পাউণ্ডের বিপরীতে টাকার সর্বোচ্চ রেইট দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে
প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ জুন ২০২৫
শের মাহমুদ
বর্তমান আন্তর্জাতিক মুদ্রাবাজারে ব্রিটিশ পাউন্ড (জিবিপি)-এর শক্তিশালী অবস্থান নতুন অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরি করেছে প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য। যুক্তরাজ্য থেকে বাংলাদেশে অর্থ পাঠানো এখন আরও লাভজনক হয়েছে, কারণ বর্তমানে ১ পাউন্ড সমান প্রায় ১৬৯.১৩ টাকা। অর্থাৎ, এই হার অনুযায়ী প্রতি পাউন্ডের বিনিময়ে যে টাকার পরিমাণ পাওয়া যাচ্ছে, তা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি।
এই অবস্থানের সরাসরি সুবিধা পাচ্ছেন প্রবাসীরা। একজন প্রবাসী এখন যদি ৫০০ পাউণ্ড পাঠান, সেটি বাংলাদেশে রূপান্তরিত হচ্ছে প্রায় ৮৪,৫৬৫ টাকায় । এক বছর আগেও এই পরিমাণ পাউন্ড পাঠালে এত টাকা পাওয়া যেত না। এর ফলে প্রবাসীদের পরিবারগুলো নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যয়, চিকিৎসা, শিক্ষা এবং আবাসন খাতে আরও স্বাচ্ছন্দ্যে অর্থ ব্যয় করতে পারছে। একই সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতেও এটি ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে।
এছাড়া, বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও এই রেট অত্যন্ত অনুকূল। জমি ক্রয়, গৃহনির্মাণ কিংবা ক্ষুদ্র ব্যবসায় বিনিয়োগের জন্য এখনই সময় । দেশের ব্যাংকগুলোতে এখনো সুদের হার তুলনামূলক বেশি, যা প্রবাসীদের জন্য সঞ্চয় বা আমানতের মাধ্যমে ভালো রিটার্ন নিশ্চিত করতে পারে । অর্থাৎ পাউন্ডের শক্তি কাজে লাগিয়ে প্রবাসীরা শুধু পরিবার নয়, নিজের ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক নিরাপত্তাও গড়ে তুলতে পারেন।
তবে মনে রাখতে হবে, মুদ্রাবাজার অত্যন্ত অস্থির ও বিশ্ব পরিস্থিতির ওপর নির্ভরশীল । পাউন্ডের শক্তিশালী অবস্থান অনেকাংশে ডলারের দুর্বলতার কারণে তৈরি হয়েছে । ভবিষ্যতে যদি বিশ্ব অর্থনীতি নতুন কোনো চাপের মধ্যে পড়ে, বা যুক্তরাজ্যের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি দুর্বল হয়, তবে এই উচ্চ বিনিময় হার ধরে রাখা কঠিন হতে পারে। তাই এই সুযোগকে সাময়িক না ভেবে কৌশলগতভাবে কাজে লাগানোই হবে প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, অনেকেই মনে করেন টাকার রেট বেড়ে গেলে বাংলাদেশের অর্থনীতি দুর্বল হচ্ছে—এমন ধারণা ভুল । টাকার রেট আন্তর্জাতিক বাজারে অন্যান্য মুদ্রার সাথে ডলারের শক্তি ও দুর্বলতার ওপর নির্ভর করে । উদাহরণস্বরূপ, পাউন্ড যদি ডলারের তুলনায় শক্তিশালী হয়, তবে বাংলাদেশে পাউন্ডের দাম বেড়ে যাবে—যেটি টাকার দুর্বলতা নয়, বরং ডলারের দুর্বলতা । একইভাবে, বিশ্বে যুদ্ধ চললে ডলার শক্তিশালী হয়, কারণ তখন ডলারে বিনিয়োগ নিরাপদ মনে করা হয় । আবার যুদ্ধ বা অনিশ্চয়তা কেটে গেলে ডলার দুর্বল হয়ে পড়ে, যা অন্যান্য মুদ্রার মান বাড়িয়ে দেয় । ফলে, টাকার রেটের ওঠানামাকে সরাসরি বাংলাদেশের অর্থনীতির মানদণ্ড হিসেবে ধরা উচিত নয়।
বর্তমানে আন্তর্জাতিক মুদ্রাবাজারে মার্কিন ডলার ধারাবাহিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে । ইউরো, পাউন্ড, ইয়েন, ইউয়ানসহ প্রায় সব প্রধান মুদ্রার বিপরীতে ডলারের মান কমে গেছে। ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে ডলার সূচক প্রায় ১০% পর্যন্ত নিচে নেমেছে, যা গত তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এই প্রবণতা শুধুমাত্র একটি দেশের বিপরীতে নয়—বরং বিশ্বের সকল দেশে বিস্তৃত।
আমরা দেখেছি, সম্প্রতি ইরান ইসরাইল যুদ্ধ বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে ডলার দুর্বল হয়ে পড়ে। আর ডলার দুর্বল হওয়ার সাথে সাথে পাউণ্ড শক্তিশালী হয়ে ওঠে । ফলে বাংলাদেশে টাকার রেইট বেড়ে দাঁড়ায় ১ পাউণ্ড সমান ১৬৯ টাকারও বেশি । এটি চলতি বছরে সর্বোচ্চ রেইট । বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য এটা ভালো। এখন বহির্বিশ্বে বসবাসরত প্রবাসীরা দেশে বেশি করে রেমিটেন্স প্রেরণ করবেন । এতে করে বাংলাদেশের অর্থনীতি আরো শক্তিশালী হবে।
সবশেষে বলা যায়, শক্তিশালী পাউন্ড এই মুহূর্তে প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য একটি বাস্তব ও গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ তৈরি করেছে। রেমিটেন্স, সঞ্চয় এবং বিনিয়োগ—সব ক্ষেত্রেই একটি কার্যকর পরিকল্পনার মাধ্যমে এই সময়কে কাজে লাগানো সম্ভব । দূরদর্শী সিদ্ধান্তই পারে এই লাভজনক পরিস্থিতিকে দীর্ঘমেয়াদি সফলতায় পরিণত করতে ।
শের মাহমুদ : সিইও, বিএ এক্সচেঞ্জ ইউকে ও আন্তর্জাতিক রেমিটেন্স বিশ্লেষক।