জাতির অগ্রগতি জন্য প্রয়োজন নারী সমাজের উন্নয়ন
প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ মার্চ ২০২৫
শাহনাজ সুলতানা :: আন্তর্জাতিক নারী দিবস প্রতি বছর ৮ মার্চ উদযাপিত হয়। নারী দিবস নারীদের কৃতিত্ব এবং সফলতা উদযাপনের একটি বিশেষ দিন। এ দিন নারীর অধিকার, সমতা ও ক্ষমতায়নের প্রতীক এবং এ দিন নারীদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ভূমিকা, সংগ্রাম এবং অর্জনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এ দিন সারা বিশ্বে নারীর প্রতি বৈষম্য পক্ষপাতিত্ব দূর করে সমতা প্রতিষ্টার লড়াইকে প্রতিনিধিত্ব করে। এ বছর (২০২৫) সালের নারী দিবসের থিম হলো “অ্যাক্সিলারেট অ্যাকশন”।
“অ্যাক্সিলারেট অ্যাকশন” বলতে আমরা বুঝি জরুরীতা, অন্তর্ভুক্তি এবং রূপান্তরমূলক পরিবর্তনের আহবান ৷ এটি ইঙ্গিত দেয়, সমতার জন্য অপেক্ষার প্রয়োজন পড়ে না। নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়নের অগ্রগতি ত্বরান্বিত করা সকলের দায়িত্ব এবং তা বাস্তবায়নে সকল ক্ষেত্রকে এক সাথে কাজ করা প্রয়োজন। “অ্যাক্সিলারেট অ্যাকশন” এর আরো অর্থ হল অকার্যকর অনুশীলনের বাইরে যাওয়া। ব্যক্তিগত এবং পেশাগত উভয় ক্ষেত্রে নারীরা যে পদ্ধতিগত বাঁধা এবং পক্ষপাতের মুখোমুখি হন তা স্বীকার করে মোকাবেলায় সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে পরিবর্তন দ্রুত বাস্তবায়ন করা। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, আগামী পাঁচ প্রজন্ম অর্থ্যাৎ ২১৫৮ সাল পর্যন্ত সময় লাগবে বিশ্ব সম্পূর্ণ লিঙ্গ সমতায় পৌঁছাতে।
নারী দিবসের সূচনা ১৮৫৭ সালে শ্রমজীবী নারীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের মাধ্যেমে। সে সময় নারী শ্রমিকরা দীর্ঘঘন্টা কাজ, কম মজুরি এবং ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলেন। বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ থেকেই মূলত শুরু হয় নারী দিবসের যাত্রা। ১৯০৮ সালে যুক্তরাষ্টের নিউইয়র্ক শহরে প্রায় ১৫,০০০ সূতা কারখানার নারী শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে ভোটাধিকার, কর্মস্থলে কর্মঘন্টা কমানো এবং ন্যায্য মজুরির জন্য বিক্ষোভ করেন। জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে ১৯০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারী নিউইয়র্ক শহরে ডেমোক্রেটিক নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রথম আন্তজার্তিক নারী সম্মেলন অনুষ্টিত হয়। এরপর ক্লারা ১৯১০ সালে কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত কর্মজীবি নারীদের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ৮মার্চ নারী দিবস উদযাপনের প্রস্তাব দেন। উক্ত সম্মেলনে উপস্থিত ১৭টি দেশের ১০০ জন কর্মজীবি নারী সর্বসম্মতিক্রমে তার প্রস্তাবকে সমর্থন করেন। প্রথম বিশ্বনারী দিবস পালিত হয় ১৯১১ সালে অষ্টিয়া, ডেনমার্ক, জার্মানি এবং সুইজারল্যান্ডে। বাংলাদেশে নারী দিবস আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় ১৯৯০-এর দশকে। প্রতি বছর নারী দিবস পালন হয় নিদিষ্ট একটি থিমে।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপনে মিসেস জেটকিনের মূল ধারণা একটি নির্দিষ্ট দিনের মধ্যে আবদ্ধ ছিল না। ১৯১৭ সালে যুদ্ধকালীন সময়ে রাশিয়ান নারীরা “রুটি এবং শান্তি” নামে ধর্মঘট করেন ভোটাধিকার দাবী করেন। ধর্মঘটের চারদিনের মধ্যে জার পদত্যাগ করতে বাধ্য হয় এবং সে সময়ের অস্থায়ী সরকার নারীদের ভোট দেয়ার অধিকার প্রদান করেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন ৮ মার্চ নারী দিবস ঘোষণা করে। জাতিসংঘ ১৯৭৫ সালে, আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয় এবং ঐ বছরকে নারীবর্ষ ঘোষনা করে। ১৯৭৭ সালে জাতিসংঘ সদস্য দেশগুলোকে ৮মার্চ নারী দিবস পালনে আহবান জানায়।
