রমজানে নিজেকে রসনাবিলাস ও অপচয় থেকে মুক্ত রাখুন
প্রকাশিত হয়েছে : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
শাহনাজ সুলতানা:: প্রাকৃতিক নিয়মে আমাদের মাঝে আবার ফিরে এলো মাহে রমজান। আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের বাসনায় পৃথিবীর সমস্ত মুসলমানরা দীর্ঘ একমাস পার্থিব জগতের লোভ লালসা ও নানাবিধ অসংগতীপূর্ণ কার্যকলাপ থেকে নিজেকে বিরত রেখে পবিত্র কোরআনুল করিমের বিধি- বিধান জীবনে ধারণ করার অনুশীলন করবেন। পবিত্র রমজান হলো রহমত, বরকত, সবর, ধৈর্য্য, ত্যাগ ও তিতিক্ষার মাস, আর এ মাসের প্রতিদান হচ্ছে জান্নাত। এ মাস সৌহাদ্য ও সহমর্মিতার মাস, এ মসে মুমিনের রিজিক বাড়িয়ে দেয়া হয়। রসুলুল্লাহ (স:) বলেছেন এ মাস অন্যান্য মাসের চাইতে উত্তম, কারণ এ মাসে পবিত্র কোরআনুল করিমের জন্ম হয়েছে। এ মাসে যে যতবেশি ইবাদত করবেন ততই সওয়াব পাবেন।
পবিত্র রমজান যেহেতু ইবাদত এবং সংযমের মাস, আমাদের প্রত্যেকের-ই উচিত আল্লাহর ইবাদতে মনোনিবেশ করা। বাহারি রসনা বিলাস থেকে নিজেকে মুক্ত রেখে গরীব, অসহায় মানুষের মুখে সামর্থ অনুযায়ী খাবার তুলে দিয়ে ইহকাল সওয়াব এবং পরকালের শান্তির রাস্তা মসৃণ করা। রাসুলুল্লাহ (স.)-বলেছেন রমজান মাসে যে ব্যক্তি কোন রোজাদারকে ইফতার করাবে প্রতিদান স্বরুপ তার গোনাহ মাফ করে দেয়া হবে এবং তাকে জাহান্নাম থেকে নিষ্কৃতি দেয়া হবে। আমরা কি সত্যিকার অর্থে রাসুলুল্লাহ (স.) এর বাণীকে যথাযথভাবে অনুসরণ করছি, গরীব অসহায় মানুষের কথা ভেবে নিজেদের অপচয় এবং অতিরিক্ত রসনা বিলাস থেকে সংযত করতে পেরেছি? আমার মনে হয় না। প্রতিবছর রমজান এলে আমরা যে ভাবে বাহারী ইফতারি নিয়ে প্রতিযোগীতায় নামি সেটাই তার প্রমাণ।
আমাদের সমাজে একটি চিরচারিত নিয়ম মেয়ে বা বোনের বিয়ে হলে তাদের শ্বশুড় বাড়িতে খুব ঘটা করে হাজার হাজার টাকা খরচ করে ইফতার পাঠানো। অনেকের ধারণা যত বেশি ইফতার মেয়ে বা বোনের বাড়ী পাঠানো হবে তত বেশি তাদের মুখ উজ্বল হবে শ্বশুড় বাড়িতে। কিন্তু ইসলাম ধর্মে কোথাও রমজান মাসে মেয়ে, বোন বা ভাইয়ের বাড়িতে ইফতার পাঠানো বাধ্যতামূলক বলে উল্লেখ নেই। এরপরও কেনো আমাদের অভিববাকরা এই প্রথাটিকে আকড়ে ধরে অনেক টাকা নষ্ট করেন তার উত্তর আমার জানা নেই।
নিজ দেশে আমাদের কাছের এবং দূরের অনেক আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-পড়শী রয়েছেন, যারা একদিন খাবার খেলে দ্বিতীয় দিন উপোষ থাকেন। এমন কি রমজান মাসেও অনেকে খাবারের অভাবে পানি খেয়ে রোযা রাখেন এবং ইফতারের সময় পর্যাপ্ত খাবার সংগ্রহ করতে হিমশিম খান। কিন্তু আমরা তাদের কথা কি একবারও ভাবি? হাদিস শরীফে উল্লেখ রয়েছে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন- যে ব্যক্তি কোন রোজাদারকে পরিতৃপ্ত করে আহার করাবে আল্লাহতায়ালা তাকে হাউজে কাওসার হতে এতে বেশি পানীয় পান করাবেন যার ফলে জান্নাতে প্রবেশ না করা পর্যন্ত সে কখনও পিপাসিত হবে না। আমরা সে দিকে লক্ষ্য না রেখে, নিজ গরীব আত্বীয়-স্বজনের মুখে খাবার তুলে না দিয়ে নিজের খেয়ালখুশি অনুযায়ী তিন থেকে পাচশত পাউন্ড নষ্ট করে মেয়ে ও বোনের বাড়িতে ইফতার পাঠাই। ইবাদত বন্দেগীতে সময় ব্যয় না করে দুপুর থেকে রান্নাঘরে প্রতিদিন দশ বারো রকমের বাহারি ইফতার তৈরিতে ব্যস্ত থাকি। দীর্ঘসময় ব্যয় করা অধিকাংশ খাবার ইফতারের পর চলে যায় ডাষ্টবিনে। কারণ সারাদিন উপবাসের পর এতো খাবার একসাথে কেউ খেতে পারেন না, শরীর খারাপের কথা চিন্তা করে বাসী খাবারও আর খাওয়া হয় না।
