থ্যালাসেমিয়া কী, কেন হয়, প্রতিকার কী?
প্রকাশিত হয়েছে : ১২ মে ২০২৫

ইংল্যান্ডে প্রায় ২,১০০ জন মানুষ থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত (NHR – Home), এবং প্রতি বছর প্রায় ৩৫টি নবজাতক শিশু এই রোগে আক্রান্ত হয় বলে নির্ণয় করা হয়েছে। (Sickle cell and thalassaemia screening: data report 2019 to 2020 –GOV.UK)। এই জিনগত রক্তজনিত রোগগুলো প্রধানত ভূমধ্যসাগরীয়, দক্ষিণ এশীয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় এবং মধ্যপ্রাচ্যের মানুষদের হয়ে থাকে।এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা হয় খুব অল্প হিমোগ্লোবিন তৈরি করে বা একেবারেই তৈরি করে না। এটি একটি বড় সমস্যা, কারণ হিমোগ্লোবিনের মাধ্যমেই রক্তের লাল কণিকা শরীরের বিভিন্ন অংশে অক্সিজেন পৌঁছে দেয়।
থ্যালাসেমিয়াজনিত স্বাস্থ্য সমস্যা জীবনের শুরুতেই দেখা যায়। রোয়ান্না মহারাজ, যিনি ত্রিনিদাদ ও টোবাগোতে জন্মের চার মাস পর ‘বেটা থ্যালাসেমিয়া মেজর’-এ আক্রান্ত হন, যা থ্যালাসেমিয়ার সবচেয়ে মারাত্মক ধরন। রোয়ান্না বলেন: “আমার মা বলেন, আমি এক সময় ছিলাম প্রাণবন্ত, হাসিখুশি এক নবজাতক । হঠাৎ করেই আমি নিস্তেজ হয়ে পড়ি এবং খাওয়া বন্ধ করে দেই । তিনি বুঝতে পেরেছিলেন কিছু একটা ভুল হচ্ছে এবং বারবার শিশু চিকিৎসকদের কাছে অনুরোধ করেন কারণ খুঁজে বের করতে।
“স্যান্ডওয়েল ও ওয়েস্ট বার্মিংহাম হাসপাতালের কনসালটেন্ট হেমাটোলজিস্ট ডা. শিবান পাঞ্চাম বলেন, “থ্যালাসেমিয়া যুক্তরাজ্যে বিরল । এটি একটি বংশগত রোগ, একে ‘ধরা’ যায় ন।”
“ইংল্যান্ডে থ্যালাসেমিয়ার জিন আছে এমন ব্যক্তিদের সাধারণত ‘ক্যারিয়ার’ বা ‘থ্যালাসেমিয়া ট্রেইটযুক্ত’ বলা হয় বলে জানান ডা. শিবান পাঞ্চাম । “শুধুমাত্র তখনই একটি শিশুর মাঝারি থেকে গুরুতর থ্যালাসেমিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, যদি বাবা-মা উভয়েই থ্যালাসেমিয়ার জিন বহন করেন।
যদি বাবা-মা উভয়েই থ্যালাসেমিয়ার বাহক হয়ে থাকেন তাহলে ২৫ পার্সেন্ট সম্ভাবনা শিশুর থ্যালাসেমিয়া হবে। ৫০ পার্সেন্ট সম্ভাবনা শিশুর থ্যালাসেমিয়া হবে না কিন্তু জিনটি বহন করবে। ২৫ পার্সেন্ট সম্ভাবনা শিশুর থ্যালাসেমিয়া হবে না এবং জিনটিও বহন করবে না।
“আপনার যদি থ্যালাসেমিয়া থাকে, তবে এটি আপনার সন্তানের মধ্যে যেতে পারে তখনই, যদি আপনার সঙ্গীও থ্যালাসেমিয়ার জিন বহন করে থাকে । যদি না করে, তবে শিশুর থ্যালাসেমিয়া হবে না, তবে সে বাহক হতে পারে- বলেন ডা. পাঞ্চাম।
থ্যালাসেমিয়া রোগ নির্ণয়
আমরা ভাগ্যবান যে, যুক্তরাজ্যে আমাদের স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম রয়েছে । যেসব মহিলাদের গর্ভের সন্তান থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে, তাদের গর্ভাবস্থায় একটি পরীক্ষা করার সুযোগ দেওয়া হয়, যাতে দেখা যায় শিশুটি আক্রান্ত কি না । জন্মের পরপরই নবজাতকের রক্তের দাগ পরীক্ষার (newborn blood spot test) মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়া নির্ণয় করা সম্ভব । এই পরীক্ষায় রক্তে বিভিন্ন ধরণের হিমোগ্লোবিন বিশ্লেষণ করা হয়।
