লজ্জা ঝেড়ে ফেলে গর্ভাবস্থা সম্পর্কে জানুন, সুস্থ জীবনযাপন করুন
প্রকাশিত হয়েছে : ১২ জুন ২০২৫
গর্ভাবস্থায় নিজের স্বাস্থ্য বা শিশুর বিকাশ নিয়ে উদ্বেগ বা প্রশ্ন থাকা স্বাভাবিক । এমনকি যেসব বিষয় লজ্জাজনক বা কঠিন মনে হতে পারে, সেগুলো নিয়েও খোলামেলা কথা বলা উচিত চিকিৎসাকর্মীদের সঙ্গে । কারণ এতে মা ও শিশুর সেরা যত্ন নিশ্চিত হয়, বলছেন মিডওয়াইফ ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ওয়েন্ডি ওলায়িওওলা এবং হুদা মোহাম্মদ।
ভয় পাওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু কথা বলাটাই উপকারী
যদি আপনি পরিবার শুরু করার চিন্তায় দুশ্চিন্তায় ভোগেন, জেনে রাখুন আপনি একা নন। আপনার শিশুকে নিরাপদ রাখা বা শিশুর আগমনের পর কীভাবে সামলাবেন—এসব নিয়ে চিন্তা হওয়া স্বাভাবিক।
এ ব্যাপারে এনএইচএস ইংল্যান্ডের মাতৃত্ব ও ইকুয়ালিটি বিষয়ের জাতীয় নেতা ওয়েন্ডি বলেন, আপনার যা অনুভব হচ্ছে, তা একেবারেই স্বাভাবিক । তবে এসব নিয়ে খোলামেলা কথা বলাটা অনেক সাহায্য করতে পারে।
মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব
“গর্ভাবস্থার আগে, সময়কালে এবং পরে—এই পুরো পেরিনাটাল সময়ে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। একে অপরকে সমর্থন দেওয়া আমাদের মনের জন্য উপকারী, আর এর শুরুটা হয় আমাদের অনুভূতির কথা শেয়ার করা থেকে।
যদি বন্ধুবান্ধব বা পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করেন, স্থানীয় অ্যান্টেনাটাল গ্রুপে যোগ দিতে পারেন। এতে স্থানীয় সেবাসমূহ সম্পর্কেও জানা যায়।
অনেক নারী অনলাইন সেবা বা মানসিক স্বাস্থ্য অ্যাপস ব্যবহার করে নেতিবাচক চিন্তা ও অনুভূতি সামাল দিতে পারেন। কিছু অ্যাপ পিতাদের জন্যও সহায়ক।
এই ধরনের অ্যাপস পাওয়া যায় এনএইচএস ওয়েবসাইটে, ম্যাটারনাল মেন্টাল হেলথ অ্যালায়েন্স (MMHA), মাইন্ড-এর মতো মানসিক স্বাস্থ্য চ্যারিটি ও টমিস বা প্যান্ডাসের মতো মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্য চ্যারিটিতে।
ফ্রি এনএইচএস টকিং থেরাপি
এনএইচএস টকিং থেরাপি বিনামূল্যে পরামর্শ ও থেরাপি সেবা দেয় বিষন্নতা, উদ্বেগ, বা বাধ্যতামূলক চিন্তার মতো সমস্যায়। বিস্তারিত জানতে ভিজিট করুন: www.nhs.uk/talk
এনএইচএস-এ গর্ভাবস্থায় জটিল বা তীব্র মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার জন্য বিশেষ পরিষেবা রয়েছে । যেমন মায়েদের জন্য কমিউনিটি সেবা এবং মাদার ও বেবি ইউনিট, যেখানে মায়েরা হাসপাতালে থাকাকালীন শিশুর সঙ্গেও থাকতে পারেন।
ওয়েন্ডি আরো বলেন, মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে কথা বলা এড়িয়ে যাওয়া উচিত নয় । “আপনার এবং আপনার পরিবারের জন্য শারীরিক ও মানসিক—উভয় স্বাস্থ্যই গুরুত্বপূর্ণ । যদি গর্ভাবস্থার আগে, সময়কালে বা পরে সাহায্য প্রয়োজন হয়, মিডওয়াইফ, জিপি বা হেলথ ভিজিটরকে জানান । যদি আপনি আগে থেকেই মানসিক চিকিৎসা নিতে থাকেন, তাহলে আপনার মেন্টাল হেলথ টিমকেও জানানো উচিত।
