হঠাৎ ভয়ংকর বন্যা, বিপর্যস্ত ৯ জেলা
প্রকাশিত হয়েছে : ২২ আগস্ট ২০২৪
দেশ ডেস্ক:: ভারতের ত্রিপুরার ডম্বুর হাইড্রো ইলেকট্রিক পাওয়ার প্রজেক্ট বা ডম্বুর গেট খুলে দিয়েছে ভারত। ফলে পাহাড়ি ঢল, ভারী বর্ষণ ও ভারত থেকে আসা পানিতে হঠাৎ বন্যা পরিস্থিতি তীব্র আকার ধারণ করেছে ফেনী, নোয়াখালী ও কুমিল্লা অঞ্চল। ভারী বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে এই তিন জেলাসহ নয়টি জেলায় বন্যা হয়েছে। বাড়িঘরে হাঁটু থেকে কোমরসমান পানি ওঠায় বিপাকে পড়েছেন এসব জেলার বেশিরভাগ মানুষ। এছাড়া, বন্যার পানিতে গ্রামীণ সব সড়ক ও ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। বন্যাকবলিত জেলাগুলো হলো— ফেনী, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, লক্ষ্মীপুর ও খাগড়াছড়ি।
বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে ত্রিপুরা রাজ্যের গোমতীর জেলা প্রশাসক তরিৎ কান্তি চাকমার সরকারি এক্স অ্যাকাউন্টের (সাবেক টুইটার) উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছে, ভারতের পুরার ডম্বুর হাইড্রো ইলেকট্রিক পাওয়ার প্রজেক্ট বা ডম্বুর গেট খুলে দিয়েছে ভারত।
পাহাড়ি ঢল ও বন্যার কবল থেকে রক্ষা করতে সোনাগাজী উপজেলার বড় ফেনী নদীর ওপর নির্মিত মুহুরী রেগুলেটরের (জলকপাট) ৪০টি গেট খুলে দেওয়া হয়েছে। ফলে বন্যাপরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ ফেনীতে। জেলার তিন উপজেলা পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়ার তিন উপজেলার শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে, পানিবন্দী লক্ষাধিক মানুষ।
বাসিন্দারা বলছেন, সর্বশেষ ১৯৮৮ সালে ভয়াবহ বন্যার মুখোমুখি হয়েছিলেন ফেনীর বাসিন্দারা। গত ৩৬ বছরে অনেকবার বন্যা হলেও এ ধরনের ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়নি।
জেলার পানিবন্দী মানুষকে উদ্ধারে কাজ শুরু করেছে সেনাবাহিনী, বিজিবিসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবকরা। ছয়টি স্পিডবোটে করে উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছেন সেনাসদস্যরা। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরাও তিনটি স্পিডবোটে উদ্ধারকাজ শুরু করেছেন। উদ্ধার অভিযানে অংশ নিচ্ছে কোস্টগার্ডও।
গোমতী নদীর পানি বেড়ে বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে কুমিল্লায়। জেলার গোমতী নদীর পানি সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। নদীর বাঁধ রক্ষায় কাজ করছে পাউবো, সেনাবাহিনী এবং সংশ্লিষ্ট এলাকার উপজেলা প্রশাসন ও ইউনিয়ন পরিষদ। কুমিল্লার জেলা প্রশাসক খন্দকার মুহাম্মদ মুশফিকুর রহমান বলেন, গোমতী নদীর বাঁধ রক্ষায় জেলা প্রশাসন, পাউবো, সেনাবাহিনী এবং সংশ্লিষ্ট এলাকার উপজেলা প্রশাসন ও ইউনিয়ন পরিষদ কাজ করছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সদর উপজেলার শালধর প্রাথমিক বিদ্যালয়, আমড়াতলী প্রতিবন্ধী উচ্চবিদ্যালয় ও ধনেশ্বর উচ্চবিদ্যালয়ে আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে।
জেলার চৌদ্দগ্রাম, নাঙ্গলকোট লাকসামেও ছয় দিনের অবিরাম বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢল ডাকাতিয়া নদীর পানি বিপদসীমা আর বাইরে থাকায় সাতটি ইউনিয়নের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। বৃষ্টিতে ভেসে গেছে পুকুর ও মৎস্য প্রজেক্টের মাছ।
রায়কোট দক্ষিণ ইউপির মৎস্য বীজ উৎপাদন খামারের মালিক ওবায়েদুল হক মজুমদার বলেন, তার খামারের পাড় ভেঙে ৫০টি পুকুরের ছোট ও বড় মাছ ভেসে গেছে। এতে করে এক কোটি টাকার মাছ ভেসে গেছে।
জলাবদ্ধতা প্রকট আকার ধারণ করেছে নোয়াখালীতেও। জেলার নয়টি উপজেলার মধ্যে আটটিতেই জলাবদ্ধতা প্রকট আকার ধারণ করেছে। তিন দিন ধরে বেশির ভাগ ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে আছে। নোয়াখালী শহরের লক্ষ্মীনারায়ণপুর, হরিনারায়ণপুর, কাজি কলোনি, লইয়ার্স কলোনি, রশিদ কলোনি ও কৃষ্ণরামপুর এলাকার বেশিরভাগ বাসাবাড়ির আঙিনায় বৃষ্টির পানি থই থই করছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দরসহ আশপাশের অন্তত ৩০টি গ্রাম তলিয়ে গেছে। পানির তোড়ে একটি অস্থায়ী সেতু ভেঙে আখাউড়া-আগরতলা সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। এ ঘটনায় এক নারীর মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। গতকাল সকাল থেকে বন্দরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া খাল দিয়ে ভারত থেকে তীব্র বেগে পানি ঢুকতে থাকে। এক পর্যায়ে স্থলবন্দর, বাউতলা, বীরচন্দ্রপুর, কালিকাপুর, বঙ্গেরচর, সাহেবনগরসহ অন্তত ৩০টি গ্রামে পানি ঢুকে পড়ে। ভেঙে যায় গাজীরবাজার এলাকার অস্থায়ী সেতু। এর আগে মঙ্গলবার খলাপাড়া এলাকায় হাওড়া নদীর বাঁধের কিছু অংশ ভেঙে পানি ঢুকতে শুরু করে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) গাজালা পারভীন রুহি জানান, সেতুটি মেরামতের জন্য সড়ক ও জনপথ বিভাগকে খবর দেওয়া হয়েছে। তবে দ্রুত যান চলাচলের উপযোগী করা যাবে না।