জেনেটিক পরীক্ষা শুধুমাত্র গর্ভকালীন রোগ নির্ণয়ের জন্য ব্যবহার করা হয় এবং প্রায়শই আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার সিদ্ধান্তে সহায়তা করার জন্য করা হয়।
তবে যারা যুক্তরাজ্যের বাইরে জন্ম নিয়েছে এবং নবজাতকের হিল প্রিক পরীক্ষা (heal prick test) করানো হয়নি, তাদের ক্ষেত্রে সাধারণত শিশুটি অসুস্থ হয়ে পড়লে এবং রক্ত পরীক্ষা করালে থ্যালাসেমিয়া ধরা পড়ে।
স্ক্রিনিং ও পরীক্ষা
ইংল্যান্ডে আপনি চাইলে জিপি সার্জারির মাধ্যমে বিনামূল্যে থ্যালাসেমিয়া বহনকারিকে পরীক্ষা করাতে পারেন । “অনেকেই জানেন না যে, তারা থ্যালাসেমিয়া বহন করছেন, কারণ এতে কোনো লক্ষণ দেখা যায় না,” বলেন ডা. পাঞ্চাম । তিনি বলেন, সব জাতিগোষ্ঠীর গর্ভবতী নারীদের থ্যালাসেমিয়া স্ক্রিনিং দেওয়া হয় । “আমি পরামর্শ দেব, যারা থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত বা এটি বহন করে থাকেন বা পরিবারে এর ইতিহাস আছে, তারা জেনেটিক কাউন্সেলিং সম্পর্কে জিপির সঙ্গে আলোচনা করুন– বিশেষ করে সন্তান নেয়ার পরিকল্পনার আগে।”
থ্যালাসেমিয়ার সঙ্গে জীবনযাপন
থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে সাধারণত সারাজীবন চিকিৎসার প্রয়োজন হয় । এনএইচএস প্রত্যেক শিশুর জন্য একটি নির্দিষ্ট চিকিৎসা ও সহায়তা পরিকল্পনার পরামর্শ দেয়, যাতে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা সঠিকভাবে চিকিৎসা দিতে পারেন । এতে থাকবে- তীব্র রক্ত স্বল্পতা চিকিৎসার জন্য যেকোনো রক্ত সঞ্চালনের তথ্যাদি । (বেটা থ্যালাসেমিয়া মেজর দ্বারা আক্রান্ত রোগীদের ২-৪ সপ্তাহ পরপর রক্তের প্রয়োজন হতে পারে)।
পূর্ববর্তী ও চলমান ওষুধ:
* অতিরিক্ত আয়রন দূর করতে আয়রন চেলেশন থেরাপি।
* সংক্রমণ প্রতিরোধে টিকা ও অ্যান্টিবায়োটিক ।
* বিলম্বিত বয়ঃসন্ধি, হাড় ও থাইরয়েড সমস্যা হৃদরোগ ইত্যাদিতে সহায়তা করতে হরমোন থেরাপি ।
রোআন্না বলেন : “প্রতি দুই সপ্তাহে জীবনরক্ষাকারী রক্ত সঞ্চালন প্রয়োজন । কিন্তু ২০১১ সাল থেকে প্রতিটি ট্রান্সফিউশনেই আমি প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করি । এতে আমার দৈনন্দিন জীবন মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয়।”
রক্তদানে জাতিগত পরিচয়ের গুরুত্ব
যাদের নিয়মিত রক্ত সঞ্চালন প্রয়োজন, তাদের জন্য দাতার রক্ত রোগীর রক্তের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিল হওয়া জরুরি। অনেক বিরল রক্তের ধরন কালো, এশীয় এবং সংখ্যালুঘু জাতিগোষ্ঠীতে বেশি দেখা যায়।
ডা. সারা ট্রমপেটার, ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন হাসপাতালের কনসালটেন্ট হেমাটোলজিস্ট বলেন: “আপনি A, B, O ও D গ্রুপের কথা শুনেছেন, কিন্তু ৩০০টির বেশি রক্তের ধরন রয়েছে । রক্ত যত বেশি মিলে যাবে, তত কম প্রতিক্রিয়া হবে এবং ভবিষ্যতে রক্ত খুঁজে পেতে সহজ হবে।”
