আব্দুস শহীদের উত্থান হার মানায় রূপকথাকেও
প্রকাশিত হয়েছে : ০২ নভেম্বর ২০২৪
দেশ ডেস্ক:: চা বাগান-অধ্যুষিত শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ উপজেলা নিয়ে মৌলভীবাজার-৪ আসন। এখানে টানা ছয়বার এমপি ছিলেন সাবেক কৃষিমন্ত্রী আব্দুস শহীদ। কৃষক পরিবারের সন্তান থেকে বেসরকারি কলেজে উপাধ্যক্ষ হন। তবে রাজনীতির ছোঁয়ায় এখন তাঁর সম্পদের উত্থান রূপকথার গল্পকেও হার মানায়।
অভিযোগ রয়েছে, মন্ত্রী হওয়ার আগেই আওয়ামী লীগ শাসনামলে চিফ হুইপ থেকে বিভিন্ন পদে বসে বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হন আব্দুস শহীদ। পিছিয়ে নেই তাঁর স্ত্রী, দুই কন্যা, এমনকি ভাইয়েরাও। দোর্দণ্ড প্রতাপশালী এ নেতাকে গত মঙ্গলবার রাজধানীর উত্তরা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ সময় তাঁর বাসা থেকে নগদ ৩ কোটি টাকা, আট দেশের বিপুল মুদ্রা ও ৮৫ ভরি স্বর্ণ জব্দ করা হয়।
গত বুধবার ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান জানান, ছাত্র আন্দোলনের সময় হত্যার ঘটনায় উত্তরা পশ্চিম থানার এক মামলায় আদালতে হাজির করা হলে বিচারক চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে উত্তরা পশ্চিম থানায় আরও দুটি হত্যা এবং মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে আরেকটি হত্যাচেষ্টা মামলা রয়েছে। আব্দুস শহীদের বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা ও মানি লন্ডারিং আইনে পৃথক মামলা প্রক্রিয়াধীন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের পতনের দিনই আব্দুস শহীদের মৌলভীবাজারের রিসোর্ট, বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। স্থানীয় সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে চা-বাগান প্রতিষ্ঠার নামে বন বিভাগের জমি দখল, বাগান বাড়ি নির্মাণ, হাইল-হাওরে মৎস্য খামারসহ নানাভাবে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন আব্দুস শহীদ। চার একর জমিতে ২০১৮ সালে কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের পাশে ‘সাবারি টি প্লান্টেশন’ করেন তিনি। পরে পাশে উদ্যানের ৫ একর পাহাড়ি জমি দখল করেন।
সরকারি খরচে পুরো চা-বাগানে পল্লী বিদ্যুতের লাইন টেনে পানি সেচে ১৩-১৪টি ডিপ টিউবওয়েল বসান। এ ছাড়া কমলগঞ্জের কাঁঠালকান্দিতে ৮ একর পাহাড়ি জমিতে বাগানবাড়ি করেন আব্দুস শহীদ। সরকারি খরচে এখানেও একাধিক ডিপ টিউবওয়েল এবং বিদ্যুতের জন্য ৮টি সৌর প্লান্ট বসান। হাইল-হাওর ও বাইক্কা বিলের পাশে প্রায় ২৭ বিঘা জমিতে করেছেন মৎস্য খামার।
স্থানীয়রা এসব সম্পদ উদ্ধারের দাবি জানিয়েছেন। লাইয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ৫ একর জমি গত ১৫ সেপ্টেম্বর দখলমুক্ত করার কথা জানিয়েছেন বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের ডিএফও জাহাঙ্গীর আলম।
২০০৮ সালে হলফনামায় স্থাবর-অস্থাবর মিলিয়ে ৮৬ লাখ ৮৪ হাজার ৭০৭ টাকার সম্পদ দেখান আব্দুস শহীদ। ২০২৩ সালের হলফনামায় তা হয়েছে ৭ কোটি ৪৩ লাখ ৮৮ হাজার ৯০৮ টাকা। পাঁচ বছর আগেও স্ত্রী উম্মে কুলসুমার কোনো সম্পদ ছিল না। কিন্তু ২০২৩ সালে গৃহিণী স্ত্রীর ১০০ ভরি স্বর্ণ, নগদ ৪ লাখ টাকা, বন্ড-ঋণপত্র ও শেয়ারে ১ লাখ ৩৬ হাজার এবং অকৃষি জমির পরিমাণ ১ লাখ ২০ হাজার টাকা উল্লেখ রয়েছে।