ফটিকছড়ির হালদা নদী ও ধুরুং খালের বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে ঢুকে পড়েছে পানি। বন্যার পানিতে কয়েকশ একর রোপা আমন ধান, বীজতলা ও বর্ষাকালীন সবজির ক্ষেত প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া উপজেলার ২০-৩০টি মাছের ঘের ও বেশ কিছু পুকুর ডুবে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। বন্যার কারণে মুরগি ও গরুর খামারগুলোরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। অন্যদিকে, গত ৫ আগস্ট থেকে উপজেলার কয়েকটি পৌরসভার মেয়র, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং স্থানীয় আওয়ামীপন্থি জনপ্রতিনিধিরা আত্মগোপনে রয়েছেন। ফলে বন্যা পরিস্থিতিতে স্থানীয় বাসিন্দারা তাদের পাশে পাচ্ছেন না। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘পাহাড়ি ঢল ও অতিবৃষ্টির কারণে লোকজনের দুর্ভোগ বেড়েছে। আমরা ইতিমধ্যে ক্ষতির বিষয়ে জেলা প্রশাসনকে জানিয়েছি। বন্যাকবলিত এলাকাগুলো পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
খাগড়াছড়ি সদর ও পানছড়ি উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও দীঘিনালা উপজেলায় আরও অবনতি হয়েছে। জেলার মহালছড়ি উপজেলার সঙ্গে মুবাছড়ি ইউনিয়নের সংযোগ সড়কের কাপ্তাইপাড়া সেতুর অ্যাপ্রোচ সড়ক ভেঙে গেছে। ফলে ওই এলাকার সঙ্গে গতকাল থেকে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। অবশ্য গ্রামবাসী বাঁশের সাঁকো তৈরি করে চলাচল করছে। খাগড়াছড়ির এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী তৃপ্তি শংকর চাকমা জানান, তিনিও বিষয়টি জেনেছেন। সাময়িকভাবে বেইলি সেতু নির্মাণ করার চিন্তা চলছে।
চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার দুই ইউনিয়নের বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। এরই মধ্যে বেড়িবাঁধের কয়েক স্থানে অন্তত দুই কিলোমিটার এলাকায় ভাঙন ও সিসি ব্লকে ধস দেখা দিয়েছে। বাঁধের এমন পরিস্থিতিতে সাগর ও শঙ্খ নদ তীরের বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।চট্টগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শওকত ইবনে শহীদ বলেন, ‘ভাঙনের বিষয়টি আমরা অবগত হয়েছি। তবে সরকার পতনের পর জরুরি ভিত্তিতে কাজের কোনো নির্দেশনা আসেনি।’
লক্ষ্মীপুরের অধিকাংশ গ্রামীণ কাঁচা-পাকা সড়ক ও নিম্নাঞ্চলের বাড়িঘর পানিতে তলিয়ে গেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় দুই লাখ পরিবার। সব চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জেলার রামগতি ও কমলনগর, রায়পুর ও সদর উপজেলার মেঘনা উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দারা। এ ছাড়া পুরো জেলার সর্বত্র পুকুর ও মৎস্য খামারের পাড় ভেসে গিয়ে বেরিয়ে গেছে হাজার হাজার পুকুরের কয়েক কোটি টাকার মাছ।
মৌলভীবাজারে টানা বৃষ্টির সঙ্গে পাহাড়ি ছড়া ও নদ-নদী দিয়ে তীব্র বেগে ভারত থেকে আসছে পানি। মনু নদের পানি বিপৎসীমার ১১৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অন্য প্রধান তিন নদ-নদী ধলাই, জুড়ী ও কুশিয়ারার পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কুলাউড়া ও জুড়ী উপজেলার বিভিন্ন স্থানে নদ-নদীর বাঁধ ভেঙে, উপচে ৬২টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
বৃষ্টি ও উজানের পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জের সুরমাসহ অন্যান্য নদীর পানি বাড়ছে। সুরমা নদীর পানি বুধবার ১২ সেন্টিমিটার বেড়েছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত আছে। নদী ও হাওর এমনিতেই ভরা বর্ষার পানিতে টইটম্বুর। তাই পানি বাড়লে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
টানা ভারী বৃষ্টি ও ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে হবিগঞ্জের খোয়াই নদের পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে ঝুঁকিতে আছে শহর প্রতিরক্ষা বাঁধ।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ভারী বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে আখাউড়া স্থলবন্দর ও আন্তর্জাতিক ইমিগ্রেশন পুলিশ চেকপোস্ট প্লাবিত হয়েছে। বুধবার সকাল ১০টার পর ইমিগ্রেশনের সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।