কাতার সংকট- কী হবে হামাসের?
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ জুন ২০১৭
দেশ ডেস্ক, ১৬ জুন : ফিলিস্তিনের সশস্ত্রগোষ্ঠী হামাস যখন গত মাসে নিজেদের নতুন সনদ প্রকাশ করে, তখন রামাল্লা কিংবা গাজা থেকে নয়, সনদ প্রকাশিত হয় কাতারের দোহার শেরাটন হোটেলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে। ঘোষণাস্থল হিসেবে হামাস কাতারকে বেছে নিয়েছে, এতে অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। বিদায়ী হামাস নেতা খালেদ মেশাল এখানেই বসবাস করছেন। তার নেতৃত্বের বড় সময়জুড়ে তিনি এখানে ছিলেন। আটলান্টিক কাউন্সিলের জ্যেষ্ঠ ফেলো এইচ. এ. হেলয়ের বলেন, ‘হামাসের কাছে কাতার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ব্যাপক আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে কাতার। পাশাপাশি, বেশ কয়েকজন হামাস নেতার বসবাসও এখানে।’ পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে কাতারকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক সংকটে এই সম্পর্ক হুমকির কবলে। এ মাসের শুরুর দিকে, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিশর ও বাহরাইন একযোগে প্রতিবেশী কাতারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। এমনকি কাতারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মাত্রার আর্থিক অবরোধও আরোপ করা হয়।
বহু বছর ধরে বেড়ে উঠতে থাকা ক্ষোভেরই চূড়ান্ত পর্যায় এই অবস্থা। মোট নয়টি দেশের অভিযোগ দোহা সন্ত্রাসী সংগঠনকে সাহায্য করছে। মুসলিম ব্রাদারহুডকে সমর্থন দিচ্ছে। পাশাপাশি, ইরানের সঙ্গে একটু বেশিই মাখামাখি করছে। তবে কাতারের সঙ্গে হামাসের সম্পর্ক নিয়ে এই অঞ্চলে অত বিভেদ তেমন ছিল না। যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন ও ইউরোপে হামাস সন্ত্রাসী সংগঠন, তবে কাতারসহ আরব রাষ্ট্রগুলোতে নয়। তাই সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন দাবি করলেন, হামাসকে সমর্থন দিতে পারবে না কাতার, তখন রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যম আরটিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই তথ্য মনে করিয়ে দিতে ভুললেন না। কাতারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আবদুল রহমান আল থানি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র হামাসকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করে। কিন্তু অবশিষ্ট আরব দেশগুলোর কাছে, হামাস একটি বৈধ প্রতিরোধ আন্দোলন। আমরা হামাসকে সমর্থন করি না, আমরা ফিলিস্তিনি জনগণকে সমর্থন করি।’ তিনি আরো বলেন, ‘দোহায় হামাসের উপস্থিতি যুক্তরাষ্ট্র ও এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশের সঙ্গে সমন্বয় করেই নিশ্চিত করা হয়েছে। ফিলিস্তিনের বিভিন্ন অংশ যাতে সমঝোতায় পৌঁছে, সেই প্রচেষ্টারই একটি অংশ এটি।’
সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ওই দাবির প্রেক্ষিতে মন্তব্য করেছে হামাস। সংগঠনটি বলছে, তাদেরকে অন্যায্যভাবে এখানে টেনে আনা হয়েছে। হামাসের মুখপাত্র ফাওজি বারহুম এক বিবৃতিতে বলেন, ‘উপসাগরীয় দেশগুলো প্রতিরোধ সংগঠনগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে কাতারকে চাপ দিচ্ছে। এটি অগ্রহণযোগ্য। আমরা এই চাপের কাছে নতি স্বীকার করতে চাই না। আমরা একটি প্রতিরোধ আন্দোলন। পুরো বিশ্ব এর সাক্ষী।’
