প্রতিদিন হৃদয়পটে ভেসে ওঠে যে মুখচ্ছবি
প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ জুন ২০১৭
কাইয়ূম আবদুল্লাহ:
স্পষ্ট এখনো সবকিছু মনে আছে। বাবাকে কবরস্থ করে চলে আসার কয়েক বছর পেরিয়ে গেছে, তবু কোনো কিছুই ভোলা যাচ্ছে না। সেই কুয়াশাচ্ছন্ন মখমল ভোর। দিগন্ত বিস্তৃত বিকেল। বাড়ির পাশের মসজিদসহ পুরো গ্রামকে প্রায় অন্ধকারে ঢেকে দিয়ে অন্যরকম নিস্তব্ধতায় ঘুমিয়ে থাকা সফেদ শ্বশ্রুমন্ডিত আব্বার মুখাবয়ব। সিরাজ চাচার সেই আক্ষেপ- “আমারার আস্তা গাউ আইন্দার অইগিলো!”
নাহ! আর ঘুম ভাঙলো না আব্বার। দীর্ঘ ৩ মাস বাড়ি, ক্লিনিক-আইসিইউতে দৌঁড়াদৌড়ি হলো কেবল, কোনো লাভ হলো না। অবশেষে তার অভিমান অক্ষুন্ন রেখেই চিরনিদ্রায় চলে গেলেন তিনি। শেষ ঠিকানায় শায়িত রেখে আমাদেরও ফিরতে হলো সেকেন্ড হোম বিলেতে। আমরা মানে- আমি ও আমার বড় ভাই। বাবার গুরুতর অসুস্থতার খবর পেয়ে তৎক্ষণাৎ দুজনই ছুটে গিয়েছিলাম। বাবার পাশে ৪ মাস থাকার সৌভাগ্য হয়েছিলো ঠিকই। কিন্তু দুঃখ শুধু একটাই – বাবা আমাদের উপস্থিতি বা স্পর্শ বুঝতে পেরেছিলেন কি-না তা আর জানা হলো না। চুড়ান্ত ফেরার দিনের আগেই বুকের ভেতর এক অন্যরকম ধুকধুকানি অনুভূত হলো- আমাদের জন্য আর প্রতীক্ষায় রইবে না কেউ!\
আটাশ ডিসেম্বর ২০১৩, দুপুরে ওসমানি বিমানবন্দরে আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঢাকার উদ্দ্যেশে সিলেট ত্যাগ করলাম। পরদিন ঢাকা থেকে লন্ডনে ফ্লাইট। অন্যবার এয়ারপোর্ট পর্যন্ত বাবা আসতেন। সবকিছুতে আমি দেরি করি তাই ফ্লাইট যাতে মিস না হয় সেজন্য তার ভেজা চোখ অড়াল করে বাড়ি থেকে আমাকে তাড়া দিয়ে বের করে নিয়ে আসতেন। মাকে হারিয়েছি অনেক আগে। তারপর বাবাই ছিলেন ধ্যান-জ্ঞান।
একটু বেশি আড্ডাবাজ ছিলাম বলে প্রায়ই সিলেট শহর থেকে রাত গভীর করে বাড়ি ফিরতাম। তাতে বাবার কী পেরেশানি! গ্রামে তখনো বিদ্যুৎ যায়নি। মাঝে মধ্যে এমনও হতো অপেক্ষা করতে করতে হারিকেন কিংবা টর্চ লাইট হাতে কাউকে সাথে নিয়ে আমার খুঁজে থানা সদর বিশ্বনাথ বাজার পর্যন্ত চলে আসতেন। গভীর রাতে কষ্ট করে আমার খুঁজে বাবার বেরুনোয় নিজেকে খুব অপরাধী মনে হতো। তাই মাঝে মধ্যে কিছুটা রাগ করে বলে ফেলতাম- আমিতো আসতেছি, তবু কীসের জন্যে …? বাবা বলতেন: আমি কি আসতে চাই, পীঠ যে আমাকে থাকতে দেয় না বিছানায়, তুই কী বুঝবে, কতকিছু মনে ওঠে! এই ছিলেন বাবা।
