ইস্ট লন্ডন মসজিদের জুমার খুতবা : সূরা আল-ফাতিহা থেকে শিক্ষা
প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
শায়খ আনিসুল হক
ইসরা ও মিরাজের পবিত্র রাতে আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসুলের (সাঃ) উম্মতের জন্য পাঁচটি ওয়াজিব নামাজ নির্ধারণ করেছিলেন । যা মূলত ছিল পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজ । তবে আল্লাহ তায়ালার রহমত ও নবী (সাঃ) এর সুপারিশের মাধ্যমে তা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে পরিণত হয়েছে। তবে পুরস্কার এখনও পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজের সমান । এটি আল্লাহর অসীম দানশীলতা ও তাঁর বান্দাদের প্রতি ভালবাসার শক্তিশালী নিদর্শন।
ইস্ট লন্ডন মসজিদের সিনিয়র ইমাম শায়খ আনিসুল হক ৩১ জানুয়ারি শুক্রবার জুমার খুতবায় উপরোক্ত কথাগুলো বলেন।
খুতবার বিষয়বস্ত ছিলো সূরা আল-ফাতিহার গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে। তিনি বলেন, সুরাটি কুরআনের প্রথম অধ্যায় এবং আমরা নামাজের প্রতি রাকাতে পাঠ করে থাকি । এটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ন কারণ এটি আমাদের এবং আমাদের সৃষ্টিকর্তার মধ্যে সরাসরি একটি সংলাপ । একটি প্রসিদ্ধ হাদীসে নবী (সাঃ) আমাদের জানান যে, আল-ফাতিহা একটি দোয়া, যার মাধ্যমে আমরা আল্লাহর সাথে কথা বলি এবং প্রতিটি আয়াত পাঠ করার সাথে সাথে তিনি আমাদের উত্তর দেন।
সূরা আল-ফাতিহা থেকে প্রথম শিক্ষা হল কৃতজ্ঞতা । প্রথম আয়াতে বলা হয়েছে: “সব প্রশংসা আল্লাহর, যিনি বিশ্বজগতের রব”।
এই আয়াতটি আমাদেরকে আল্লাহর অসংখ্য নেয়ামতের প্রতি সচেতন ও কৃতজ্ঞ হতে স্মরণ করিয়ে দেয় । বর্তমান পৃথিবীতে আমরা অনেক সময় আমাদের যা নেই, সেটির প্রতি মনোযোগী হয়ে পড়ি, যা কৃতজ্ঞতার অভাব সৃষ্টি করে। কুরআন এর বিরুদ্ধে সতর্ক করেছে ।
সাবা এলাকার বাসিন্দাদের গল্প একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত । আল্লাহ তায়ালা তাদের বলেছেন: তোমরা তোমাদের রবের দান থেকে খাও এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হও। তোমাদের জন্য এটি একটি উন্নত ভূমি এবং তোমাদের প্রতিপালক ক্ষমাশীল (কুরআন, ৩৪:১৫)।
তাদের প্রচুর নেয়ামত থাকা সত্ত্বেও তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেনি, যার ফলে তারা সবকিছু হারিয়ে ফেলেছিল। এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, কৃতজ্ঞতা বরকত নিয়ে আসে, আর কৃতজ্ঞতার অভাব ক্ষতির দিকে নিয়ে যায়।
নবী (সাঃ) কৃতজ্ঞতার সবচেয়ে বড় উদাহরণ ছিলেন । যদিও তাঁর অতীত এবং ভবিষ্যতর সব গুনাহ মাফ করা হয়েছিল, তবুও তিনি দীর্ঘ সময় নামাজ পড়তেন, যার ফলে তাঁর পা ফুলে যেত। যখন আয়েশা (রা) প্রশ্ন করেছিলেন, কেন তিনি বারবার ক্ষমা চাচ্ছিলেন, নবী (সাঃ) উত্তর দিয়েছিলেন, “আমি কি কৃতজ্ঞ বান্দা হতে চাইব না?”
