সংসদ নির্বাচন নয়, ক্ষমতার মেয়াদ বৃদ্ধির উৎসব!
প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ ডিসেম্বর ২০২৩
আব্দুস সহিদ :: বাংলাদেশের সরকার ব্যবস্থা মূলত “ওয়েস্টমিনিস্টার” পদ্ধতির সরকার বা গণতান্ত্রিক সরকার। এটাকে মূলত প্রজাতান্ত্রিক সরকার বলে অভিহিত করা হয়। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংবিধান অনুযায়ী, জনগণের ম্যান্ডেড নিয়ে সরকার গঠিত হবে, এটাই নিয়ম। সরকার গঠন বা পরিবর্তনের মাধ্যম হচ্ছে নির্বাচন।
নির্বাচন মানেই প্রতিযোগিতা আর প্রতিযোগিতার অর্থ হচ্ছে অংশগ্রহণ। যেখানে, প্রধান রাজনৈতিক দল সহ দেশের প্রায় ৬৬ টি রাজনীতিক দল এই নির্বাচন বয়কট করেছে, সেটাকে কোনো অবস্থায় বৈধ বা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলা যায় না। আর অংশগ্রহণ না থাকার কারণে কোথাও কোনো প্রতিযোগীতার লক্ষণ চোখে পড়ছে না।
২০১৪ সালের নির্বাচনের পূর্বেই ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন এবং নির্বাচনের পূর্বেই সরকার গঠন নিশ্চিত হয়ে যায়। সেই নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়নি। তেমনি কোনো প্রতিযোগিতা ও ছিল না। ভোটাররা তাদের পছন্দের পার্থী নির্বাচন থেকে বঞ্চিত হয়। ২০১৮ সালের নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হলেও রাতের বেলায় ভোট সম্পন্ন করায় সরকারের বিজয় নিশ্চিত হয়ে যায়। সেখানেও ভোটাররা ভোট দিতে পারেনি। বিশ্বজুড়ে নিশিরাতের ভোট ডাকাতির তকমা উড়ে।
আসন্ন ৭ জানুয়ারীর নির্বাচন মূলত আওয়ামী প্যানেলের একটি সাজানো নির্বাচনের আয়োজন করেছে সরকার। আমরা দেখেছি এই নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলসমূহ তাদের বিজয় নিশ্চিত করতে নৌকার মাঝি হতে কিভাবে দৌড়ঝাঁপ করেছেন। কেউ সরাসরি, কেউ কৌশলে। এখানে ফলাফল যাচাই করার কোনো সুযোগ নেই। আগের দুই নির্বাচন থেকে বর্তমান নির্বাচনের চরিত্র ভিন্ন হলে ও কৌশল এবং লক্ষ্য এক। প্রার্থীদের ছড়াছড়ি থাকলেও জোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই। নেই কোনো উৎসবমুখর পরিবেশ বা নির্বাচনী আমেজ। নির্বাচনের ম্যাকানিজম শাসকদলের হাতে। সুতরাং ফলাফল নির্ধারিত।
আমি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একজন ছাত্র হিসাবে বিশ্বের কোথাও দেখিনি, একটি নির্বাচনে, দলীয় মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে নিজ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে উৎসাহ প্রদান করা। যেখানে বহিষ্কার করার কথা সেখানে ঘোষণা দিয়ে সমর্থন প্রদান করা ইতিহাসে এরকম আরেকটি দল খুঁজে পাওয়া বিরল। জনগণ ইতিমধ্যে এই নির্বাচনকে “ডামি” নির্বাচন হিসাবে আখ্যাইতো করেছে। পুরো নির্বাচনটাই নিঃসন্দেহে সমঝোতা, পাতানো এবং আঁতাতের নির্বাচন বলা যায়।
পৃথিবীর সকল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ভোটারগণ ভোট দেয়ার পর অর্থাৎ নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পর ফলাফল জানতে পারে, কিন্তু অবাক করার বিষয় হলো, বাংলাদেশের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন আগামী ৭ জানুয়ারী অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু নির্বাচনের ফলাফল এখনই সবার জানা। প্রধানমন্ত্রী কে হচ্ছেন, সরকারে কারা যাচ্ছে , বিরোধী দলের আসনে কারা বসছে তা এখনই পরিষ্কার হয়ে গেছে।
সুতরাং এই নির্বাচন ক্ষমতা পরিবর্তনের জন্য নয়, ক্ষমতা নবায়নের নির্বাচন এবং পুনরায় সরকারে শপথ গ্রহণের নির্বাচন বলা যেতে পারে। এই তামাশার নির্বাচন না করলে রাষ্ট্রের ১৬ শত কোটি টাকা রক্ষা করা যেতো। সরকার একাই এই নির্বাচনের লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করছে বিধায় বহির্বিশ্বকে দেখাতে গিয়ে নিজ দলের নৌকাকে পরাজিত করে ডামি বা স্বতন্ত্র ২-৩ জনকে পাশ করে নিয়ে আসবে। যাতে বলতে পারে অমরাওতো পরাজিত হয়েছি। কিন্তু যারা পাশ করবে তারাও কিন্তু আওয়ামী লীগের সমর্থক। অর্থাৎ আওয়ামী লীগকে আওয়ামী লীগ পরাজিত করবে।
তাহলে নির্বাচন হচ্ছে আওয়ামী লীগ ভার্সাস আওয়ামী লীগ। কি আজব নির্বাচন। এর পরও ১৭৪ টি আসনে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই। এসব আসনে প্রার্থীরা নির্ভার। খুব একটা প্রচারণায় নেই তারা। নির্বাচনের আগেই তারা নির্বাচিত ! নির্বাচনের আগেই যেন সকার!! শুধু আনুষ্ঠানিকতা হবে। যেমন; ৭ জানুয়ারী নির্বাচনের নাটক মঞ্চস্থ হবে, ২ দিন পর অনুগত নির্বাচন কমিশন গেজেট প্রকাশ করবে। তার ২ দিন পর শপথ হবে। সরকার শপথ নিবে, সংবিধান লঙ্ঘন করে। কেননা বর্তমান সংসদের মেয়াদ থাকতেই আরেকটি সংসদ। ৩০০ প্লাস ৩০০ সংসদ একই সময়ে যা সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
মনে হচ্ছে সংবিধান যেন সরকারের বাধা নয়। বরং মনে হচ্ছে সংবিধান সরকারের ইচ্ছাধীন। অসাংবিধানিক নির্বাচনের বৈধতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের হত্যা , গুম, খুন, জেল, সর্বোপরি নির্বাচনকালীন সময়ে বিরোধী রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের গণহারে গ্রেফতার করে যারা ক্ষমতার মোহে প্রজাতন্ত্রকে সর্বনাশের দিকে ঠেলে দিচ্ছে তাদেরকে একদিন অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে। এর দায় বর্তমান শাসক দল কখনো এড়াতে পারবেনা।
লেখক: প্রভাষক, আয়ারল্যান্ড প্রবাসী