আপনি বা আপনার শিশুর ক্ষতির আশঙ্কা থাকলে, ৯৯৯ নম্বরে ফোন করুন। শারীরিক সুস্থতার মতোই মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা জরুরি।
লজ্জার কোনো কারণ নেই
একটি স্পর্শকাতর ট্যাবু’র (লজ্জার) বিষয় হচ্ছে মহিলাদের যৌনাঙ্গ বিকৃতি (এফজিএম)।এটি ইচ্ছাকৃতভাবে যৌনাঙ্গ কেটে বা ক্ষতি করে করা হয়, যার পেছনে কোনো চিকিৎসাজনিত কারণ থাকে না। এটি যুক্তরাজ্যে অবৈধ।
বিশ্বজুড়ে ২৩ কোটির বেশি মেয়ে ও নারী এটির শিকার । একে অনেক সময় ‘সুন্নাহ’, ‘গুদনীন’, ‘তাহুর’, ‘মেগরেজ’, ‘খিতান’ ইত্যাদি নামেও ডাকা হয়। এটি অত্যন্ত বেদনাদায়ক এবং দীর্ঘমেয়াদী শারীরিক ও মানসিক সমস্যা- যেমন যৌন স্বাস্থ্যে জটিলতা, বন্ধ্যাত্ব, গর্ভাবস্থা ও প্রসব জটিলতা হতে পারে ।
হুদা মোহাম্মদ এমবিই আরো বলেন, এফজিএম নারী ও শিশুর জন্য মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। এনএইচএস ট্রাস্টের বিশেষজ্ঞ মিডওয়াইফ হুইটিংটন হেলথ বলেন, যদি এটি আপনার সঙ্গে ঘটে থাকে, লজ্জার কিছু নেই। দয়া করে আমাদেরকে বলুন যেন আমরা আপনাকে সাহায্য করতে পারি। এফজিএম ক্লিনিকে নানা ধরনের সেবা দেওয়া হয়—পরামর্শ, যৌন স্বাস্থ্যসেবা, এফজিএম পুনরুদ্ধার এবং গর্ভাবস্থা ও প্রসবকালীন যত্ন। এফজিএম-এর শিকার নারীদের জন্য পৃথক কেয়ার প্ল্যান প্রয়োজন হতে পারে, যেন তারা আরামদায়ক বোধ করেন।
হুদা মোহাম্মদ আরো বলেন, যৌন নির্যাতন বা অতীতে হওয়া ট্রমাটিক গর্ভাবস্থার অভিজ্ঞতাও প্রভাব ফেলতে পারে। এ ধরনের অভিজ্ঞতার পর ভয় এবং উদ্বেগ হওয়া স্বাভাবিক । এতে স্বাস্থ্য ও আত্মবিশ্বাস—দুটোই প্রভাবিত হতে পারে, বিশেষত পরীক্ষার সময় যা পূর্বের স্মৃতি ফিরিয়ে আনতে পারে।
যদি কথা বলাটা বিব্রতকর হয় তাহলে গোপন অনলাইন হেল্পলাইন ও সেবা ব্যবহার করা যায়, যেমন Maternal Mental Health Alliance ওয়েবসাইট রয়েছে । তাছাড়া Mental health problems and pregnancy লিঙ্কটি ভিজিট করে এনএইচএস ওয়েবসাইটে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা এবং গর্ভাবস্থা সম্পর্কে আরো তথ্য জানা যাবে।
গর্ভাবস্থায় টিকা কেন জরুরি
ভুল তথ্য ও সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাবে টিকা নেওয়ার সিদ্ধান্ত কঠিন হতে পারে।
হুদা মোহাম্মদ আরো বলেন “পরিবারের যেকোনো সদস্য, অনলাইন সোর্স বা এনএইচএস-এ পড়া তথ্য—সবকিছু নিয়ে প্রশ্ন করতেই পারেন।
“প্রশ্ন করা ভুল নয়, না জানাটাই ভুল। আপনার প্রশ্ন থাকলে জিজ্ঞেস করুন।
এখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য:”
ওয়েন্ডি বলেন, কালো ও সাউথ এশিয়ান নারীরা গর্ভাবস্থায় জটিলতার ঝুঁকিতে থাকেন, যার ফলে শিশু কম ওজন বা আগেভাগে জন্মাতে পারে। এই কারণে নবজাতকেরা গুরুতর অসুস্থতায় বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়। এনএইচএস গর্ভবতী নারীদের কিছু নির্দিষ্ট টিকা দেওয়ার সুপারিশ করে, কারণ এর মাধ্যমে মা ও শিশু উভয়েই সুরক্ষা পায়।
প্রস্তাবিত টিকা
RSV টিকা (Respiratory Syncytial Virus).