শুধু সম্পদ নয়, নামেরও ‘কাঙাল’ আব্দুস শহীদ। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরকারি অর্থায়নে একাডেমিক ভবন নির্মাণ করা হলেও, তাতে নামকরণ করেছেন তিনি। কমলগঞ্জ সরকারি গণমহাবিদ্যালয়, সুজা মেমোরিয়াল কলেজ শমশেরনগর, পতনঊষার স্কুল অ্যান্ড কলেজ, কমলগঞ্জ মডেল সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, মুন্সিবাজার কালিপ্রসাদ উচ্চ বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভবনের নামকরণ করা হয়েছে উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদের নামে।
স্থানীয়রা জানান, আব্দুস শহীদের প্রভাব দেখিয়ে তাঁর স্বজনও কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের সহব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি পদ দীর্ঘদিন পর্যায়ক্রমে দখলে রেখেছেন তাঁর দুই ভাই। মোসাদ্দেক আহমদ মানিক নামে ভাই এখনও দায়িত্বে আছেন বলে জানান রেঞ্জ অফিসার শহীদুল ইসলাম। অন্য ভাই ইফতেখার আহমেদ বদরুল একাধিকবার ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন ক্ষমতার দাপটে। আরেক ভাই ইমতিয়াজ আহমদ বুলবুলকে আওয়ামী লীগ প্রার্থী অধ্যাপক রফিকুর রহমানের বিপরীতে বিদ্রোহী দাঁড় করিয়ে বিজয়ী করেছেন।
১৯৯৬ সালের আগে আব্দুস শহীদ কখনও বীর মুক্তিযোদ্ধা ব্যবহার করেননি। কিন্তু ওই বছর আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা ব্যবহার শুরু করেন। পরে জামুকার সদস্যও হয়েছেন। শুধু তাই নয়, প্রভাব খাটিয়ে ভাই মানিককে ২০২১ সালে ‘শিশু মুক্তিযোদ্ধার’ স্বীকৃতি আদায় করে নেন বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন কমলগঞ্জের এক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার।
জানা যায়, আব্দুস শহীদ নিজের, স্ত্রী ও সন্তানদের নামে শ্রীমঙ্গলে বাড়ি, ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে আটটি অ্যাপার্টমেন্ট, লেক ও বাগান বাড়ি করেছেন। ২০০৯ সালে চিফ হুইপ হয়ে তিনি কমলগঞ্জের সিদ্ধেশ্বরপুর গ্রামের নিজ বাড়িতে প্রভাব খাটিয়ে কোটি কোটি টাকা খরচে গ্যাস সংযোগ নেন।
মৌলভীবাজারের বামফ্রন্টের অন্যতম নেতা বিশ্বজিৎ বলেন, ‘সাবেক মন্ত্রী আব্দুস শহীদ কমলগঞ্জ-শ্রীমঙ্গলে লুটপাটের জন্য বাহিনী তৈরি করেছিলেন। তদন্ত করলে তাঁর আরও অপকর্ম বেরিয়ে আসবে।’
সরেজমিন কমলগঞ্জের চা-বাগানের পাশে বসবাসকারীরা জানান, পাহাড়জুড়ে আনারস চাষ হতো। তা কেটে বাগান তৈরি করেন আব্দুস শহীদ। বাগানে ১৩-১৪টি ডিপ টিউবওয়েল বসান। এ কারণে এখন পাহাড়িরা চাপকলে পানি পাচ্ছেন না।
আব্দুস শহীদ কৃষি মন্ত্রণালয়ে এপিএস (সহকারী একান্ত সচিব) সুবীর চন্দ্র দাসের মাধ্যমে নানা বাণিজ্য করেছেন। সুবীরের সঙ্গে ছিলেন আব্দুস শহীদের ভাই মানিক। মানিক ও সুবীর মিলে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরে গড়ে তোলেন সিন্ডিকেট।
আব্দুস শহীদের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির প্রাথমিক তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে দুদক। দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা আখতারুল ইসলাম জানিয়েছেন, তদন্তে সাবেক মন্ত্রী আব্দুস শহীদ, তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের নামে দেশের বিভিন্ন স্থানে বাড়ি-ফ্ল্যাটসহ অন্যান্য সম্পদের তথ্য মিলেছে। কানাডার ‘বেগম পাড়ায়’ স্ত্রীর নামে বাড়ি ছাড়াও আরও কয়েকটি দেশে তাদের বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ রয়েছে।