ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন : বড়লেখা-জুড়ি আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী ৪, জামায়াতের ১
প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ মে ২০২৫
আশফাক জুনেদ: বড়লেখা ও জুড়ি উপজেলা নিয়ে গঠিত মৌলভীবাজার-১ সংসদীয় আসন । দেশে ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের দিনক্ষণ ঠিক না হলেও এই আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীরা মাঠে নেমে পড়েছেন । নিজেদের অস্তিত্ব তুলে ধরতে জনগণের দোরগোড়ায় ছুটছেন দিনরাত । মৌলভীবাজার জেলার গুরুত্বপূর্ণ এই আসনের সাংসদ ছিলেন আওয়ামী লীগের মোঃ শাহাব উদ্দিন । তিনি সরকারের পরিবেশ মন্ত্রী ছিলেন । গত ১৭ বছর ধরে তিনি এই আসনের প্রতিনিধিত্ব করে আসছিলেন। তবে এবার তিনি অনুপস্থিত থাকায় এই আসনটি পুনরায় বিএনপির দখলে যাচ্ছে এমনটাই ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু বিএনপির পাশাপাশি এই আসনে প্রার্থী দিবে জামায়াতে ইসলামী । তাই আগামী নির্বাচনে অনেকটা কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে বিএনপির এমপি প্রার্থীরা। তাই তৃনমুল পর্যায়ে জনপ্রিয়তা আছে- এমন প্রার্থীকেই সংসদ সদস্য প্রার্থী হিসেবে বেছে নেওয়ার কথা বলছেন বিএনপির নেতারা।
মৌলভীবাজার -১ আসনে আসন্ন নির্বাচনে অন্তত ৪ জন প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করবেন বলে শোনা যাচ্ছে । তারা হলেন জেলা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি নাসির উদ্দীন মিঠু, জেলা বিএনপির সাবেক উপদেষ্টা ও কাতার বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শরিফুল ইসলাম সাজু, বড়লেখা পৌরসভার সাবেক মেয়র ফখরুল ইসলাম ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী এবাদুর রহমান চৌধুরীর মেয়ে ব্যারিস্টার জহরত আদিব চৌধুরী । অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর একক প্রার্থী হিসেবে মাঠে কাজ করছেন সাবেক শিবির নেতা ব্যবসায়ী আমিনুল ইসলাম।
সম্ভাব্য এসব প্রার্থী নিয়মিত গণসংযোগ অব্যাহত রেখেছেন। এছাড়া বিভিন্ন জাতীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের মাধ্যমে জনগনের কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করছেন। জনগণের বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে কথা বলছেন। নির্বাচিত হলে সেসব দাবি পূরনের আশ্বাস দিচ্ছেন। তবে বিএনপি থেকে এখনও একক কোনো প্রার্থীর নাম ঘোষণা না করায় তৃনমুল নেতা কর্মীরা বিচ্ছিন্নভাবে প্রার্থীদের সাথে প্রচার প্রচারণায়ও অংশগ্রহণ করছেন । তবে তৃনমুল নেতা কর্মীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, দলে যার অবদান রয়েছে এবং তৃনমূলের সাথে যার সংযোগ বেশি তাকেই যেনো দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়। অন্যথায় বিএনপির এই আসনটি বেহাত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বিএনপির দলীয় সূত্রে জানা যায়, ৫ আগস্টের পর দলটি দুই উপজেলাতে শতাধিক কর্মী সমাবেশ করেছে। প্রতিটি সভায় ধানের শীষের প্রচার ও গণসংযোগ করা হচ্ছে। দীর্ঘ ১৬ বছর পর মামলা হামলা নির্যাতন উপেক্ষা করে এখান বিএনপি নেতাকর্মীরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে।
