যানসার ধরা পড়ে । আমি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী একজন মানুষ । অন্ত্রের ক্যানসারের পারিবারিক ইতিহাসও নেই।
২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে আমার মধ্যে প্রাথমিক কিছু লক্ষণ দেখা যায়। আমার ক্লান্ত লাগত। তবে আমি একজন ব্যস্ত জিপি, দুই সন্তানের মা। তাদের বয়স পাঁচ ও ছয় বছর। তিনি আরো বলেন, ‘আমার মনে হচ্ছিল আমি খুব স্ট্রেসে আছি এবং বিরক্তিকর পেটের সমস্যায় ভুগছি। আমার কন্সটিপেশন ছিল । টয়লেট পেপারে আমি রক্তের দাগও দেখেছি । আমার ধারণা ছিল, হয়তো পাইলস হয়েছে। এসব লক্ষণ দেখতে শুরু করার পর আমি আমার জিপির সঙ্গে দেখা করি । তবে রক্ত পরীক্ষায় তেমন কিছু ধরা পড়েনি।”
ডা. আনিশা বলেন, ‘সময় পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লক্ষণগুলোও বাড়তে থাকে। আমার ঘন ঘন পায়খানার চাপ আসতে থাকে এবং এ সময় পেট ব্যথা হয় । আমি লক্ষ্য করছিলাম আমার পায়খানার আকারে পরিবর্তন আসছে। অনেকটা ফিতার মতো হয়ে উঠেছে । আমাদের পায়খানার অভ্যাস নিয়ে কারো সঙ্গে কথা বলা সহজ নয় । তারপরও বিষয়টি নিয়ে আমি আমার স্বামীর সঙ্গে কথা বলি। তিনি একজন গ্রাস্ট্রো এন্টেরোলোজিস্ট। অন্ত্রের ক্যানসার নিয়েই তিনি কাজ করেন । আমরা ঠিক করলাম, আমি আবার জিপির কাছে যাব।”
ডাঃ আনিশা বলেন, ‘আমার মনে হয়, এ ধরনের পরিস্থিতিতে অনেকেই তাদের লক্ষণগুলো কিছুটা কমিয়ে বলেন, পুরোপুরি স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেন না। তবে এবার আমার রক্ত পরীক্ষা আর স্বাভাবিক এলো না। আমার জিপি আমাকে আরো কিছু পরীক্ষার জন্য পাঠালেন। এসব পরীক্ষার পরই আমার অন্ত্রের ক্যানসার ধরা পড়ে। আমার মনে হচ্ছিল, আমার আর কোনো আশা নেই, সব শেষ হয়ে গেছে। আমি বিক্ষিপ্ত, দিশাহীন হয়ে পড়েছিলাম । মনে হচ্ছিল, আমি অসহায়ভাবে বিচলিত, ক্ষুব্ধ, বিরক্ত । ক্যানসারের টিউমার কেটে ফেলার জন্য যখন অপারেশনে যাচ্ছিলম তখন ভয় পাচ্ছিলাম । আমি জানতাম না, এরপর কী হবে? ক্যানসার চলে যাবে? আমার কি কেমোথেরাপি বা রেডিও থেরাপি নিতে হবে? ভাগ্য ভালো আমার টিউমার পুরোপুরি সরিয়ে ফেলা সম্ভব হয় । এরপর আমাকে তিন মাসের জন্য কেমোথেরাপি নিতে হয়। যেন আর ক্যানসার ফিরে না আসে।”
অন্ত্রের ক্যানসারের লক্ষণ কী কী?
