কুশিয়ারার তাণ্ডবে এবার সিলেটের ৬ উপজেলা তছনছ
প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ জুন ২০২৪
দেশ ডেস্ক:: ভারতের আসাম রাজ্যের বড় নদী বরাক। এই বরাক নদীর প্রবাহিত পানির পুরোটারই বেসিন হচ্ছে সিলেটের সুরমা ও কুশিয়ারা নদী। বরাক দিয়ে ঢল আসা অব্যাহত রয়েছে। আর এই বরাকের ৮০ ভাগ পানি টানছে কুশিয়ারা। এ কারণে গত ৫ দিন ধরে সিলেটের ৬ উপজেলায় এবার তাণ্ডব চালাচ্ছে এ নদী। কুশিয়ারার কমপক্ষে ৮০টি স্থানে বাঁধ ভেঙে ও পানি উপচে তলিয়ে গেছে বিস্তীর্ণ এলাকা।
বালাগঞ্জ ও ফেঞ্চুগঞ্জ সদরে কোমরপানি। এক সপ্তাহ ধরে পানিবন্দি চার লাখ মানুষ। সুরমা নদীর পানি কমলেও কুশিয়ারা নদীর পানি কমার কোনো লক্ষণ নেই। এ কারণে ওসমানীনগর, বালাগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার ও জকিগঞ্জে বন্যা দীর্ঘ স্থায়ী রূপ নিচ্ছে বলে জানিয়েছেন জনপ্রতিনিধিরা।
বালাগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান আনহার মিয়ার মতে, বালাগঞ্জ ও ওসমানীনগর উপজেলা হচ্ছে উজানের পানির রিজার্ভ এলাকা। যখন কানাইঘাট, জকিগঞ্জ উপজেলা প্লাবিত হয় তখন আমাদের এলাকায় পানি থাকে না। কিন্তু দু’একদিনের মধ্যে ওই পানি এসে তলিয়ে যায় বিস্তীর্ণ এলাকা। এখন তার এলাকার পরিস্থিতি সবচেয়ে বেশি খারাপ। উপজেলার প্রায় ৭০ শতাংশ এলাকা পানিতে ডুবে আছে।
তিনি বলেন, বালাগঞ্জে পর্যাপ্ত ত্রাণ রয়েছে। কিন্তু পৌঁছানো সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক তো নদী ও হাওরে ঢল রয়েছে, অপরদিকে নৌযানের সংকট তীব্র। এ কারণে ত্রাণ পৌঁছানোই এখন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বালাগঞ্জের ভাটির এলাকা ওসমানীনগর। ১৯শে জুন থেকে উপজেলার ৮ ইউনিয়নই প্লাবিত হয়েছে। রাস্তাঘাটে পানি উঠে যাওয়ায় বহু এলাকার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। আশ্রয় কেন্দ্রে উঠেছেন প্রায় ৩ হাজার মানুষ। তারা ত্রাণ পাচ্ছেন। তবে, বাড়িতে থাকা লোকজন পড়েছেন চরম দুর্ভোগে।
উপজেলা চেয়ারম্যান শামীম আহমদ জানিয়েছেন, তার উপজেলার সাদিপুর, পশ্চিম পৈলনপুর, বুরুঙ্গা ও উসমানপুর ইউনিয়নের অবস্থা খুবই শোচনীয়। ৫ দিন ধরে মানুষ পানিবন্দি। এখনো উজানের ঢল এসে ঠেলছে। এ কারণে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। কুশিয়ারা নদীর ডাইক কয়েক স্থানে উপচে পানি ঢুকছে। তিনি জানান- সরকার থেকে ত্রাণ দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি সিলেটের মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর উদ্যোগে ওসমানীনগরে ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে।
সাদিপুর ইউনিয়নের চাতলপাড় গ্রামের বাসিন্দা ছামির আহমদ জানিয়েছেন- তাদের গ্রামের অন্তত ২৫টি পরিবার বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে গত চারদিন ধরে অবস্থান নিয়েছেন। সরকারসহ বেসরকারি উদ্যোগে এসব আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা লোকজনকে খাবার দেয়া হচ্ছে। তবে, সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় রয়েছেন বাড়িতে থাকা লোকজন। তারা খাবারসহ নানা সংকটের মুখে রয়েছেন। সাদিপুরের পাশের উপজেলা পশ্চিম পৈলনপুর।
এ উপজেলার ৯০ ভাগ এলাকা পানির নিচে তলিয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় ইউনিয়ন চেয়ারম্যান প্রকৌশলী গোলাম রব্বানী চৌধুরী সুমন। তিনি জানিয়েছেন- মানুষজন পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। ৭টি আশ্রয়কেন্দ্রেও বহু মানুষ উঠেছেন। যারা আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন তাদের মধ্যে রান্না করা খাবার দেয়া হচ্ছে। আর যারা বাড়িতে রয়েছেন তাদের মধ্যে ত্রাণ পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। পর্যাপ্ত ত্রাণ রয়েছে বলে জানান তিনি। হাকালুকি হাওরের তীরবর্তী এলাকা ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা। ৫ দিন ধরে উপজেলার মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। খোদ উপজেলা সদরেই কোমর পরিমাণ পানি।