এ বিষয়ে বিএনপির একাধিক তৃনমুল নেতা কর্মীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, বিগত ১৭ বছরে বড়লেখায় বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর ১৪টি মামলায় ৭ শতাধিক নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছিলো। এসব মামলায় অনেকে জেল খেটেছেন এবং এখনও অনেকে নিয়মিত কোর্টে হাজিরা দিচ্ছেন । সেসব মামলায় নেতাকর্মীদের পাশে থেকে যারা জামিন করিয়েছিলেন এবং আর্থিক সহযোগিতা করেছিলেন এমন নেতাদের মনোনয়ন দেওয়ার দাবি তৃণমুলের। এছাড়া দেশে থেকে যারা নির্যাতন ও হামলা মামলার স্বীকার হয়েছিলেন তাদের যেন বিশেষ বিবেচনা করা হয়- দাবি নেতাকর্মীদের।
প্রতিকূলতার মধ্যে পালিয়ে যাইনি, মাঠেই ছিলাম- নাসির উদ্দিন মিঠু
এদিকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির সংসদ সদস্য প্রার্থী নাসির উদ্দীন আহমদ মিঠুর দিকে অভিযোগের তীর তুলেন বিএনপির একটি অংশের নেতাকর্মীরা। তারা বলেন শুধু নির্বাচন আসলেই মিঠু নেতাকর্মীদের কাছে আসেন। অন্যথায় তাকে খুঁজে পাওয়া যায়না।
তবে তৃনমুল নেতাকর্মীদের এসব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বিএনপির এই নেতা বলেন, আমি ইউনিয়ন পর্যায়ে রাজনীতি করি । দলের নেতাকর্মীদের সাথে সবসময় আমার যোগাযোগ রয়েছে এবং বিগত দিনে সবসময় তাদের পাশে থেকেছি । করোনা থেকে শুরু করে সিলেটের ভয়াবহ বন্যাসহ সকল প্রাকৃতিক দুর্যোগে দলের কর্মী এবং জনগণের কাছাকাছি থেকে সহযোগিতা করেছি। এসব আমার বলার প্রয়োজন নেই, জনগণ সাক্ষী আছে।
আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়ার বিষয়ে মিঠু বলেন, বিগত নির্বাচনে ৭৮ হাজারের বেশি ভোট আমি পেয়েছিলাম। জনগণ আমাকে কি পরিমাণ সাড়া দিয়েছিলো তা আপনারা দেখেছেন। আগামী নির্বাচনেও দল আমাকে মনোনয়ন দিবে এমনটাই বিশ্বাস আমার। কেননা ১৮ সালের নির্বাচনের পর বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার আমাদের উপর নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছিল। এমন প্রতিকূলতার মধ্যেও দেশে থেকে দলীয় কার্যক্রম চালিয়ে গেছি ৷ পালিয়ে যাইনি। এছাড়া গত জুলাই বিপ্লবে আন্দোলনের সহযোগিতার অভিযোগে আমাকে গ্রেফতারও করা হয়েছিলো।
আমি একজন যোগ্য দাবিদার- শরিফুল হক সাজু
অন্যদিকে বিএনপির আরেক মনোনয়ন প্রত্যাশী শরিফুল হক সাজুকে নিয়েও কানাঘুষা রয়েছে দলের মধ্যে। বয়সে এখনও তরুণ সাজুকে মাঠে কাজ করা পরামর্শ দিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির কিছু সিনিয়র নেতা। এছাড়া সর্বস্তরের জনগন ও নেতাকর্মীদের সাথে যোগাযোগ বাড়ানো এবং তা অব্যাহত রাখারও পরামর্শ দিয়েছেন কেউ কেউ। তবে নির্বাচনে যাকেই মনোনয়ন দেওয়া হবে তার পক্ষেই কাজ করবেন সাজু। বিগত দিনে দলে তার অবদান রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ আমি একজন যোগ্য দাবিদার।
দল মনোনয়ন দিলে ইনশাআল্লাহ নির্বাচন করবো : ফখরুল ইসলাম
মনোনয়ন নিয়ে আরেক প্রার্থী বড়লেখা পৌরসভার সাবেক মেয়র ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘ আসন্ন নির্বাচনে আমিও একজন মনোনয়ন প্রত্যাশী। দল মনোনয়ন দিলে ইনশাআল্লাহ নির্বাচন করবো। আমার প্রস্তুতি রয়েছে। ‘
যা বললেন মিফতা সিদ্দিকী
এ বিষয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির সহসাংগঠনিক সম্পাদক (সিলেট বিভাগ) মিফতা সিদ্দিকী বলেন, ‘ আগামী নির্বাচন অনেকটা চ্যালেঞ্জিং নির্বাচন হতে যাচ্ছে। গতানুগতিক ধারার যে নির্বাচনগুলো অনুষ্ঠিত হয় সেভাবে এই নির্বাচন হবে না। তাই বিএনপির পক্ষ থেকে তৃনমুলে জনপ্রিয় এবং জনগণের পছন্দের ব্যক্তিকেই মনোনয়ন দেওয়া হবে। বিগত ১৭ বছরে যারা দলকে সার্ভিস দিয়েছে, দলের জন্য কাজ করেছে এবং হামলা মামলার শিকার হয়েছেন এমন প্রার্থীই অগ্রাধিকার তালিকায় থাকবেন। বিগত নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেছেন আর সরাসরি এবারও মনোনয়ন পেয়ে যাবেন এমনটা ভাবার দরকার নেই। দলের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে যার ভুমিকা ছিলো তাঁকেই দল মনোনয়ন দিবে।