পারটুসিস (Whooping Cough) টিকা
ফ্লু টিকা (শীতকালে)। COVID-19 টিকা (যারা ঝুঁকিতে আছেন, শুধুমাত্র শীত ও বসন্তকালে)
আপনার শিশুর ঝুঁকি কমানো
ছাত্র মিডওয়াইফ ইউসরা ওসমান এই ঝুঁকিগুলি খুব ভালো করেই জানেন। তার প্রথম সন্তান মাত্র তিন মাস বয়সে ব্রঙ্কিওলাইটিসে আক্রান্ত হয়েছিল।
রেসপিরেটরি সিনসাইটিয়াল ভাইরাস (RSV) হলো শিশুদের ব্রঙ্কিওলাইটিসের প্রধান কারণ।এটি একটি গুরুতর ফুসফুসের সংক্রমণ, যা শিশুদের খাওয়া ও শ্বাস নেওয়াকে কষ্টকর করে তোলে।
ইউসরা একদিন সকালে ছেলেকে ঘুম থেকে তুলতে গিয়ে দেখেন তার জ্বর এবং সে হাঁপাচ্ছে। তিনি বলেন, আমি তখন স্বাস্থ্যকর্মী ছিলাম না, কিন্তু একজন মা হিসেবে আমার প্রবৃত্তি কাজ করছিল,” তিনি মনে করেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি NHS 111-এ ফোন করে পরামর্শ নেন এবং তখনই তাকে বলা হয় ৯৯৯-এ ফোন করে অ্যাম্বুলেন্স ডাকার জন্য।
“এরপর সবকিছু ধোঁয়াশা হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু আমি মনে করি ওর বুকটা ভেতরে-বাইরে দুলছিল এবং ও খুব কষ্ট করে শ্বাস নিচ্ছিল।”
হাসপাতালের কর্মীরা জানান, তার ছেলের অক্সিজেন লেভেল ছিল বিপজ্জনকভাবে নিচে। “এটা এমন একটা জিনিস, যা একজন মা হিসেবে শুনতে চাই না। ও কাঁদছিল, আমরা তাকে অক্সিজেন মাস্ক পরানোর চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু সে মাস্কটা খুলে ফেলছিল, স্পর্শ সহ্য করতে পারছিল না।আমরা তিন থেকে চার রাত হাসপাতালেই ছিলাম। ওকে অক্সিজেন ও খাওয়ানোর নল দিয়ে রাখতে হয়েছিল।”
ইউসরা বুকের দুধ খাওয়াচ্ছিলেন, কিন্তু তার ছেলে এতটাই অসুস্থ ছিল যে তিনি আর চালিয়ে যেতে পারেননি। তিনি বলেন, আমরা যেন আমাদের শারীরিক সংযোগ হারিয়ে ফেলেছিলাম, আমাদের বন্ধনটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, আর আমি সম্পূর্ণ অসহায় বোধ করছিলাম।”
হুদা মোহাম্মদ ব্যাখ্যা করেন: “ইউসরার ছেলের মতো প্রতি বছর যুক্তরাজ্যে ৫ বছর পর্যন্ত বয়সের প্রায় ৩০ হাজার শিশু আরএসভি’র কারণে হাসপাতালে ভর্তি হয়।
এটি সাধারণত: কাশি বা ঠান্ডাজনিত উপসর্গ তৈরি করে, কিন্তু এটি গুরুতর ফুসফুসের সংক্রমণেও পরিণত হতে পারে। শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এখনো গড়ে উঠছে বলে তাদের ঝুঁকি বেশি থাকে। গুরুতর সংক্রমণ থেকে পরবর্তী জীবনে শ্বাসকষ্ট বা এমনকি মৃত্যুও হতে পারে।
“আরএসভি টিকা প্রথম ছয় মাসে প্রায় ৭০শতাংশ পর্যন্ত ঝুঁকি কমিয়ে দেয়।
আপনি যদি গর্ভাবস্থার ২৮ সপ্তাহে বা তার বেশি সময়ে থাকেন এবং RSV টিকার প্রস্তাব না পেয়ে থাকেন, তাহলে দয়া করে আপনার জিপি বা মাতৃত্বকালীন সেবাদানকারীর সঙ্গে যোগাযোগ করুন।”
