মাইজীর মৃত্যু ও স্মৃতি কথা
প্রকাশিত হয়েছে : ২২ মার্চ ২০২৫
আকবর হোসেন:: ‘মাইজী’, একটি সুমধুর ডাক। মা, আম্মা, মাইজী সব একই জিনিসের নাম। যিনি গর্ভে ধারণ করেন তিনিই মা। আমার বিয়ের পর শাশুড়িকে আমি মাইজী বলে ডাকতাম আর শ্বশুর সাহেবকে (মরহুম আলহাজ আব্দুল মন্নান, টুইকেনহাম, গ্রাম: লুদরপুর, জগন্নাথপুর) ‘বাবাজি’।
শ্বাশুড়িমা আমাকে পরম আদরে ‘বাজান’ বলে ডাকতেন। আজ আর কেউ এমন মায়াবী সুরে ডাকবে না। সেই মাইজী (নাহার বেগম মন্নান) আর দুনিয়াতে নেই। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন (নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর এবং নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছেই ফিরে যাবো)।
গত ১৭ মার্চ অর্থাৎ ১৭ রামাদান সোমবার দিবাগত রাত দেড়টায় পশ্চিম লন্ডনের ওয়েস্ট মিড হসপিটালে তিনি ইন্তেকাল করেন। তিনি জগন্নাথপুরের স্বনামধন্য ব্যবসায়ী হবিবপুর নিবাসী মরহুম ইসমত উল্লাহ সাহেবের একমাত্র মেয়ে ছিলেন।
গত ১৮ মার্চ হাউন্সলো জামিয়া মসজিদে নামাজে জানাজা শেষে পাউডার মিল লেনে (যেখানে আমার শ্বশুরও শুয়ে আছেন) দাফন করা হয়।
এটাই ছিল তাঁর আশা। মরহুমার জানাজায় পরিবারের সদস্য, অনেক আত্মীয়-স্বজন, শুভকাঙ্খী, প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধবসহ অনেক মানুষ অংশ নেন। এমনকি মরহুমার ইংলিশ ফ্রেন্ডস রাও মরহুমাকে শেষ শ্রদ্ধা জানান তার অসুস্থতার খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে যান।
আমি শুরুতেই উনাদের বলেছিলাম, আমার আব্বা একজন এবং আম্মাও একজন। আমি এই নামে আর কাউকে ডাকতে পারবো না। তাই আপনাদের আমি বাবাজি ও মাইজী বলে ডাকতে চাই। তাঁরা আমার কথায় সায় দিয়েছিলেন। সেই থেকে বাবাজী আর মাইজী ডাকের শুরু।
মাইজীর সাথে অনেক স্মৃতি কথা, কী লিখবো! তিনি একজন অমায়িক, স্বল্পভাষী, দানশীল, পরোপকারী, আত্মীয়-স্বজনের সাথে সম্পর্করক্ষাকারী, অতিথিপরায়ণ, আল্লাহর একজন প্রিয় বান্দা। এক কথায় একজন সুন্দর মনের মানুষ ছিলেন। তিনি মেহমান পছন্দ করতেন। মানুষকে হৃদয় উজাড় করে ভালবাসতেন। তাইতো তাঁর খবর শুনে অনেক মানুষ ছুটে এসেছেন। যার প্রমাণ মরহুমার জানাজায় মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি।
আমাকে তিনি খুবই স্নেহ করতেন। মায়া করতেন। আজকে সেই মায়ার মানুষের প্রয়াণে নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে। কোনো ভালো খাবার, ট্রেডিশনাল খাবার আমাকে ফেলে খেতেন না। শরীর ভালো থাকলে নিজেই রান্না করতেন। নিজের চোখে দেখে খাবার সামগ্রী কিনে আনতেন। আর আমিও জিজ্ঞেস করতাম ইস্ট লন্ডনে গেলে কিছু লাগবে কি-না। কারণ আমাদের এখানে কোনো গ্রোসারি শপ নেই। পাশে হাউন্সলোতে যেতে হয়। আমাদের মুরুব্বিরা একে একে চলে যাচ্ছেনপরপারে। রেখে যাচ্ছেন তাদের লেগেসি। আমরা কী তাদের দেখানো পথে চলতে পারবো?!