তবে গত কয়েক বছরে ধারাবাহিক চাপের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে হামাস। তারই ফল দেখা যায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনে। গত মাসে নতুন নেতা ইসমাইল হানিয়ার নাম ঘোষণা করা হয়। তিনি দীর্ঘদিনের নেতা খালেদ মেশালের স্থলাভিষিক্ত হন। সংগঠনটির নতুন সনদ ঘোষণার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই এই পদক্ষেপ।
ইসরাইল বলছে, নতুন সনদের সহিংস প্রতিরোধকে সমর্থন করা হয়েছে, ‘যায়নবাদী অস্তিত্বকে প্রত্যাখ্যানে’র অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। কিন্তু পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পূর্ববর্তী সীমানা অনুযায়ী ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতি সমর্থনসূচক একটি অংশ সনদে রয়েছে। এটিই সংগঠনটির সাম্প্রতিক মধ্যপন্থা অনুসরণের প্রমাণ।
হামাসের মধ্য ও নিম্নপর্যায়ের নেতৃবৃন্দ এখনও এই পরিবর্তন মেনে নিতে কসরত করছে। এরই মধ্যে সংগঠনটির জ্যেষ্ঠ নেতৃবৃন্দকে এখন প্রতিদিনকার কূটনৈতিক পরিবর্তনের দিকে ঘনিষ্ঠ নজর রাখতে হচ্ছে।
এইচ. এ. হেলয়ের মনে করেন, হামাসের দিকে অকস্মাৎ নয়টি আঞ্চলিক দেশের নজর দেয়ার কারণ প্রধানত দুটি। ‘প্রথমত, হামাসের সঙ্গে মুসলিম ব্রাদারহুডের সম্পর্ক। ফলে আরব আমিরাত ও সৌদি আরবের রোষানলে পড়েছে হামাস। কিন্তু আমি মনে করি, আরো বড় কারণ হলো, এ সিদ্ধান্ত মাথায় নেয়া হয়েছে পশ্চিমাদের কথা মাথায় রেখে। ওই অঞ্চলে সৌদি আরবকে ক্ষমতাধর গোষ্ঠী হিসেবে ট্রাম্প প্রশাসন স্বীকৃতি দিয়েছে। তারই সুবিধা নিয়েছে সৌদি শাসকরা। এটিই তাদেরকে এসব সিদ্ধান্ত নিতে উৎসাহিত করে থাকতে পারে।’
বহুবছর ধরে আঞ্চলিক স্বৈরশাসকদের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায় কাতার-ভিত্তিক টিভি স্টেশন আল জাজিরা। কাতারের আঞ্চলিক প্রভাব প্রতিপত্তির আরেকটি অংশ হলো ইসলাম-মতবাদী গোষ্ঠীগুলোর সমর্থন। হতে পারে সেটি মুসলিম ব্রাদারহুড কিংবা হামাসের মতো মধ্যপন্থি সংগঠনগুলো, কিংবা আল কায়দার মতো উগ্র গোষ্ঠীগুলো।
নিজেদের এই প্রভাব ব্যবহার করে দোহা তালিবানসহ বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সমঝোতায় সাহায্য করেছে। পাশাপাশি, হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে একটি অস্ত্রবিরতি আনয়নেও ভূমিকা রেখেছে।
২০১০ ও ২০১১ সালে, মধ্যপ্রাচ্যে কাতারের প্রভাব অনেকখানি বৃদ্ধি পায়। আরব স্বৈরাচারদের গলার কাঁটা আল জাজিরা তখনকার আরব বসন্ত নিয়ে ব্যাপক রিপোর্টিং করে।
মিশরে গণঅভ্যুত্থানের পর মুসলিম ব্রাদারহুড নেতা মোহাম্মদ মুরসির নির্বাচন জয়ের পর আরো ঘাঁটি গেড়ে বসে আল জাজিরা। সেবার ক্ষমতায় আসার কিছুদিন পরই গাজার হামাস ও ইসরাইলের যুদ্ধের ইতি টানতে ভূমিকা রাখেন মুরসি। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক সাধুবাদও জোটে তার।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত আরব বসন্ত ভালোর চেয়ে মন্দই বয়ে আনে হামাসের জন্য। সংগঠনটির বন্ধুরাষ্ট্রের সংখ্যা অনেক কমে যায়। ফিলিস্তিনি স্বতন্ত্র রাজনীতিক মুস্তাফা বার্ঘৌতি বলেন, ‘সিরিয়া, মিশর, কাতার, তুরস্ক ও ইরানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল হামাসের। কিন্তু সময়ের আবর্তনে পরিস্থিতির অনেক পরিবর্তন হয়েছে। তাই হামাসকেও নিজেদের সম্পর্কে বৈচিত্র্য আনতে হয়েছে।’
২০১২ সালের আগে হামাস নেতারা দামেস্কে বসবাস করতো। কিন্তু সিরিয়ায়ও অভ্যুত্থাণ শুরু হলে দেশটির প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ ও হামাসের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। শেষপর্যন্ত হামাস বিদ্রোহীদের পাশে দাঁড়ায়। এবং সিরিয়া, হেজবুল্লাহ ও ইরানের সঙ্গে কিছু মাত্রায় সম্পর্ক ছিন্ন করে। এইচ. এ. হেলয়ের বলেন, ‘আরব বসন্ত শেষে হামাস অনেক কিছু হারিয়েছে। কাতার হামাসের পেছনে এগিয়ে আসার এটিও একটি কারণ।’