ইউসরার ছেলে ভালোভাবে সুস্থ হয়ে উঠেছে। এখন সে খেলাধুলা ভালোবাসে এবং তার একজন বড় ভাইও হয়েছে, তবে তার অ্যাজমা রয়ে গেছে, যা সে অসুস্থ হলেই বাড়ে । তিনি বলেন, আমি ওর এত তাড়াতাড়ি সুস্থ হওয়াতে ভীষণ কৃতজ্ঞ, কিন্তু সেই স্মৃতি আজও ভোলার নয় ।
“ফিরে তাকালে মনে হয়, এটা একজন মায়ের সবচেয়ে ভয়ানক দুঃস্বপ্ন। দেড় বছর পরে আমার আরেক ছেলে হয় এবং তখন যদি আরএসভি টিকা পাওয়া যেত, আমি অবশ্যই নিতাম।”
বিশ্বাসযোগ্য তথ্য
পার্টুসিস (হুপিং কাশি) একটি মারাত্মক ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ যা দীর্ঘ সময় ধরে কাশি ও শ্বাস নিতে অসুবিধা সৃষ্টি করে। এটি ‘হুপিং কাশি’ নামেও পরিচিত, কারণ কাশির সময় অনেকে একটি বিশেষ “হুপ” শব্দ করে, যদিও শিশুরা সবসময় এই শব্দ করে না।
ওয়েন্ডি আরো বলেন, গর্ভাবস্থায় পার্টুসিস টিকা নবজাতকদের সুরক্ষিত করে যতক্ষণ না তারা ৮, ১২ ও ১৬ সপ্তাহে নিজস্ব টিকা নিতে পারে। সাধারণত এই টিকাটি মাঝামাঝি গর্ভাবস্থায় স্ক্যানের সময় (প্রায় ২০ সপ্তাহে) দেওয়া হয়, তবে ১৬ সপ্তাহ থেকেও দেওয়া যেতে পারে। আপনি যদি ২০ সপ্তাহের বেশি গর্ভবতী হয়ে থাকেন এবং এখনো টিকা না পেয়ে থাকেন, তাহলে অবশ্যই অনুরোধ জানান।
এই বসন্তে বেশিরভাগ গর্ভবতী নারীদের COVID-19 টিকা নেওয়ার প্রয়োজন নেই। তবে যাদের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল, তারা গর্ভাবস্থার যেকোনো সময় টিকা নিতে পারবেন।
আপনি টিকা পাওয়ার যোগ্য কি না তা জিপি বা মাতৃত্বকালীন সেবাদানকারীর সঙ্গে আলোচনা করতে পারেন এবং ১৭ জুনের আগেই www.nhs.uk/covidvaccine ওয়েবসাইটে বুক করতে পারেন অথবা কোনো ওয়াক-ইন টিকা কেন্দ্রে যেতে পারেন।
হুদা মোহাম্মদ আরো বলেন, টিকা নেওয়া মানেই আপনি সংক্রমণ একেবারে এড়াতে পারবেন না। “তবে এটি মা ও শিশুকে গুরুতর ও প্রাণঘাতী জটিলতা থেকে রক্ষা করার সবচেয়ে কার্যকর উপায়।”
ইউসরা বলেন: “এটা একজন মায়ের দায়িত্ব—আমাদের কাজই হলো সন্তানদের রক্ষা করা, আর আরএসভি’র মতো টিকা সেই সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সাহায্য করে।”
এ ব্যাপারে আরো জানতে ভিজিট করুন
গর্ভাবস্থায় সুস্থ থাকার পরামর্শের জন্য www.nhs.uk/pregnancy
এনএইচএস-এর সুপারিশকৃত টিকা সম্পর্কিত হালনাগাদ তথ্য পেতে www.nhs.uk/vaccinations
NHS FGM ক্লিনিকগুলো দেশব্যাপী বিনামূল্যে গোপনীয় সহায়তা প্রদান করে
গর্ভাবস্থা ও শিশু সম্পর্কিত চ্যারিটি সংস্থা টমিজ বিনামূল্যে মিডওয়াইফ হেল্পলাইন দেয় 0800 0147 800 নম্বরে, এবং কালো ও মিশ্র জাতিগোষ্ঠীর নারীদের জন্য পৃথক হেল্পলাইনও রয়েছে।
PANDAS চ্যারিটি সংস্থা গর্ভকালীন ও প্রসবোত্তর মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় সহমর্মী সহায়তা প্রদান করে।