প্রথমবারের মতো জামায়াতের প্রার্থী আমিনুল ইসলাম
এদিকে প্রথম বারের মতো এই আসনে প্রার্থী দিচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। সাবেক শিবির নেতা ব্যবসায়ী আমিনুল ইসলাম এই আসনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করবেন। এ লক্ষ্যে এখন থেকেই তিনি মাঠে ময়দানে কাজ শুরু করেছেন। তিনি উপজেলার প্রত্যন্ত বাজার ও গ্রাম পর্যায়ে গণসংযোগ অব্যাহত রেখেছেন। গত রমজানে বিভিন্ন ইফতার মাহফিলে অংশগ্রহণ ও সামাজিক অনুষ্ঠান অংশগ্রহণ করেছেন।
এ বিষয়ে আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘ দুর্নীতিমুক্ত ও বৈষম্যহীন সমাজ গড়তে চাই। বিগত দিনে যারাই সাংসদ ছিলেন তারা নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় উন্নয়ন করেছেন। অর্থাৎ যারা তাদের ভোট দিয়েছেন সেখানেই তারা উন্নয়ন করেছেন। আমি যদি নির্বাচিত হই তাহলে সমানভাবে উন্নয়ন করার চেষ্টা করবো । বড়লেখা ও জুড়িতে পর্যটন শিল্পের বিকাশে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবো।
শেষ পর্যন্ত বিএনপির সাথে জোট বাঁধলে আসনটি ছেড়ে দিতে হবে কী না এমন প্রশ্নে আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘ জোটবদ্ধ হলেও কিছু আসন সবসময় অপেন থাকে। এই আসনটিও অপেন থাকবে। এখানে আমি নির্বাচন করবো ইনশাআল্লাহ। সে লক্ষ্যে আমি কাজ করে যাচ্ছি।
তবে গুরুত্বপূর্ণ এই আসনে জামায়াতের প্রার্থী হিসেবে আমিনুল ইসলাম নয় বরং বড়লেখা উপজেলা জামায়াতের আমীর এমাদুল ইসলামই যোগ্য প্রার্থী ছিলেন বলে মনে করছেন কেউ কেউ। দলের ভিতরে এ নিয়ে কানাঘুষা চললেও দলের বাইরে মুখ খুলছেন না কেউ। তারা বলছেন দুটি উপজেলা নির্বাচনের অভিজ্ঞতাসহ এলাকায় একচ্ছত্র জনপ্রিয়তা রয়েছে এমদাদুল ইসলামের । তাকে মনোনয়ন দিলে ভোটের মাঠে নাসির উদ্দিন মিঠুর সাথে টক্কর দেওয়া সহজ হতো ৷
প্রসঙ্গত, বড়লেখা উপজেলার ১০টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা এবং জুড়ী উপজেলার ৬টি ইউনিয়ন নিয়ে মৌলভীবাজার ১ আসন গঠিত। ১৯৮৪ সালে মৌলভীবাজার-১ নির্বাচনী এলাকা গঠিত হয় । দেশের সর্ববৃহৎ জলপ্রপাত মাধবকুণ্ড ও সারি সারি চা বাগান আর পাহাড় টিলা বেষ্টিত এই আসনটি জেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি আসন। স্বাধীনতার পর বিগত ১২ টি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৮ বার, বিএনপি ২ বার ও জাতীয় পার্টি ২ বার করে বিজয়ী হয়েছে । কিন্তু গত ৫ আগষ্টের পর বদলে গেছে এই আসনের চিত্র। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা পলাতক থাকায় এখানে এখন আধিপত্য বিস্তার করছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। তাই আগামী নির্বাচনে মুলত মুল লড়াই হবে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে। তবে ক্ষমতাচ্যূত আওয়ামী লীগের অন্যতম দোষর জাতীয় পার্টির এক নেতা আহমেদ রিয়াজও এই আসনে নির্বাচন করার সম্ভাবনা রয়েছে। সংসদীয় এই আসনে মোট ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ১৫ হাজার ৬৩৯ জন । পুরুষ ভোটার: ১ লাখ ৬০ হাজার ১৬১ ।নারী ভোটার: ১ লাখ ৫৫ হাজার ৪৭৭। হিজড়া ভোটার: ১