আইনজীবী থেকে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন স্টারমার
প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ জুলাই ২০২৪
দেশ ডেস্ক:: যুক্তরাজ্যে সাধারণ নির্বাচন চলছে। আজ বৃহস্পতিবার (৪ জুলাই) স্থানীয় সময় সকাল ৭টায় (বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা) শুরু হওয়া এ ভোটগ্রহণ চলবে রাত ১০টা (বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ৩টা) পর্যন্ত। ইতোমধ্যেই জনমত সমীক্ষায় এগিয়ে রয়েছে লেবার পার্টি।
নির্বাচনে যদি লেবার পার্টি জয় পায় তবে আগামী ৫ বছরের জন্য ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের বাসিন্দা হবেন কিয়ের স্টারমার। স্টারমার আইনজীবী হিসেবে বর্ণাঢ্য কর্মজীবন শেষ করার পর রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ২০১৫ সালে পঞ্চাশের কোঠায় এসে এমপি হিসেবে প্রথমবারের মতো সংসদে প্রবেশ করেন তিনি।
স্টারমার ১৯৬২ সালে লন্ডনে জন্মগ্রহণ করেন। পরিবারের চার সন্তানের মধ্যে স্টারমার বেড়ে ওঠেন দক্ষিণ-পূর্ব ইংল্যান্ডের সারে-তে। তার বাবা একটা কারখানার সরঞ্জাম প্রস্তুতকারক হিসাবে কাজ করতেন এবং মা ছিলেন নার্স। তার পরিবারও কট্টর লেবার পার্টির সমর্থক ছিল, যার প্রতিফলন পাওয়া যায় তার নামে। স্কটিশ খনি শ্রমিক কিয়ের হার্ডির নাম অনুসারে তার নাম রাখা হয়েছিল। লেবার পার্টির প্রথম নেতা ছিলেন কিয়ের হার্ডি।
বড় হয়ে ওঠার সময় কিয়েরের পারিবারিক জীবন খুব সুখকর ছিল না। দূরত্ব রেখে চলতেন তার বাবা। তার মা জীবনের দীর্ঘকাল ‘স্টিল’স ডিজিজ’ নামক এক ধরনের অটো-ইমিউন ডিজিজে ভুগেছেন। রোগের কারণে ধীরে ধীরে হাঁটার এবং কথা বলার ক্ষমতা হারান তার মা। একসময় তার পা কেটে বাদ দিতে হয়েছিল।
১৬ বছর বয়সে লেবার পার্টির স্থানীয় যুব শাখায় যোগ দেন কিয়ের স্টারমার। কিছু সময়ের জন্য উগ্র বামপন্থী একটি পত্রিকার সম্পাদনাও করেছিলেন। কিয়ের তার পরিবারের প্রথম সদস্য যিনি শিক্ষা লাভ করতে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছেন। লিডস এবং অক্সফোর্ডে আইন নিয়ে পড়াশোনা করেন তিনি। ব্যারিস্টার হিসাবে মানবাধিকার নিয়ে কাজও করেছেন। সেই সময় ক্যারিবিয়ান এবং আফ্রিকার দেশগুলিতে মৃত্যুদণ্ড বিলুপ্তির জন্য তিনি কাজ করেন। ১৯৯০-এর দশকে একটা বিখ্যাত মামলায়, তিনি দু’জন ইকো-অ্যাক্টিভিস্ট বা পরিবেশ আন্দোলনকারীর প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন যাদের বিরুদ্ধে ‘ম্যাকডোনাল্ডস’ মামলা করেছিল।
২০০৮ সালে, স্যার কিয়ের পাবলিক প্রসিকিউশনের ডিরেক্টর এবং ক্রাউন প্রসিকিউশন সার্ভিসের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসের সবচেয়ে সিনিয়র প্রসিকিউটর সরকারি কৌঁসুলি ছিলেন। ২০১৩ সাল পর্যন্ত তিনি চাকরি করেন। ২০১৪ সালে তাকে নাইট উপাধি দেওয়া হয়েছিল। তিনি প্রথমবার সংসদে যান ২০১৫ সালে। লন্ডনের হবর্ন অ্যান্ড সেন্ট প্যানক্রাসের সাংসদ হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
কট্টর বাম রাজনীতিবিদ জেরেমি করবিনের নেতৃত্বে লেবার পার্টি তখন বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করছে। অভিবাসনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সরকারের কার্যকলাপ নজরে রাখার জন্য স্টারমারকে ‘শ্যাডো হোম সেক্রেটারি’ (ছায়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) হিসাবে নিয়োগ করেছিলেন জেরেমি করবিন।
যুক্তরাজ্য ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে ভোট দেওয়ার পরে, স্টারমারকে ‘শ্যাডো ব্রেক্সিট মন্ত্রী’ হিসাবে নিয়োগ করা হয়। ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর লেবার পার্টির নেতা হওয়ার সুযোগ পান স্টারমার। লেবার পার্টির জন্য সবচেয়ে খারাপ সময় ছিল এটা। ১৯৩৫ সালের পর সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে হেরেছিল ওই দল, যা জেরেমি করবিনকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে।