ইউকেতে প্রতি বছর প্রায় ৪২ হাজার ৯০০ অন্ত্রের ক্যানসারের রোগী শনাক্ত হয়। এদের বেশির ভাগেরই বয়স ৫০-এর ওপরে । ইউকেতে ৫০-এর কম বয়সীদের মধ্যে ক্যানসারে আক্রান্তের সংখ্যা ২ হাজার ৬০০ । যেমন ডা. আনিশা ।
ডা. বোলা বলেন, ‘পায়খানা যদি কালো বা গাঢ় লাল রঙের হয় অথবা পাতলা পায়খানার সঙ্গে যদি রক্ত যায় তাহলে অনুগ্রহ করে দ্রুত আপনার জিপি প্র্যাকটিসের সঙ্গে যোগাযোগ করুন অথবা এনএইসএস ১১১ নম্বরে কল করুন। ‘তিনি আরো বলেন, ‘আপনার যদি অবিরাম রক্তপাত হয় বা টয়লেটে প্রচুর রক্ত দেখা যায় যেমন টয়লেটের পানি লাল হয়ে যায় বা আপনি বড় ব্লাড ক্লট যায় তাহলে সময় নষ্ট না করে অনুগ্রহ করে হাসপাতালের জরুরী বিভাগ এক্সিডেন্ট এন্ড ইমার্জেন্সি (এঅ্যান্ডই) বিভাগে যোগাযোগ করুন বা ৯৯৯ নম্বরে ফোন করুন।”
এসব লক্ষণের যেকোনোটি নজরে এলে আপনার জিপির সঙ্গে যোগাযোগ করুন:
• পয়খানার ধরনের পরিবর্তন- যেমন পাতলা পায়খানা, ডায়রিয়া বা কন্সটিপেশন
• স্বাভাবিকের তুলনায় ঘন ঘন টয়লেটে যাওয়া বা কম যাওয়া
• পায়খানার সঙ্গে রক্ত, যা দেখতে লাল বা কালচে দেখায়
• পায়ুপথে রক্তপাত
• টয়লেট থেকে বের হওয়ার পর পর আবার যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব
• পেটে ব্যথা বা পেট ফাঁপা
• চেষ্টা ছাড়াই ওজন কমতে থাকা
• কোনো কারণ ছাড়াই ক্লান্ত অনুভব করা
উদ্বেগজনক লক্ষণ থাকলে এসব নিয়ে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলার সময় বিব্রত না হয়ে বিনা অস্বস্তিতে সমস্যার কথা বলার পরামর্শ দেন ডা. আনিশা ও ডা. বোলা।
ডা. বোলা বলেন, ‘আপনি যদি আপনার বাউল মুভমেন্ট বা সমস্যা নিয়ে কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করেন দয়া করে- তাহলে মনে রাখবেন, আমরা শরীরের সব অংশেরই পরীক্ষা করি এবং এ ধরনের কথাবার্তা প্রায় সময়ই শুনে থাকি।”
ডা. আনিশা আরো বলেন, ‘আপনি ভালো বোধ না করলে প্লিজ আমাদের কাছে আসুন । তিন সপ্তাহ বা এর বেশি সময় লক্ষণ থাকলে জিপির সঙ্গে যোগাযোগ করা অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ। সমস্যাটি ক্যানসার নাও হতে পারে। তবে যদি হয়ে থাকে, তাহলে প্রাথমিক অবস্থায় তা জানা গেলে চিকিৎসা করা অনেক সহজ হয়। আর আমার মতো যদি ডাক্তার দেখানোর পরও লক্ষণগুলো থেকে যায় তাহলে আবার জিপির সঙ্গে দেখা করুন।
অন্ত্রের ক্যান্সারের স্ক্রিনিং বন্ধ করবেন না
প্রতি দুই বছর অন্তর এনএইচএস থেকে ৫৬-৭৪ বছর বয়সীদের অন্ত্রের ক্যানসার পরীক্ষার জন্য ডাকা হয় । এদের বেশির ভাগই ৫৪ বছর বয়সী । এতে বাসায় পরীক্ষা করা যায় এমন কিট ব্যবহার করা হয় । একে বলে ফিক্যাল ইমিউনোক্যামিক্যা টেস্ট (বা সংক্ষেপে ফিট কিট)। বর্তমানে এই প্রকল্পে পঞ্চাশোর্ধ্ব সবাইকে অন্তর্ভূক্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কাজেই আপনি হয়তো ৫৬-তে পৌঁছানোর আগেই একটি পরীক্ষা করার সুযোগ পাবেন। ৭৫ বা এর চেয়ে বেশি বয়সীরা ফিট কিট পেতে পারেন এর জন্য তাদের ০৮০০ ৭০৭ ৬০ ৬০ নম্বরে ফোন করার জন্য বলা হয়েছে।