পুরো পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করে কাতার। আগে থেকেই দেশটি ব্রাদারহুড ও হামাসের সমর্থক ছিল। ২০১২ সালের শেষের দিকে, কাতারের আমির শেখ হামাদ বিন খলিফা আল থানি গাজা সফর করেন। হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজায় সেবারই প্রথম কোন রাষ্ট্রপ্রধান সফর করেন। লাখো কোটি ডলারের মূল্যের বহু প্রকল্পের উদ্বোধন করেন আমির। অনেক দেশ যখন গাজা তীর থেকে বিদায় নিয়েছে, কাতার আবিষ্কার করে তার প্রভাব সেখানে ব্যপকভাবে বেড়েছে।
কিন্তু ২০১৩ সালের জুলাইয়ে কাতারের উচ্চাকাক্ষা বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। সেই মাসেই মুরসিকে উৎখাত করে দেশটির সামরিক বাহিনী। মুসলিম ব্রাদারহুড ক্ষমতা ও প্রভাব- দুই-ই হারায়। কাতার ও হামাসের শত্রুভাবাপন্ন জেনারেল আবদেল ফাতাহ এল সিসি ক্ষমতায় আসেন।
সিসি এসেই ব্রাদারহুডকে সমর্থন ও অভ্যুত্থান-পরবর্তী সহিংসতার জন্য হামাসকে দায়ী করেন। গাজা ও মিশরের মধ্যকার শত শত গোপন টানেল ধ্বংস করা হয়। হামাস ও কায়রোর মধ্যে সম্পর্ক এত খারাপ হয় যে, অনেক মিশরীয় পণ্ডিত গাজা যুদ্ধের সময় ইসরাইলের প্রশংসা করেন। তিন বছরেরও কম সময় পর এবার মিশরের সঙ্গে গলা মেলালো আরব তিনটি দেশ। হেলয়ের বলেন, ‘যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে তাতে কাতারের টিকে যাওয়া খুব মুশকিল। কিন্তু সমঝোতার পথে যেতে চায়, এমন লোকের সংখ্যা এখন কাতারেও কম। সমস্যাটা হলো, পরিস্থিতি এত দ্রুত খারাপ হয়েছে যে, মুখ রক্ষার কোন উপায় আর নেই। দোহা যদি এখন অন্যদের দাবির মুখে নতি স্বীকার করে, তা অভ্যন্তরীণভাবে দোহার জন্য শোভন হবে না।’
তবে কাতারের সমঝোতার পথে হাঁটার প্রাথমিক লক্ষণ হতে পারে, হামাস নেতৃবৃন্দকে বহিষ্কার করা। সুদান কিংবা তুরস্ক হতে পারে তাদের পরবর্তী আশ্রয়স্থল। তবে হামাসের মুখপাত্র বলেছেন, এখন পর্যন্ত এমন কিছুই ঘটেনি। তবে তিনি বলছেন, অনেক দেশই হামাসকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত।
কাতারের সঙ্গে সম্পর্কহানি হলেও হামাস ভেঙে পড়বে না। সংগঠনটি কাতারি অর্থ ছাড়াও টিকে ছিল। কিন্তু গাজায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে, বলাই বাহুল্য। জাতিসংঘের মতে, গাজায় বেকারত্বের হার ৬৫%। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার দেয়া খাদ্যে বেঁচে আছে ১০ লাখ মানুষ। বার্ঘৌতি বলেন, ‘সেখানকার পরিস্থিতি সাংঘাতিক, বিপজ্জনক ও বিস্ফোরণোন্মুখ। কাতার গাজাবাসীকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দিয়ে সাহায্য করে আসছে। হামাসের সঙ্গে কাতারের সম্পর্কচ্ছেদ বেসামরিক মানুষের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। আমার দুশ্চিন্তা হলো হামাসকে বেশি চাপে ফেলাটা নতুন বিভেদ ও উগ্রবাদ সৃষ্টি করবে।’
তিনি বলেন, শেষ পর্যন্ত উপসাগরীয় দেশগুলোর এই বিবাদ ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন রাষ্ট্রের আকাংক্ষায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তার ভাষ্য, ‘আরব বিশ্বের অভ্যন্তরীণ বিবাদ ফিলিস্তিনের জন্য সুখবর নয়। একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব হলো, ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা ও মুক্তির প্রয়োজনীয়তা এসব বিবাদের ঢামাঢোলে হারিয়ে যায়।’
(সিএনএন অবলম্বনে)