একটু-আধটু কবিতা লিখি দেখে আব্বা প্রায়ই বলতেন ‘বাবা কবিতা-টবিতা লিখে কী লাভ? কিন্তু ভেতরে ভেতরে যে খুশি হতেন তা বুঝতে দিতেন না। দেশে যাওয়ার পর দেখতে পেলাম- বাবার রুমের আলমরির গ্লাস উইনডোতে আমারই প্রথম কাব্যগ্রন্থ। বোনদের জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম আব্বাই নাকি কোথা থেকে বইটি খুঁজে এনে এভাবে যত্ম করে সাজিয়ে রেখেছেন। তাছাড়া লন্ডনে চলে আসার পর একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি আর কবিতা লিখি কি-না? উত্তরে বলেছিলাম তেমন লিখা হয় না। তখন তিনি বলেছিলেন মাঝে মধ্যে লেখার চেষ্টা করিও। ছোটবেলা থেকেই বাগান করার সখ ছিলো। দিনমান বাগান পরিচর্যায় লেগে থাকি দেখে বলতেন- এসবে কি ভাত দেবে? তবু আমি যখন বাইরে থাকতাম সেই তিনিই আবার নিজে অথবা কাউকে দিয়ে আমার ফুল গাছগুলিতে পানি দিতেন। এ ধরনের অনেক স্মৃতি বাবাকে নিয়ে। এই পরিসরে আর বেশি লিখতে চাই না। কায়মনো বাক্যে শুধু একটাই চাই- আল্লাহ যেন বাবা-মার আত্মাকে শান্তিতে রাখেন এবং ওপারের জীবনে আবারও তাদের সাথে মিলিত করেন।
বাবা দুবার লন্ডনেও এসেছিলেন। সান্নিধ্য পাবার জন্যে আরেকবার নিয়ে আসার ইচ্ছে ছিলো, সেটা আর হলো না! যে রুমটিতে বাবা থাকতেন বহুদিন সেটিকে বাবার রুম নামেই ডাকা হতো। বিলেত চলে আসার পর একটি বিষয় বারবার ভাবাতো যে, বাবার কিছু হলে সাথে সাথে তাকে দেখতে চলে যেতে পারবো তো? তাই আল্লাহর কাছে প্রতিদিন দোয়া করতাম- বাবার শেষ সময়ে যেন কাছে থাকতে পারি। আল্লাহ হয়তো কবুল করেছিলেন। হয়েছিলোও তাই, বাবার অসুস্থতার খবর শোনে সাথে সাথে আমরা দুই ভাই ছুটে যাই। দীর্ঘদিন কাছে থেকে বাবার যাতে কোনো কষ্ট না হয় আপ্রাণ সেই চেষ্টাই করেছি। ভাবছিলাম হয়তো তার জ্ঞান ফিরবে এবং ডাক্তারও সেই আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু আফসোস থেকে গেলো যে, বহু চেষ্টা করেও শেষবারের মতো বাবাকে কিছু বলতে বা তার কাছ থেকে কোনো কিছু শোনা হলো না। দেশে অনেকদিন হয়ে যাওয়ায় বাচ্চাদের কী যে আকুতি- বাবা চলে এসো, চলে এসো। জবাবে তাদের আসতেছি বলে শান্তনা দিলেও মনে মনে ভাবতাম- তোমরা কেন বুঝ না যে, আমার বাবাকে আমি কোথায় রেখে আসি। তোমাদের বাবা কিছুদিনের জন্যে দূরে থাকলেও তোমরাতো মায়ের কাছে আছো, আমার বাবাকে কার কাছে রেখে আসবো? শেষ পর্যন্ত বাবাকে কবরস্থ করেই ফিরতে হলো। এখন হৃদয়পটে সেই হাস্যোজ্জ্বল মুখচ্ছবিই একমাত্র শান্তনা।
লেখক : কবি, সাংবাদিক। বার্তা সম্পাদক, সাপ্তাহিক সুরমা, লন্ডন।