এরকম দিলখোলা মানুষের শূন্যতা কী করে পূরণ হবে! আমাদের যেনো সেলফিস মনে হয়। কিন্তু তাদের জেনারেশন সবাইকের উজাড় করে দিতেন। আত্মীয়-স্বজনের সাহায্য-সহযোগিতা, মানুষকে মহব্বত করা, খাওয়ানো, দান করা অপরের অসুবিধা দূর করতে ঝাঁপিয়ে পড়া এসব মানবীয় গুণাবলী কী সবার মাঝে আছে? আমরা এখন খুব বিজি। অনেকে নিজেদের নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। কিন্তু মাইজীর মতো যারা তারা তো সেলফলেস ছিলেন। তারা মানুষের আনন্দে আনন্দিত হতেন; তাদের দুঃখে কাঁদতেন।
আমার ভালো লাগছে যে আমি আমার মাঈজীকে নিয়ে আল্লাহর ঘরে দুবার যেতে পেরেছি। বাংলাদেশসহ অন্যান্য জায়গায়ও ট্র্যাভেল করেছি। আমি প্রাণখোলে দোয়া করি মাইজীর মাগফিরাতের জন্য। আমাদের যেসকল আত্মীয়-স্বজন দুনিয়া থেকে চলে গেছেন তাদের জন্য। আল্লাহতালা পরিবারের সব সদস্য, গুণগ্রাহীদের এ শোক বইবার তাওফিক দিন।
মাইজীর ভাগ্য ভালোই বলতে হবে। তিনি অসুস্থতার কারণে অনেক কষ্ট করলেও পবিত্র রামদ্বান মাসে ইন্তেকাল করেছেন। স্বজনরা ছাড়াও অগণিত মানুষ তার জন্য দোয়া করেছেন এবং আমরা সবাই শেষ মুহূর্তে তার পাশে ছিলাম। সূরা ইয়াসিন পড়েছি। কোরআন তিলাওয়াত করেছি। কলিমা পড়েছি। প্রাণভরে দোয়া করেছি। এই প্রথম খুব কাছ থেকে কোনো আপনজনের অন্তিম মুহূর্ত দেখার অভিজ্ঞতা হলো। দেখলাম, শেষমুহূর্তে আমরা কত অসহায়! মৃত্যুপূর্ব কয়েক সপ্তাহ ওয়েস্টমিড হসপিটাল আমাদের যেনো সেকেন্ড হোমে পরিণত হয়েছিলো। তাঁকে দেখতে হাসপাতালে ছিলো স্বজনদের ভিড়! ফ্যামিলি ওয়েটিং রুম ছিল আমাদের দখলে।
মার্চ মাসের শেষদিকে স্প্রিং শুরুর প্রাক্কালে দিনটি খুবই রৌদ্রোজ্জ্বল ছিল। নীল আসমান আর কবরের নীরবতার মাঝে কী যেন এক অপূর্ব মিলন! মরহুমাকে সমাহিত করা হলো শেষ ঠিকানায়, মাটির বাড়ি, মাটির ঘরে। মিনহা খালাকনাকুম ওয়া ফিহা নুঈদুকুম ওয়ামিনহা নুখরিজুকুম তা রাতান উখরা অর্থাৎ আমি মাটি থেকে তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি। আর মাটিতেই তোমাদেরকে ফিরিয়ে আনব এবং পুনরায় তোমাদেরকে মাটি থেকে বের করব (সূরা : তাহা আয়াত ৫৫)।
লেখক : সাংবাদিক, টুইকেনহাম, ওয়েস্ট লন্ডন, ১৯ মার্চ ২০২৫।