আল্লাহতায়ালা অপচয়কারীকে পছন্দ করেন না জেনেও আমরা সময় এবং অর্থ দুটোই অপচয় করি প্রতিদিন। আমাদের উচিত পবিত্র রমজানে এসব অপচয় বন্ধ করে নিজ সামর্থ অনুযায়ী গরিব অসহায় ভাই-বোনদের পাশে দাঁড়ানো এবং তাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করে দেওয়া। যে সমস্ত কাজে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন করা যায় সে সব কাজ করা উচিত। নিজেদের মনগড়া প্রথা দিয়ে কখনও লাভবান হওয়া যায় না বরং ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি।
বাংলাদেশে আমাদের পরিচিত অনেক বাবা-মা আছেন, যাদের সামর্থ নেই কিন্তু সামাজিক লজ্জা নিবারণের জন্য মেয়ের বাড়ীতে ইফতারী পাঠানোর টাকা পয়সা যোগাড় করতে হিমশিম খান এবং সময়মতো পর্যাপ্ত টাকা যোগাড় করতে না পারলে বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে টাকা পয়সা কর্জ করে ইফতারি দেওয়ার প্রথা রক্ষা করেন। এর ফলশ্রুতিতে বাবা-মাকে পরবর্তীতে ঋণের টাকা শোধ করতে কি পরিমাণ কষ্ট করতে হয়, এখানে তার একটি জলন্ত প্রমাণ উল্লেখ করছি।
বেশ কয়েক বছর পূর্বে বাংলাদেশে আমার এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। ঐ আত্মিয়ের বাড়িতে মধ্যবয়সী এক কাজের মহিলা বলেছিলেন তাকে কিছু টাকা সাহায্য করার জন্য। উত্তরে বলেছিলাম কি জন্য এই সাহায্য চাওয়া। জবাবে উনি বলেছিলেন, মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন । মেয়ের বাড়িতে শবে-বরাতের নাস্তা, রমজানে ইফতারি এবং ঈদের নতুন কাপড় পাঠানো বাবত বেশ কিছু টাকা তার ঋণ হয়েছে। সেগুলো এখন পরিশোধ করতে পারছেন না। ঋণের টাকা পরিশোধের চিন্তায় রাতে ভাল ঘুম হয় না, মেজাজ থাকে কিটকিটে। জবাবে বলেছিলাম, এগুলো মেয়ের বাড়িতে না পাঠালে ওর কি কোন ক্ষতি হতো? উত্তরে উনি বলেছিলেন, ”কিতা যে কইন আপা, পুরি নয়া বিয়া দিছি, ইতা না পাটাইলে মাইনষর কাছে মুখ দেখাইমু কিলা, আর পুরিয়ে অবা হউর বাড়িত চলব কিলা”। সেদিন উনাকে এ ব্ষিয়ে বাড়তি কোন কিছু বলিনি, আর বললেও তিনি তা গ্রহন করতেন না বলেই মনে হল।
কারণ আমাদের সমাজ কিছু কু-প্রথার বীজ এমন ভাবে রোপণ হয়েছে যার বেড়াজাল থেকে মুক্ত হতে হলে সামাজের প্রতিটি মানুষকে-ই সোচ্চার হতে হবে। আর সেটা শুরু করতে হবে নিজ পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-পড়শীর মধ্য দিয়ে। তবে এখানে একটি কথা বলা বাহুল্য যে বাধ্যতামূলক ইফতারি খাওয়ার প্রথা বিগত কয়েক বৎসর থেকে আমাদের পরিবার বর্জন করে আসছে। এতে করে আমাদের উভয় পক্ষেরই অনেক সময় ও অর্থ বেঁচে যাচ্ছে। নিজ ইচ্ছায় কাউকে বাড়ীতে ঢেকে ইফতার খাওয়ানো বা কারো বাড়িতে ইফতার পাঠানো ভাল, তবে অতিরিক্ত অপচয়, বাহারি রসনাবিলাস ও আত্মীয় স্বজনের বাড়ীতে ইফতার পাঠানো রীতি হিসাবে মেনে নিয়ে টাকা পয়সা কর্জ করে এ কাজগুলো সমাধান করা মোটেই উচিত নয় বলে মনে করি। রমাজান মাস যেহেতু রহমত, বরকত এবং মাগফেরাতের মাস তাই এই মাসে আল্লাহর ইবাদতে মনোনিবেশ করা উচিত। নিজদের তৈরী বাধ্যতামূলক সব কু-প্রথা ও কু-ধারণা থেকে প্রত্যেকেরই উচিত যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেরিয়ে আসা তবে এ ব্যাপারে বিশিষ্ট আলেম- ওলামারাও যাথাযোগ্য ভুমিকা পালন করতে পারেন বলে আমাদের বিশ্বাস ।
পবিত্র রমাদ্বান আমাদের জন্য নিয়ে আসুক অনাবিল শান্তি। সবার প্রতি পবিত্র ঈদুল ফিতরের অগ্রিম শুভেচ্ছা।