প্রতি দুই বছর অন্তর ফিট কিট পাঠানো হয় । এতে সামান্য পরিমাণ পায়খানা দিতে হয় । যা আপনি আপনার বাসায় ব্যক্তিগত পরিসরে নিজের সুবিধামতো কিটে ভরে দিতে পারবেন। এরপর সিল করা একটা বোতলে করে কিটের সঙ্গে সরবরাহ করা খামে ভরে পাঠিয়ে দিতে হবে। এই খামের জন্য আপনার কোনো ডাকটিকেট ব্যবহার করতে হবে না । নমুনার মধ্যে রক্ত আছে কিনা সেটা পরীক্ষা করে দেখা হয় । রক্ত পাওয়ার অর্থ হচ্ছে ক্যানসার হওয়ার আশংকা রয়েছে। অনেক সময়ই খালি চোখে রক্ত দেখা যায় না। যদিও নমুনায় রক্ত থাকলে ক্যানসার হবেই—এমন নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যায় না। তবে এ ক্ষেত্রে আরো কিছু পরীক্ষা করার পরামর্শ দেয়া
হয়।
ডা. আনিশা বলেন, ‘আপনি বা আপনার পরিবারের কেউ যদি লেটার বক্সে টেস্ট কিট দেখতে পান তাহলে একে ঠেলে সরিয়ে রাখবেন না। এই পরীক্ষা করতে কয়েক মুহূর্ত সময় লাগে মাত্র। তবে এই পরীক্ষা আপনাকে ক্যানসার থেকে সুরক্ষা দিতে পারে। কারণ কোনো লক্ষণ না থাকলেও এই মরণ ব্যাধিতে আক্রান্ত হতে পারেন।
এই কিট দিয়ে পরীক্ষা করা ৯৮ পার্সেন্ট মানুষের বাড়তি আর কোনো পরীক্ষা করার প্রয়োজন হয়নি। মাত্র ২ পার্সেন্ট মানুষকে হাসপাতালে গিয়ে আরো পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দেয়া হয়েছে। হাসপাতালে বাড়তি পরীক্ষার জন্য গিয়েছেন এমন প্রতি ১০০জনের মধ্যে মাত্র ৯জন ক্যানসারে আক্রান্ত বলে শনাক্ত হয়েছেন । হাসপাতালের পরীক্ষায় অংশ নেয়া ৫৫ পার্সেন্ট পলিপের সমস্যায় আক্রান্ত বলে নিশ্চিত করেছে কর্তৃপক্ষ।
ডা. বোলা বলেন, ‘পলিপ কিন্তু ক্যানসার নয়। তবে সময়ের সঙ্গে এটি ক্যানসারে রূপ নিতে পারে। আপনার যদি পলিপ থাকে তাহলে তা সহজেই চিকিৎসার মাধ্যমে সারিয়ে তোলা সম্ভব।
তিনি আরো বলেন, ‘অন্ত্রের ক্যানসার যদি প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা সম্ভব হয় তাহলে তা চিকিৎসার মাধ্যামে সারিয়ে তোলা যেতে পারে। সত্যিকার অর্থেই ফিট কিট আপনার জীবন বাঁচাতে পারে। ‘আর আপনার যদি এনএইএস-এর অন্ত্র ক্যানসারের স্ক্রিনিং টেস্ট করার পর উপরে উল্লেখ করা লক্ষণগুলো নজরে আসে, তাহলে আবার গিয়ে পরীক্ষা করুন।
আপনি অন্ত্রের ক্যানসার এবং এর স্ক্রিনিং সম্পর্কে আরো জানতে অনলাইনে ভিজিট করুন NHS.UK/conditions/bowel-cancer
আমাদের এটা নিয়ে কথা বলতে হবে
ডা. আনিশা অন্ত্রের ব্যাপারে সচেতনতা তৈরির জন্য তার অভিজ্ঞতা অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করে চলেছেন। এই ক্যানসারকে ঘিরে যে সামাজিক অস্বস্তি রয়েছে তা শেষ করার চেষ্টা করছেন তিনি। ডা. আনিশা বলেন, ‘আমি জিপি, বিশেষজ্ঞ, নার্স, অনলাইনের সাপোর্ট গ্রুপ এবং স্বজন ও বন্ধুদের মাধ্যমে এই নেতিবাচক পরিস্থিতিকে ইতিবাচক করার চেষ্টা করছি । আপনার যদি লক্ষণ থাকে তাহলে দেরি না করে আপনার জিপি প্র্যাকটিসের সঙ্গে যোগাযোগ করুন । প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্ত করা গেলে জীবন বাঁচানো সম্ভব । আর আপনি যদি আপনার অন্ত্রের ক্যানসারের পরীক্ষার জন্য ফিট কিট পান তাহলে তা একপাশে সরিয়ে না রেখে পরীক্ষাটি করে ফেলুন এবং বাঁচুন।”