ইস্ট লন্ডন মসজিদের জুমা’র খুতবা : রমজানের আমল কিভাবে ধরে রাখবেন?
প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ এপ্রিল ২০২৫
শায়খ আব্দুল কাইয়ুম
আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহর অশেষ রহমত ও করুণায় আমরা আরেকটি রমজান অতিবাহিত করলাম । আমরা দেখেছি, পুরো রমজান মুসল্লীদের পদচারনায় কীভাবে মসজিদ ভরে উঠেছিলো, কুরআনের তিলাওয়াত বেড়েছিলো, আর ইবাদতের প্রতি ছিল এক অনন্য আন্তরিকতা। আল্লাহ আমাদের সকলের পক্ষ থেকে তা কবুল করুন, আমীন।
রমজান চলে যাওয়ার পর, আমি নিজেকে এবং আপনাদের সবাইকে একটা প্রশ্ন করি –আজ আমাদের আত্মকি অবস্থা কেমন? আমরা কি আল্লাহর সঙ্গে গড়ে তোলা সম্পর্ক ধরে রাখতে পেরেছি, নাকি আবার সরে গিয়েছি? রমজানের পরে, এই মুহুর্তটা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপুর্ণ। কারণ আমাদের কর্মকাণ্ডই ইঙ্গিত দেবে আমাদের ইবাদত গ্রহণ হয়েছে কি না।
উলামারা বলেন, রমজানের আমল কবুল হওয়ার অন্যতম প্রমাণ হলো, রমজানের পরেও ভালো কাজ চালিয়ে যাওয়া। যদি আমরা নামাজ, কুরআন তিলাওয়াত, রোজা এমনকি ছোট পরিসরেও চালিয়ে যাই, তাহলে এটা একটি ভালো লক্ষণ। কিন্তু যদি কুরআন আবার পরের রমজান পর্যন্ত বন্ধ করে রাখি, সুন্নাত রোজা ছেড়ে দেই, মসজিদে যাওয়া বন্ধ করি, আর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে অবহেলা করি- তাহলে আমাদের চিন্তিত হওয়া উচিত।
আমাদের মধ্যে কে চায় তার রমজান কবুল না হোক? আল্লাহ আমাদের সবাইকে সেই আশঙ্কা থেকে হেফাজত করুন। আমাদের উচিত, দৃঢ় সংকল্প নিয়ে রমজানের চেতনাকে আমাদের অন্তরে ধরে রাখা।
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে বলেন: “নিশ্চয়ই যারা বলে, ‘আমাদের প্রভু আল্লাহ’, এরপর তারা অবিচল থাকে — তাদের নিকট ফেরেশতাগণ অবতরণ করে বলেন, ‘ভয় করো না, দুঃখ করো না, বরং সেই জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহণ করো, যার প্রতিশ্রুতি তোমরা পেয়েছো।’- সূরা হা-মীম সাজদাহ (৪১:৩০)।
এটি কুরআনের অন্যতম আশাজাগানিয়া আয়াত । যখন একজন মুমিন মৃত্যুর মুখোমুখি হয়, আর পরকালীন ভয়ের ছায়া তাকে ঘিরে ধরে, তখন ফেরেশতারা এসে তাকে সান্তনা দেন: “ভয় করো না, দুঃখ করো না, তোমার জন্য জান্নাত রয়েছে।” এই ফেরেশতারা শুধু মৃত্যুর সময় নয়, কবর এবং কিয়ামতের দিনেও সঙ্গী থাকবে-যদি মৃত ব্যক্তি আল্লাহর আনুগত্যে অবিচল থাকে।
পরিষ্কারভাবে বলছি, ইসলাম কোনো মৌসুমি বিষয় নয়। আমরা শুধু রমজানের মুমিন নই, আমরা সারা বছরই মুমিন। আল্লাহ নির্দেশ দেন: “এবং তোমার প্রতিপালকের ইবাদত করো যতক্ষণ না তোমার নিকট সেই নির্ধারিত মুহুর্তটি (অর্থাৎ মৃত্যু) আসে।”— সূরা হিজর (১৫:৯৯)