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন; হাকালুকি হাওর এলাকার পানিবন্দি মানুষের সঙ্গে অনেক স্থানে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় ত্রাণ পৌঁছানো কষ্টকর হয়ে পড়েছে। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার অর্ধেকের বেশি এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। দোকানপাটে পানি উঠে যাওয়ায় শতকোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। কুশিয়ারা নদীর ঢলের স্রোতে অনেক দোকানের মালামাল পানিতে ভেসে গেছে।
সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ নিজেও জানিয়েছেন; সুরমা নদীর তীরবর্তী এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। নদীর পানি বিপদসীমার কাছাকাছি চলে এসেছে। তবে- কুশিয়ারা নদীর অমলসীদ, শ্যাওলা, ফেঞ্চুগঞ্জ ও শেরপুর পয়েন্টে পানি বিপদসীমার বহু উপরে রয়েছে। অনেক স্থানে কুশিয়ারা নদীর ডাইক উপচে পানি ঢুকেছে। তিনি বলেন- বৃষ্টি না হলে আগামী কয়েকদিনের মধ্যে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হতে পারে।
এদিকে ভারতের মেঘালয় রাজ্যে বৃষ্টিপাত না হলেও আসামের বরাক অববাহিকায় আগেই পরিস্থিতির অবনতি ছিল। এই পানি এখন বরাক হয়ে সিলেটে নামছে। এ কারণে কুশিয়ারা অববাহিকায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। এখনো কুশিয়ারাতে প্রবল স্রোত রয়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। সীমান্তবর্তী কানাইঘাট, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কোম্পানীগঞ্জ ও সিলেট সদরে পানি ধীরে নামছে। পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছে দুর্ভোগও। আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে বাড়িতে ফেরা মানুষজন দিশাহারা হয়ে পড়েছেন।
কোম্পানীগঞ্জের আমিনুল ইসলাম জানিয়েছেন, ঈদের দিন থেকে যে ঢল নেমেছিলো তাতে অনেকেরই বাড়িঘর ভেঙে গেছে। বাড়িতে ফিরলেও এসব মানুষকে ঘুরে দাঁড়াতে সময় নিতে হবে। এখন অনেকেই ভাঙাচুরা বাড়িতে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাস করছেন। তারা খাবারসহ নানা সংকটে রয়েছেন বলে জানান তিনি।
জেলা প্রশাসনের সর্বশেষ তথ্যে জানা গেছে, জেলার ৩১০টি আশ্রয়কেন্দ্রে এখনো বসবাস করছেন ২২ হাজার ৬২৩ জন মানুষ। বন্যা আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা হচ্ছে ৮ লাখ ৫২ হাজার। ১১২টি ইউনিয়ন ও তিনটি পৌরসভার সাড়ে ১৪শ’ গ্রাম বা ওয়ার্ড পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে।
নগরের উন্নতি: সিলেট নগর থেকে বন্যার পানি নামলেও দুর্ভোগ দেখা দিয়েছে। নগরের উপশহরে গতকাল গিয়ে দেখা গেছে বিভিন্ন এলাকায় দুর্গন্ধ রয়েছে। স্থানীয় কাউন্সিলর মাসুমের নেতৃত্বে বিভিন্ন এলাকায় ব্লিসিং পাউডার দিয়ে জীবাণু সরানো হচ্ছে। কাউন্সিলর জানিয়েছেন; ঈদের দিন অনেকেই ঘরের ছাদে বা দোতালায় কোরবানি দিয়েছিলেন। এরপর বর্জ্য পানিতে ভাসিয়ে দেন। আমরা নিজেরা পরিবেশ ধ্বংসের জন্য দায়ী। একইসঙ্গে কয়েক হাজার বাসাবাড়ির নিচতলা পানিতে তলিয়ে যায়। আসবাবপত্র ভিজে গেছে। এতে করে মানুষের দুর্ভোগ চরমে রয়েছে। ১২নং ওয়ার্ডে ঢুকেছিলো পানি।
স্থানীয় কাউন্সিলর সিকন্দর আলী জানিয়েছেন, ওয়ার্ডে কেউ অভুক্ত থাকেনি। তার পরিবারের উদ্যোগে রান্না করা খাবার বিতরণ করা হয়েছে। একইসঙ্গে সিটি করপোরেশন থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণ ত্রাণ দেয়া হয়েছে। এসব ত্রাণ বানবাসী মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
সিটি করপোরেশনের মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী জানিয়েছেন, বন্যার পানি নামলেও মানুষের দুর্ভোগ কাটেনি। এখনো দুর্ভোগে থাকা মানুষদের সিটি করপোরেশন থেকে সহযোগিতা করা হচ্ছে। একইসঙ্গে নগরের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযানও জোরদার করা হয়েছে।