নির্বাচনী রাজনীতি ও নীরব বিপ্লব : বিএনপি এবং ভারতের ছায়া-সংকট!
প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ মে ২০২৫
শামসুল তালুকদার
‘আমরা শত্রু খুঁজছি’— কথাটি এখন আর কেবল ব্যঙ্গাত্মক বাক্য নয়, বরং বাংলাদেশের রাজনৈতিক অন্তর্জালের একটি বাস্তব প্রতিফলন । যদি একটি রাজনৈতিক দল নিজের প্রকৃত মিত্র ও প্রতিপক্ষকে চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয়, তবে তা কেবল কৌশলগত ভুল নয়—বরং আদর্শগত বিপর্যয়ের দিকেও ইঙ্গিত করে। এ বাস্তবতায় বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিকে ঘিরে ভারতের ভূরাজনৈতিক প্রভাব এবং দলের অভ্যন্তরীণ নেতৃত্ব কাঠামো নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘ভারত’ দীর্ঘদিন ধরে এক রহস্যময় উপস্থিতি—প্রয়োজনে মিত্র, বিরোধে প্রতিপক্ষ। এই দ্বৈত অবস্থান রাজনীতিতে তৈরি করেছে এক ‘ছায়াশত্রু’ ভাবনা, যা কখনো গোপনে, কখনো প্রকাশ্যে দলসমূহের নীতি ও নেতৃত্ব নির্বাচনে প্রভাব ফেলছে।
এই প্রেক্ষাপটে দুই ভিন্নধর্মী নেতার অবস্থান চোখে পড়ে—একজন কারাবন্দি হয়ে নীরব, অন্যজন ভারতের আশ্রয়ে থেকে সরাসরি দলের প্রথমসারির নেতৃত্বে প্রত্যাবর্তন করেছেন। হ্যা বলছিলাম জনাব লুতফুজ্জামান বাবর ও অন্যজন জনাব সালাহ্উদ্দিন আহমেদের কথা।
২০০১-২০০৬ মেয়াদে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুতফুজ্জামান বাবর ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় অভিযুক্ত হয়ে দীর্ঘ ১৭ বছর কারাভোগ করেছেন। যদিও আদালত তার বিরুদ্ধে দণ্ড দিয়েছেন, রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করেন, এই মামলা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত এবং আন্তর্জাতিক চাপ—বিশেষত ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের অবস্থান এখানে অনস্বীকার্য ভূমিকা রেখেছে।
২০২৪ সালে মুক্তি পাওয়ার পরও বাবর একেবারে নীরব। রাজনীতিতে তার অনুপস্থিতি ও নিশ্চুপতা প্রশ্ন তৈরি করে: তিনি কি ইচ্ছাকৃতভাবে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন?
না কি রাজনৈতিক সমঝোতার শর্তে তাকে নীরব থাকতে বলা হয়েছে? যিনি একসময় ভারতের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে ছিলেন, তার এই নিস্পৃহতা কি নিছক কাকতাল?
যদি বিএনপি সত্যিই জাতীয় স্বার্থে ভারতের আধিপত্যবাদী প্রবণতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে চায়, তবে বাবরের মতো একজন প্রতীকী নেতার প্রকাশ্য উপস্থিতি ও ভূমিকা প্রত্যাশিত ছিল।
সালাহউদ্দিন আহমদ: ভারতীয় আশ্রয়ে থেকে নেতৃত্বে প্রত্যাবর্তন!
২০১৫ সালে হঠাৎ নিখোঁজ হন বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ। পরবর্তীতে জানা যায়, তিনি ভারতের মেঘালয় রাজ্যে অবস্থান করছেন এবং সেখানে ভারত সরকারের সৌজন্যে নিরাপত্তা ও আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি থেকে বহুদিন বিচ্ছিন্ন থাকার পর তাকে আবারো দলে নেতৃত্বের আসনে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এই পদক্ষেপ বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করে:
বিএনপি কি কৌশলগত কারণে ভারতের প্রতি নমনীয় হতে চাচ্ছে? আদর্শগত অবস্থানের বদলে সুবিধাবাদকে কি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে? যিনি ভারতের আশ্রয়ে ছিলেন, তিনি দলের ভবিষ্যতের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠবেন, এটা কি দলের মৌলিক নীতির পরিবর্তনের ইঙ্গিত?
এদিকে জাতীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বিষয়ে বরাবরই এক তীক্ষ্ণ ও জাতীয়তাবাদী কণ্ঠ হিসেবে পরিচিত। তিনি ভারতের আধিপত্যবাদী প্রবণতার বিরুদ্ধে তথ্যসমৃদ্ধ ও যুক্তিনির্ভর বক্তব্য প্রদান করে থাকেন। অথচ বিএনপির একটি অংশ তার নিয়োগ ও কার্যক্রম নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছে। এ পরিস্থিতি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করে: বিএনপির ভারতবিরোধী চেতনা কি সত্যিই আদর্শভিত্তিক, না কি কেবল প্রচারের বুলি।
আমরা দেখতে পাচ্ছি, যারা অতীতে ভারতের প্রভাবে কারাবরণ করেছেন, তারা আজ নীরব; আর যারা ভারতের ছায়ায় ছিলেন, তারা মঞ্চের কেন্দ্রে। নেতৃত্ব নির্বাচনে এই বৈপরীত্য কেবল ব্যক্তি নয়, গোটা দলীয় আদর্শের প্রশ্নে দ্বিধা ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে।
রাজনৈতিক দল যদি অভিজ্ঞ, পরীক্ষিত, এবং দেশপ্রেমিক নেতাদের মূল্যায়ন না করে; বরং আন্তর্জাতিক শক্তির ছায়ায় সুবিধাবাদীদের অগ্রাধিকার দেয়—তবে সেই দল জনগণের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হবে, এবং জাতীয় স্বার্থ রক্ষার প্রশ্নেও দুর্বল হয়ে পড়বে।
বিএনপির সামনে সুযোগ: পুনর্বিন্যাস, পুনর্জাগরণের – বাংলাদেশের গণতন্ত্র আজ নানামুখী চাপে বিদ্ধ। এই প্রেক্ষাপটে বিএনপির জন্য এখন সময়—নেতৃত্ব পুনর্বিন্যাসের, আদর্শে ফিরে যাওয়ার, এবং একটি সাহসী জাতীয়তাবাদী অবস্থান গ্রহণের। ব্যক্তিপূজা নয়, প্রয়োজন দেশপ্রেম, নৈতিকতা, ও আদর্শনিষ্ঠ রাজনীতির।
রাজনীতি যদি সত্যিই জনগণের জন্য হয়, তবে দলগুলোকে মুখোশ নয়, মুখ তুলে কথা বলার সাহস দেখাতেই হবে।
শামসুল তালুকদার : সাংবাদিক, টিভি উপস্থাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। সদস্য, লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাব ।