শবেবরাতের তাৎপর্য ও শিক্ষা
প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
মাওলানা এম এম আহমদ:: আজকের রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাতের রাত। ভাগ্যরজনী। আল্লাহর রহমত ও ক্ষমা প্রার্থনার রাত। ইসলামে ‘শবেবরাত’ একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ‘শবেবরাত’ ফারসি শব্দ। ‘শব’ অর্থ রাত আর ‘বরাত’ অর্থ ভাগ্য। দুটি শব্দ একত্রে করলে হয় ‘ভাগ্যের রাত বা ভাগ্যের রজনী। এই শবেবরাতকে আরবিতে ‘লাইলাতুল বারআত’ অর্থাৎ মুক্তির রাত বলা হয়। পবিত্র কোরআনে এই রাতকে ‘লাইলাতুল মুবারাকাহ’ অর্থাৎ বরকতময় রজনী বলা হয়েছে। আরবি শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে লাইলাতুল বরাত বলা হয়। এই রাত অত্যন্ত বরকতম-িত এবং আধ্যাত্মিক, তাই এই রাত থেকে কেবল সেই ব্যক্তিই পরিপূর্ণভাবে লাভবান হতে পারবে যার রুহ পবিত্র। কারণ, আল্লাহপাক পবিত্র আর তিনি পবিত্র আত্মার সন্ধান করেন।
তাই আমরা যদি পবিত্র হৃদয় নিয়ে আল্লাহপাকের দরবারে এ রাতে বেশি বেশি নফল ইবাদত-বন্দেগিতে রত থেকে অতিবাহিত করি, তাহলে আল্লাহতায়ালা হয়তো আমাদেরকে ক্ষমা করবেন এবং তার রহমতের ছায়ায় আশ্রয় দান করবেন। এই বিশেষ রাতে আল্লাহপাক চান তার বান্দারা যেন কেবলমাত্র তারই হয়ে যায়। আমরাও যদি একান্তভাবে আল্লাহর হয়ে গিয়ে এ রাতে তার ধ্যানে মগ্ন থাকি, তাহলে হয়তো আমাদের রুহকেও আল্লাহপাক পবিত্র ও তাজা করে আমাদের দুঃখ-কষ্ট দূর করে তার প্রিয় বান্দায় পরিণত করবেন। তাই এই রাতকে আমাদের কাজে লাগানো উচিত, কারণ আমাদের আত্মা যে মৃত, একে তাজা করতে যে আমাদের হবেই আর না হয় এ জীবনের কি বা মূল্য আছে? তাই রুহুকে তাজা করার জন্য এই রাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি রাত।
আমরাও যদি আমাদের রুহকে পবিত্র করতে চাই এবং আল্লাহ পাকের নৈকট্য লাভ করতে চাই তাহলে আসুন না এ রাতকে কাজে লাগাই। রাতভর ইবাদত-বন্দেগির মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করি। এই রাতে কোরআন তেলাওয়াত, বেশি বেশি নফল নামাজ আদায়, বসে বসে আল্লাহর জিকির করা উচিত। আল্লাহপাকের কাছে আমরা যদি বিগলিত চিত্তে দোয়া করি তাহলে অবশ্যই তিনি আমাদের ডাক শুনবেন। যেভাবে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে- ‘তিনি কে, যিনি ব্যাকুল ব্যক্তির দোয়া শোনেন যখন সে তার সমীপে দোয়া করে ও তার কষ্ট দূর করে দেন’ (সূরা নমল, আয়াত : ৬২)।
পুণ্যে পরিপূর্ণ এ রাতের সন্ধান লাভ করা কোনো সাধারণ বিষয় নয় এবং এটি কোনো সাধারণ কাজও নয়। যে ব্যক্তি বছরের প্রতিটি দিবস ও রাত অতিশয় সাধনায় দ্বীনের ইবাদতে ব্রত থেকে পুণ্যতায় পূর্ণ হতে পারবেন, কেবল তিনিই সন্ধান পাবেন এই লাইলাতুল বরাতের সওগাত সম্ভার। মহান আল্লাহপাক তার পবিত্র গ্রন্থ কোরআনে বলেন, ‘যারা ইমান আনে এবং যাদের হৃদয় আল্লাহকে স্মরণ করে প্রশান্তি লাভ করে। স্মরণ রেখো, আল্লাহর স্মরণেই হৃদয় প্রশান্তি লাভ করে’ (সূরা আর রাদ, আয়াত : ২৮)। মুমিন মাত্রই এ রাতের পবিত্রতায় আল্লাহ স্মরণের মাত্রাকে বহুগুণে বৃদ্ধি করে দেয়, ইবাদতের একাগ্রতাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। এমন কোনো পুণ্যের কাজ নেই যা কিনা সে হাতছাড়া করে। তখন তার অন্বেষণ মাত্র একটাই আর তা হলো- আল্লাহতায়ালার সন্ধান লাভ করা। এ প্রাপ্যতার মাঝেই তার আত্মার প্রশান্তি ও জীবনের সার্থকতা খুঁজে পায়। প্রতিটি বছর শাবানের এই ১৪ তারিখের দিবাগত রাতটি তার সেই স্বর্গসুধা প্রদানের জন্যই আমাদের প্রত্যেককে আহ্বান করে।
আসুন না, আমরা সবাই এ রাতে ব্যাকুল হয়ে আল্লাহপাকের কাছে দোয়া করি- তিনি যেন আমাদের রুহকে পরিষ্কার করে দিয়ে আমাদের আত্মায় যত ময়লা জমেছে তা ধুয়েমুছে স্বচ্ছ করে দেন। এ ছাড়া আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য আমরা যেন শুধুমাত্র এই একটি রাতের অপেক্ষাই না করি, বরং প্রতিটি রাতেই যেন ইবাদতে রত থাকি। অনেকে হয়তো মনে করবেন যে, আমাদের মতো সাধারণ মানুষ কীভাবে আল্লাহপাকের নৈকট্য লাভ করতে পারে? হ্যাঁ, সবাই মহান আল্লাহতায়ালাকে লাভ করতে পারে, তবে প্রথম শর্ত হচ্ছে- আত্মার পবিত্রতা। প্রত্যেক মোমেনের জন্য আল্লাহপাক তার সঙ্গে সাক্ষাতের রাস্তা খুলে রেখেছেন, যেভাবে মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘নামাজ মোমিনের মিরাজ’। অর্থাৎ মোমিন মুত্তাকির মিরাজ হয় নামাজের মাধ্যমে। আমরা যদি নিয়ম অনুযায়ী আত্মা পবিত্র করে এ রাতে অনেক বেশি একাগ্রচিত্তে নামাজ আদায় করি, তাহলে আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি আমরাও লাভ করতে পারি। আর এ রাস্তা এখনও খোলা আছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে।
অনেকে এ রাতের আধ্যাত্মিক পরিবেশকে নষ্ট করেন আতশবাজি আর পটকা ফুটিয়ে। এই সম্পর্কে যদিও নিষেধাজ্ঞা থাকে, তারপরও এটি চলতে থাকে। তাই এ রাতের আধ্যাত্মিক পরিবেশকে এসব বাজে কাজ করে নষ্ট করা উচিত নয়। আল্লাহতায়ালার কাছে এই দোয়াই করি, তিনি যেন আমাদের আত্মাকে শান্তিময় করেন আর ইহজীবনেই যেন লাভ করতে পারি আল্লাহপাকের জান্নাতের স্বাদ। মোর আত্মা যেন রাব্বুল আলামিনের কাছ থেকে এই সংবাদ লাভ করে যে, ‘হে শান্তিপ্রাপ্ত আত্মা! তুমি তোমার প্রভু-প্রতিপালকের দিকে সন্তুষ্ট হয়ে এবং তার সন্তুষ্টিপ্রাপ্ত হয়ে ফিরে আস। অর্থাৎ তুমি আমার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ করো’ (সূরা ফাজর, আয়াত : ২৭-৩০)।
মানুষের আধ্যাত্মিক উন্নতির উচ্চতম পর্যায় হচ্ছে- সে তার প্রভুর ওপর পূর্ণভাবে সন্তুষ্ট এবং তার প্রভুও তার প্রতি সন্তুষ্ট আর এই পর্যায়ে যখন মোমিনের আত্মা উপনীত হয় তখনই আল্লাহপাক তাকে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের প্রকৃত বান্দা হিসেবে ভূষিত করেন। আর কদিন পরই সৌভাগ্যম-িত মাস আমরা লাভ করতে যাচ্ছি। তাই মহান এ রাতে আমাদের অনেক বেশি দোয়া করা উচিত, আল্লাহতায়ালা যেন আমাদের সবাইকে পবিত্র মাহে রমজান লাভের সৌভাগ্য দান করেন আর আমাদের সবাইকে যেন পুরো মাস রোজা রাখার শক্তি দান করেন।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে এ রাতে এ প্রার্থনাই থাকবে- তিনি যেন আমাদের সকলের রুহকে পবিত্র ও তাজা করে দেন এবং আমাদের দোষ-ত্রুটি ক্ষমা করেন, আমিন।
মাওলানা এম এম আহমদ : ইসলামি চিন্তাবিদ