রোয়ানা বলেন: “২০১৫-২০১৮ সালের মধ্যে আমার সবচেয়ে কঠিন সময়গুলোর একটি চলাকালীন, আমি প্রচণ্ড ক্লান্তিতে ভুগছিলাম, দুর্বিষহ ব্যথার মধ্যে দিন কাটত এবং প্রায় সম্পূর্ণভাবে ঘরবন্দি ছিলাম। হাঁটার জন্য আমার জিমার ফ্রেমের প্রয়োজন হতো, গোসলের মাঝপথে আমাকে বিরতি নিতে হতো এবং খাওয়ার জন্যও সাহায্যের দরকার হতো।”
NHSBT একটি নতুন পরীক্ষা চালু করেছে, যা NHS England-এর অর্থায়নে এবং Blood Transfusion Genomics Consortium (www.bgc.io)-এর মাধ্যমে উন্নয়ন করা হয়েছে । এই পরীক্ষা সিকেল সেল, থ্যালাসেমিয়া এবং বিরল বংশগত অ্যানিমিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য প্রস্তাব করা হচ্ছে। এই পরীক্ষায় ব্যবহার করা হয় জিনোটাইপিং প্রযুক্তি, যা DNA ব্যবহার করে রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করে — এটি এমন একটি উন্নত পদ্ধতি, যা সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে বেশি দেখা যায় এমন বিরল রক্তের গ্রুপগুলো শনাক্ত করতে আরও কার্যকর। এটি একটি দ্রুততর পরীক্ষা, বৃহৎ পরিসরে করা সম্ভব এবং NHSBT এটি এখন দাতাদের পরীক্ষার ক্ষেত্রেও ব্যবহার শুরু করেছে, যাতে এক্সটেন্ডেড ব্লাড গ্রুপসহ আরও বেশি সংখ্যক রক্তদাতা পাওয়া যায়।
রোয়ানা আরো বলেন “আমার তখন এবং এখনো ‘ম্যাচড ব্লাড’-এর প্রয়োজন হয়, কিন্তু ইংল্যান্ডে যথেষ্ট সংখ্যক ব্ল্যাক ও এশিয়ান দাতা নেই যাঁরা এ চাহিদা পূরণ করতে পারেন। একটানা দু’বছরের এক কঠিন সময়ে আমি ২৪৮ ইউনিট রক্ত পেয়েছিলাম,”
এ ব্যাপারে আরও জানতে এবং রক্তদাতা হতে GiveBloodNHS অ্যাপ অথবা www.blood.co.uk এ যান । রক্তের গ্রুপ জিনোটাইপিং সম্পর্কে আরও তথ্যের জন্য NHS Blood and Transplant এর সাথে যোগাযোগ করুন।
ড. ট্রম্পেটার বলেন, “আমাদের দেশে বিভিন্ন স্থানে রক্তদান সেশন রয়েছে, যার মধ্যে ব্রিক্সটনে একটি নতুন ডোনার সেন্টার এবং স্ট্র্যাটফোর্ড, টুটিং, কলিনডেল এবং ওয়েস্ট এন্ডে ডোনার সেন্টার রয়েছে । অনুগ্রহ করে রক্ত দিন, আপনি জীবন বাঁচাবেন এবং উন্নত করবেন।
এনএইচএস-এ দুটি সম্ভাব্য নিরাময় রয়েছে:
স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্ট – সুস্থ দাতার স্টেম সেল ব্যবহার করে রক্ত কোষ পুনঃস্থাপন।
জিন থেরাপি – ২০২৪ সালের আগস্টে অনুমোদিত, যা রোগীর মজ্জাস্থি স্টেম সেলে জিন সম্পাদনার মাধ্যমে কার্যকর হিমোগ্লোবিন তৈরি করে।

রোআন্না বলেন: “আমি জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করতে চাই । আমার পরিবার আমার পাশে আছে । এই চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও আমি ক্লিনিকাল হেলথ সাইকোলজিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পন্ন করেছি এবং থ্যালাসেমিয়া ও অনুরূপ রোগে আক্রান্ত অন্যদের সহায়তা ও প্রতিনিধিত্ব করি।” থ্যালাসেমিয়া সম্পর্কে আরো জানতে ভিজিট করুন NHS–https://www.nhs.uk/conditions/
UK Thalassaemia Society (UKTS)