আমাদের ইবাদত এক মাসে শেষ হয় না। মৃত্যুর আগে আমাদের কোনো শেষ নেই। কতটা দুঃখজনক সেই ব্যক্তি, যে তার ইসলামকে শুধু রমজানের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখে। আমাদের পূর্বসূরিদের একজনকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল তাদের সম্পর্কে, যারা রমজানে খুব সক্রিয়, কিন্তু এরপর হারিয়ে যায় । তিনি বলেছিলেন: “তারা এমন এক জাতি, যারা শুধু রমজানে আল্লাহকে চেনে।” আমরা এমন হতে চাই না। আমরা হতে চাই এমন লোক, যারা সারাজীবন ইসলাম নিয়ে বাঁচবো, আমাদের কাজ, পারিবারিক জীবন, এমনকি ঘুমও আল্লাহকে রাজি করার নিয়তে হতে হবে।
নিজেকে এবং আপনাদের সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি নবী করীম (সাঃ) এর একটি প্রেরণাদায়ক হাদীস: “আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় আমল হলো সেটি, যা নিয়মিত করা হয়, যদিও তা অল্প।” (সহীহ বুখারী)।
আর তিনি (সাঃ) আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আল-আস যিনি ইবাদতে খুব আগ্রহী ছিলেন: তাঁকে বলেছিলেন, “হে ‘আবদুল্লাহ, অমুকের মতো হয়ো না, যে রাতে তাহাজ্জুদ পড়তো, কিন্তু পরে তা পরিত্যাগ করেছিল।” (সহীহ বুখারী)।
আমরা কেউ এমন যেন না হই, যারা শুরুতে ইবাদতে খুব আগ্রহী, আর পরে সব ছেড়ে দেই। যে ব্যক্তি সত্যিকারের আল্লাহকে ভালোবাসে, সে কখনো ইবাদতে ক্লান্ত হয় না । তার হৃদয় আল্লাহর স্মরণে জাগ্রত থাকে এবং সে তার প্রভুর সান্নিধ্যে আনন্দ খুঁজে পায়।
আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহুর্ত আল্লাহর নৈকট্য লাভের সুযোগ । আমরা যেন সময় নষ্ট না করি । উলামারা বলেন, আল্লাহর স্মরণ ছাড়া কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত কিয়ামতের দিনে অনুতাপের কারণ হবে। আমরা যেন আমাদের দৈনন্দিন কাজকেও ইবাদতে রূপান্তর করি । হালাল উপায়ে রুজি, পরিবারের প্রতি যত্ন, ভালোবাসা, পড়াশোনা, বিশ্রাম- সবই সওয়াবের কাজ হতে পারে, যদি নিয়ত হয় সঠিক । তবে এতে যেন ফরজ দায়িত্বগুলো যেমন: নামাজ, সদকা, কুরআন তিলাওয়াত ও জিকির কখনো বাদ না পড়ে।
আসুন আমরা অব্যাহত রাখি:
জামাতে নামাজ পড়া, প্রতিদিন একটু হলেও কুরআন তিলাওয়াত, দান করা, সকাল-সন্ধ্যায় জিকির করা, সুন্নাত রোজা রাখা- যেমন প্রতি সপ্তাহে সোমবার ও বৃহস্পতিবার এবং শাওয়ালের ছয়টি রোজা।
আল্লাহ আমাদেরকে যেন তাঁর ইবাদতে অবিচল রাখেন, তাঁর হিদায়াতে দৃঢ় রাখেন এবং প্রতিটি কাজে যেন আন্তরিকতা দান করেন। তিনি যেন আমাদের অন্তরকে তাঁর ভালোবাসায় ভরিয়ে দেন, আমাদেরকে রমজানের উদ্দীপনা সারা বছর ধরে রাখার শক্তি দেন এবং আমাদেরকে একটি উত্তম প্রতিফল দান করেন।
হে আল্লাহ, আমাদের আমলগুলো কবুল করুন, আমাদের ভুলগুলো ক্ষমা করুন, আর আমাদেরকে সেই অবস্থায় তোমার সাথে মিলিত করো, যেখানে তুমি আমাদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকো। আমীন।
শায়খ আব্দুল কাইয়ুম: প্রধান ইমাম ও খতীব, ইস্ট লন্ডন মসজিদ এন্ড লন্ডন মুসলিম সেন্টার