নবী (সাঃ) এর কৃতজ্ঞতা শুধু সুসময়ে সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং তিনি আমাদের শিখিয়েছেন যে, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত । যখন আমরা ঘুম থেকে উঠি, জামা কাপড় পরি, খাওয়া-দাওয়া করি, বা এমনকি কষ্টে থাকলেও, তিনি সবসময় কৃতজ্ঞতার মধ্যে থাকতেন। সত্যিকারের কৃতজ্ঞতা কোনো একক কাজ নয়, এটি একটি ধারাবাহিক অবস্থা।
পরবর্তী আয়াতটি আমাদেরকে আল্লাহর অসীম দয়া সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দেয়: “অত্যন্ত দয়ালু, অতি দয়াময়”।
আমরা প্রতিদিন বহুবার এই বাক্যটি তেলাওয়াত করি, তবে কিভাবে আমরা এর অর্থ সত্যিকার অর্থে প্রতিফলিত করি? অনেকেই তাদের গুনাহ নিয়ে হতাশ হয়ে পড়েন, মনে করেন তারা আর কখনও ক্ষমা লাভের যোগ্য নন, তবে আল্লাহর দয়া আমাদের কল্পনার চেয়েও বড়।
নবী (সাঃ) একদিন তাঁর সাথীদের প্রশ্ন করেছিলেন, “তোমরা কি কখনো কল্পনা করতে পারো যে, এক মা তার সন্তানকে আগুনে ছুঁড়ে ফেলবে? তারা না বলার পর, তিনি বললেন, “আল্লাহ তার বান্দাদের প্রতি তার থেকেও বেশি দয়ালু।” [মুসলিম]
আমরা যত দূরেই সরে যাই না কেন, আমরা যতই আল্লাহ তায়ালাকে ভুলে থাকি, আল্লাহর দয়া সবসময় আমাদের নাগালের মধ্যে রয়েছে। নবী (সাঃ) আমাদেরকে আশ্বস্ত করেছেন:
আল্লাহ রাতে তার হাত প্রসারিত করেন, যেন দিনের বেলায় যারা গুনাহ করেছে, তারা তাওবা করতে পারে, এবং দিনে তিনি তার হাত প্রসারিত করেন, যেন রাতে যারা গুনাহ করেছে, তারা তাওবা করতে পারে। [মুসলিম]
তাওবার দরজা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত খোলা থাকে। কোনো গুনাহ এত বড় নয় যে, আল্লাহ তা মাফ করবেন না; তিনি যা চান, তা হল আমরা আন্তরিকভাবে তার কাছে ফিরে আসি।
দয়া সম্পর্কে বলার পর, আল্লাহ আমাদেরকে হিসেব-নিকাশের কথা স্মরণ করিয়ে দেন: বলছেন, তিনি “বিচারের দিনের মালিক”।
যতক্ষণ না আমরা আল্লাহর দয়ার উপর ভরসা রাখি, ততক্ষণ আমাদের কর্মের ব্যাপারে সচেতন থাকা প্রয়োজন। আল্লামা ইবনুল কাইয়ুম, ইমানের মধ্যে আশা ও ভয় এই দুটি বিষয়কে পাখির দুটি পাখনার মতো বর্ণনা করেছেন । যদি কেউ কেবল আল্লাহর দয়ায় মনোযোগ দেয়, তবে তারা আত্মতৃপ্ত হয়ে পড়তে পারে, আর যদি তারা কেবল আল্লাহর শাস্তির দিকে মনোযোগ দেয়, তবে তারা হতাশ হয়ে পড়বে। প্রকৃত ইমান হল এই দুইয়ের মধ্যে সমতা রাখা—আল্লাহর দয়ার প্রতি আশা এবং তাঁর সামনে আমাদের হিসেব-নিকাশের প্রতি সচেতনতা।
হিসেব-নিকাশের এই স্মরণ আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আমাদের প্রতিটি সালাত একটি মুহূর্ত, যার জন্য আমরা জবাবদিহি করব । প্রতিটি দায়িত্ব যা আমরা পালন করি না, তার জন্য আমাদের জবাবদিহি হতে হবে । প্রতিটি অবিচারের জন্য, যা আমরা উপেক্ষা করি, তার সম্পর্কেও প্রশ্ন করা হবে। আমাদের দৈনিক নামাজ শুধু একটি ফরজ কর্তব্য নয়, এটি আমাদের মানসিকতা পুনর্গঠন করার একটি সুযোগ এবং আমাদের চূড়ান্ত হিসেব-নিকাশের কথা মনে করিয়ে দেয়।
এই সপ্তাহেই, আমি এক নারীর কাছ থেকে একটি ফোন পেয়েছিলাম, যিনি খুব দুঃখিত ছিলেন এবং মনে করছিলেন যে তাঁর গুনাহ এত বড় যে তিনি কখনও আল্লাহর কাছে ক্ষমা লাভ করতে পারবেন না। তিনি অপরাধবোধে আচ্ছন্ন ছিলেন। মনে করছিলেন যে তিনি খুব দূরে চলে গেছেন এবং আর কখনো আল্লাহ তাঁকে গ্রহণ করবেন না। আমি তাঁকে আল্লাহর প্রতিশ্রুতি স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম যে, তাঁর দয়া সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে এবং তাওবার দরজা সবসময় খোলা থাকে।
এটাই সূরা আল-ফাতিহার সৌন্দর্য। এটি প্রতিটি মুমিনের হৃদয়ের কথা বলে, আমাদের গভীর আত্মিক প্রয়োজনের উত্তরের সাথে—নিরাশার সময়ে আশা প্রদান করে, সুসময়ে কৃতজ্ঞতা অনুভব করায় এবং যখন আমরা অবহেলা করি, তখন আমাদের হিসেব-নিকাশের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
হে আল্লাহ, আমাদেরকে আপনার কুরআনের শিক্ষা বুঝতে এবং তার ওপর চলার তাওফিক দিন। আমাদেরকে কৃতজ্ঞ বানান, আপনার দয়া সঠিকভাবে উপলব্ধি করার জন্য আমাদেরকে পথ দেখান এবং বিচার দিবস সম্পর্কে সতর্ক থাকার তাওফিক দিন ।
শায়খ আনিসুল হক
সিনিয়র ইমাম
ইস্ট লন্ডন মস্ক এন্ড লন্ডন মুসলিম সেন্টার
৩১ জানুয়ারি ২০২৫