পানি ও জ্বালানি কোম্পানির জাতীয়করণ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে শিক্ষাদানের পক্ষে কথা বলে একটা বামপন্থী প্লাটফর্মে লেবার পার্টির নেতা হিসাবে জয় লাভ করেন স্টারমার। জেরেমি করবিন লেবার পার্টিকে বামপন্থী এবং মধ্যপন্থীদের মধ্যে ভাগ করেছিলেন। স্টারমার কিন্তু বলেছিলেন তিনি পার্টিকে একত্রিত করতে চান। একই সঙ্গে করবিনের চিন্তাধারাও ধরে রাখতে চেয়েছিলেন। করবিন দলের নেতৃত্বে থাকাকালীন ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে যে বিতর্ক হয়েছিল, তার জেরে তাকে সংসদীয় লেবার পার্টি থেকে বরখাস্ত করেন স্টারমার।
তবে দলের বামপন্থী অনেকে বলেন, সংসদীয় প্রার্থী হিসেবে যাতে শুধুমাত্র মধ্যপন্থী সদস্যরাই দাঁড়াতে পারেন, সেটা নিশ্চিত করতেই স্টারমার দলের অভ্যন্তরে দীর্ঘমেয়াদী অভিযান চালাচ্ছেন। আর এসব নিয়ে প্রতিপক্ষদের ‘উপহাসের নিশানায়’ প্রায়শই থাকেন তিনি। নিজেকে কঠোর নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে থাকা এক মানুষ হিসাবে পরিচয় দিয়ে থাকেন স্টারমার। এক সহকর্মী তার নাম দিয়েছিলেন ‘মিস্টার রুলস’!
জীবনে একবারই আইনের ফাঁদে পড়েছিলেন। যুবক বয়সে ট্রেডিং পারমিট ছাড়াই আইসক্রিম বিক্রি করতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিলেন তিনি। আইসক্রিম বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল বটে, তবে তার বিরুদ্ধে আর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে তার যুক্তরাজ্যের গার্ডিয়ান পত্রিকাকে তিনি বলেন, “আমি হারতে ঘৃণা করি। কেউ কেউ বলে থাকেন (প্রতিযোগিতায়) অংশগ্রহণ করাটাই গুরুত্বপূর্ণ। আমি আবার ওই দলে নেই।”
এদিকে নির্বাচনের মাত্র কয়েকদিন আগে বাংলাদেশের অভিবাসীদের নিয়ে মন্তব্য করে আলোচনায় এসেছিলেন স্টারমার। নির্বাচন উপলক্ষে ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড দ্য সান আয়োজিত এক নির্বাচনি বিতর্কে অবৈধ অভিবাসী বিষয়ে বর্তমান সরকারের ‘রুয়ান্ডা পলিসিকে’ ব্যয়বহুল উল্লেখ করেন স্টারমার। ক্ষমতায় গেলে এই নীতি বাতিলের ঘোষণা দিয়ে তিনি বলেন, দল ক্ষমতায় গেলে তার সরকার অভিবাসীরা যেখান থেকে এসেছে, সে দেশেই ফেরত পাঠাবে। বাংলাদেশের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ‘এ মুহূর্তে বাংলাদেশের মতো দেশগুলো থেকে আসা মানুষজনকে ফেরত পাঠানো হচ্ছে না। কারণ বর্তমান সরকার তেমন ব্যবস্থাও দাঁড় করাতে পারেনি। লেবার পার্টি সরকারে গেলে তাদের (অভিবাসী) ফিরতি বিমানে তুলে দেওয়া হবে।’
পরে অবশ্য এই মন্তব্যের জন্য ভুল স্বীকার করেন স্টারমার। একই সঙ্গে বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসাও করেন তিনি। তিনি বলেন, যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি ও সংস্কৃতিতে বাংলাদেশিদের অনেক অবদান আছে। লেবার পার্টি এবং বাংলাদেশি কমিউনিটির মধ্যে দৃঢ় বন্ধন রয়েছে। আমার সঙ্গেও বাংলাদেশি কমিউনিটির বন্ধন খুবই শক্তিশালী।’
ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ ‘হাউস অফ কমন্স’-এ মোট আসন ৬৫০। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য কোনো দলকে ৩২৬ আসন নিশ্চিত করতে হবে। ভোটগ্রহণ শেষ হলে শুরু হবে গণনা। রাত ১২টায় প্রকাশিত হবে প্রথম ফল। তার পরের ফল প্রকাশিত হবে যথাক্রমে রাত ৩টা, ভোর ৪টা, ভোর ৫টা এবং সকাল ৭টায়।
জনমত সমীক্ষা বলছে, লেবার পার্টি ৪০ শতাংশ ভোট পাবে, টোরিরা পাবে ২০ শতাংশ ও নাইজেল ফারাজের নেতৃত্বাধীন কট্টরপন্থী দল রিফর্ম ইউকে পাবে ১৬ শতাংশ ভোট। ব্রিটেনে এ বারের নির্বাচনে মোট ৪৫১৫ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।