নারীরা সমাজের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। নারীদের উন্নয়ন ছাড়া কোনো জাতির অগ্রগতি অসম্ভব। একটি পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট গঠনে নারীদের ভূমিকা অতুলনীয়, অপরীসিম। বর্তমান বিশ্বে প্রতিটি সেক্টরে নারীরা পুরুষের সাথে তাল মিলিয়ে অবদান রাখছেন। কর্ম দক্ষতার জোরে তারা স্বপ্নের সোনালী সিঁড়ি বেয়ে অর্জন করছে সাফল্য। ইতিহাস খুঁজলে আমরা দেখতে পাই, শুধুমাত্র বর্তমানে নয় অতীতেও বিভিন্ন চ্যালেন্জিং পেশাতে নারীদের ভূমিকা ও অবদান ছিলো প্রশংসনীয়। নারীদের ভোটের দাবিদার সাফ্রাগেটস থেকে শুরু করে তেজস্ক্রিয়তার বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাতা মেরি কুরি এবং রোজালিন্ড ফ্র্যাঙ্কলিনের ডিএনএর গঠন আবিষ্কার তার প্রমাণ।
নারীদের অর্জনের ইতিহাস আরো গভীর ও অতীতে থাকালে আমরা দেখতে পাই ফ্রান্সিস পারকিন্স ছিলেন প্রথম নারী যিনি ১৯৩৩ সালে রাষ্ট্রপতির মন্ত্রিপরিষদ সদস্য হিসাবে কাজ করেন। রিটা মোরেনো প্রথম ল্যাটিন নারী যিনি ১৯৬২ সালে অস্কার জয় করেছিলেন। ভ্যালেন্টিনা তেরেশকোভা ছিলেন প্রথম নারী যিনি ১৯৬৩ সালে মহাকাশ ভ্রমণ করেছিলেন। ১৮৪৩ সালে প্রতিভাধর গণিতবিদ অ্যাডা লাভলেস প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রাম তৈরী করেন। ১৯৭১ বারডেট-কাউটসকে দরিদ্রদের পক্ষে কাজ করার জন্য রানী ভিক্টোরিয়া তাকে ব্যারোনেস খেতাব পেয়েছিলেন। ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল ব্রিটেন এবং রাশিয়ার মধ্যে ক্রিমিয়ান যুদ্ধের (১৮৫৩-১৮৫৬) সময় ব্রিটিশ সামরিক নার্সদের প্রথম সরকারী দলকে তুরস্কে নেতৃত্ব দেন। এছাড়াও আরো নারীরা আছেন যারা তাদের কর্ম দক্ষতায় সাফলতা অর্জন করে ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছেন।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক নারী দিবস একটি জাতীয় ছুটির দিন। নারী দিবসকে কেন্দ্র করে মার্চ, আলোচনা, কনসার্ট, প্রদর্শনী এবং বিতর্ক সহ বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করা হয়।আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ওয়েবসাইটের বাহ্যিক অনুসারে বিশ্বের বহু দেশে নারী দিবসে নারীরা বেগুনি, সবুজ এবং সাদা রঙের কাপড়, ব্যাগ অথবা জুয়েলারী ব্যবহার করেন । তারা মনে করেন “বেগুনি ন্যায়বিচার এবং মর্যাদাকে নির্দেশ করে, সবুজ আশার প্রতীক এবং সাদা বিশুদ্ধতার প্রতিনিধিত্ব করে। উল্লেখ্য ১৯০৩ সালে যুক্তরাজ্যে উইমেন সোশ্যাল অ্যান্ড পলিটিক্যাল ইউনিয়ন (ডব্লিউএসপিইউ) নামে প্রতিষ্ঠিত একটি গ্রুপ ভোটপ্রদান লড়াইয়ের জন্য এই রঙগুলি ব্যবহার করে।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস শুধুমাত্র একটি দিনে উদযাপনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা ঠিক নয়। আমাদের উচিত নারীর ক্ষমতায়ন, সমতা ও ন্যায়বিচারের চলমান আন্দোলনের প্রতি সহমত প্রকাশ করা। নারীর অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে বৈষম্য নিরসনে কাজ করা, নারীদের শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং নেতৃত্ব উদ্ভাবনের সুযোগ প্রদানে অগ্রাধিকার দেয়া। শুধুমাত্র সমাজের বিভিন্ন সেক্টরের নয়, নারীর প্রতিভা বিকাশে পরিবারের সদস্যদের দৃষ্টিভঙ্গী বদলানো এবং সমতার পরিবেশ তৈরী করা অত্যন্ত প্রয়োজন। নারীর আত্মমর্যদাসম্পন্ন ও আত্মবিশ্বাসী করে গড়ে তোলা পরিবারের দায়িত্ব। নারীকে বাদ দিয়ে একটি জাতি কখনো সম্পূর্ণ হওয়া সম্ভব নয়। বিশ্বে সমতা অর্জন হলেই সত্যিকার অর্থে একটি জাতির সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব। আসুন, সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নারীকে সামনে এগিয়ে যাবার পথ সুগম করি।
শাহনাজ সুলতানা : কবি ও লেখক